একটি ছবি ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরের ১৯ মে’র সংখ্যায় প্রথম পাতায়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ! এটা কী কোন ‘সভ্য’ দেশে চিন্তা করা যায়? কেন একজন প্রধান বিচারপতি বিতর্কিত হবেন? সবাই প্রধান বিচারপতি হতে পারেন না। সবার সেই মেধা ও যোগ্যতা থাকে না। একজন বিচারপতি তো সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষটি। জাতি, সমাজ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সংকটের সময় তিনি হচ্ছেন ভরসারস্থল। আজ তিনিই কিনা বিতর্কিত হলেন! আমরা আমজনতা, আমরা দেখলাম তার কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সমিতির নেতারা। এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না।
ছবিটি দেখে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আমি জানি না। কিন্তু আমি কষ্ট পেয়েছি। বিচারপতি হক যদি নিরপেক্ষ থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, তাহলে বোধকরি আমাদের এই কুশপুত্তলিকা দাহ করার ছবি দেখতে হতো না। বাংলাদেশের ৪০ বছরের জীবনে এভাবে অতীতে কোন প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমি সাবেক প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে মেলাতে পারলাম না, দুঃখিত আমি। আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অনেকেই জীবিত আছেন এবং তারা সবার শ্রদ্ধাভাজন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান কিংবা বিচারপতি মোস্তফা কামাল আমাদের কাছে এক একজন আদর্শ। তারা যখন সমাজ, দেশ, জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন, লেখেন, আমি আগ্রহসহকারে তা পড়ি। বোঝার চেষ্টা করি তাদের মূল্যায়ন। তাদের মূল্যায়ন আমাকে সাহায্য করে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে, রাজনীতির গতিপথ কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে। কিন্তু আমি বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কাছ থেকে কী গ্রহণ করব? তিনি তো আমার আদর্শ হতে পারেন না। যার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, তিনি হাজার হাজার মানুষের হƒদয় ভেঙে দেন। তিনি এ দেশের অতি সাধারণ মানুষের আদর্শ হতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমান, কিংবা বিচারপতি মোস্তফা কামালÑ এরা আদর্শ। আমি আমার অনেক প্রবন্ধে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এমনকি বিচারপতি মোস্তফা কামালের উদ্ধৃতিও আমি দিয়েছি। কিন্তু বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কী দেব! যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেন না, সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কিভাবে?
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনীÑ সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। আমি সাধারণ শিক্ষক একজন। আমি ঝুঁকি নিতে পারি না। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কী সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের আদি মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু ইতিমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হল। আবার একই রায়ে বলা হল আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পরবিরোধী নয়। যদি বাতিল হয়, সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটো কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এ জন্য যে, বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন? সংবিধান তো তাই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ) এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান।
যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা তাকে তো অনেক দিয়েছেন। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। দু’দুবার অন্যকে ‘সুপারসিড’ করে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনা, বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাইমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলংক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারত। এক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিশ্বাস করেন, তারা তো ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজবেনই। আমি আরও খুশি হতাম বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগের দিন যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তখন যদি তিনি ঘোষণা করতেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না, তাহলে তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বলেছেন, ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে সবকিছু। এটা ‘ডিপ্লোমেটিক অ্যানসার’। জবাব এড়িয়ে যাওয়া। তার এ জবাবই বলে দেয় তার কিছুটা হলেও ওই পদটির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। এটা আমাকে অবাক করেছে। একজন বিচারপতি তো সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকেন। এই রাষ্ট্র তো বিচারপতি ও বিজ্ঞ খায়রুল হককে অনেক কিছু দিয়েছে। তিনি কোন দিনই প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন না। কিন্তু হয়েছেন। তাকে নিয়ে এত যখন বিতর্ক, তখন তার বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়া উচিত তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না। যেমনটি করেছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান।
আরও একটি বিষয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি কষ্ট পেয়েছি। তা হচ্ছে, তার স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে আইনজীবীদের এনরোলমেন্ট নিয়ে লাগামহীন অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি করেছেন। কতিপয় মুখচেনা আর রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে একই ঘরানার লোকদের এনরোলমেন্ট করে গেছেন তিনি। এর ফলে হাইকোর্ট বিভাগের অনেক যোগ্য আইনজীবীও আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বাদ পড়েছেন। এটা করা কি তার ঠিক হয়েছে? তিনি কেন রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না? এখন কেউ যদি তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়, তাহলে কি তিনি ভুল করবেন? বিচারপতিরা আমাদের নমস্য। তারা যদি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত কিংবা প্রভাবিত হন, তাহলে তা জাতির জন্য খারাপ। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সুন্দরবনে ‘প্রমোদ ভ্রমণে’ গিয়েছিলেন। তিনি সুন্দরবনে যেতেই পারেন। একজন নাগরিক হিসেবে এই অধিকার তার আছে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কিভাবে সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন, তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যুগান্তরের অপর একটি প্রতিবেদন। তিনি তো অতীতে অনেককে ‘শাস্তি’ দিয়েছেন। বিচারপতিদের হাত অনেক লম্বা। তারা যখন এজলাসে থাকেন, তখন কথা বলা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না, তাতে আদালত অবমাননা হয়। এখন তিনি অবসরে। এখন সাহস করে বলা যায়। সত্য উদ্ঘাটিত হোক। তিনি যদি অন্যায় করে থাকেন, তারও ‘বিচার’ হওয়া উচিত। তিনি যদি সত্যি সত্যিই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, প্রমোদ ভ্রমণের নামে সরকারি অর্থের অপচয় করে থাকেন, তাহলে দুদকের উচিত তাকে নোটিশ দেয়া। ব্যাখ্যা চাওয়া। অতীতে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে তো দুদক নোটিশ দিয়েছিল। কিংবা বিচারপতি খায়রুল হক নিজেও পারেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলোর একটা ব্যাখ্যা দিতে। না হলে প্রশ্ন থাকবেই। তারপরও আমি তাকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। কেননা তিনি আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি। সংবাদপত্রে যখন লিড স্টোরি ছাপা হয়Ñ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছেন খায়রুল হক (যুগান্তর, ১৮ মে), তখন তার প্রতি আস্থাটা কেন যেন আর থাকে না। আমার ধারণা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন, বিচারপতি হক নিজেকে বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যদি নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে প্রত্যাহার করে না নেন, তাহলে বিতর্ক বাড়বে। তিনি নিজে আরও বেশি বিতর্কিত হবেন। একসময় এমন সব ‘তথ্য’ বেরিয়ে আসবে, তাতে করে তিনি নিজে এবং সমগ্র জাতি আরও লজ্জিত হবে। তাকে উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তার সঙ্গে আমার আগামীতে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অনুরোধ করব, এ দেশের সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে থাকে, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত তারা। সুবিধাভোগীরা টাকার জোরে সব অন্যায়কে ‘জায়েজ’ করে নেয়। আপনি এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আপনাকে মানুষ মনে রাখবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে যদি আপনি দাঁড়ান, দুঃখী মানুষরা আপনাকে মনে রাখবে। মাওলানা ভাসানী কোনদিন ক্ষমতায় যাননি। ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিও তিনি করেননি। কিন্তু সাধারণ মানুষ, কৃষকদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। দ্বিতীয় আরেকজন মাওলানা ভাসানীর জš§ হয়নি আজও। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আপনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকুন, এটাই আমরা চাই। কেননা আপনি বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আর আমাদের ভরসার স্থান এখনও উচ্চ আদালত। ওই আদালত এবং আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেখতে চাই। ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিনের কী পরিণতি, আমরা সবাই তা জানি। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আমরা আপনাকে ওই কাতারে দেখতে চাই না।
আরও একটা কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার আমি পক্ষে। ভোলার উপনির্বাচন প্রমাণ করেছে আমরা এখনও দলীয় সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমাদের মানসিকতায় এখনও আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সংবিধানের ৫৮(খ) ও ৫৮(গ)-তে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই কমিটি এই কাজটি করতে পারে। বিশেষ করে ৫৮গ(৩), ৫৮গ(৪), ৫৮গ(৬) ধারায় পরিবর্তন এনে এখানে বিচারপতিদের পরিপূর্ণভাবে বাদ দেয়া যেতে পারে। একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে বাধ্যবাধকতা ও নীতি নির্ধারণী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। একজন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অনেক বিতর্কের জš§ দিয়ে গেছেন। আগামীতে আরও বিতর্ক হোকÑ এটা কারোই কাম্য নয়।
[ পূর্ব প্রকাশ @ দৈনিক যুগান্তর ২৮ মে ২০১১]
ছবিটি দেখে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আমি জানি না। কিন্তু আমি কষ্ট পেয়েছি। বিচারপতি হক যদি নিরপেক্ষ থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, তাহলে বোধকরি আমাদের এই কুশপুত্তলিকা দাহ করার ছবি দেখতে হতো না। বাংলাদেশের ৪০ বছরের জীবনে এভাবে অতীতে কোন প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমি সাবেক প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে মেলাতে পারলাম না, দুঃখিত আমি। আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অনেকেই জীবিত আছেন এবং তারা সবার শ্রদ্ধাভাজন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান কিংবা বিচারপতি মোস্তফা কামাল আমাদের কাছে এক একজন আদর্শ। তারা যখন সমাজ, দেশ, জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন, লেখেন, আমি আগ্রহসহকারে তা পড়ি। বোঝার চেষ্টা করি তাদের মূল্যায়ন। তাদের মূল্যায়ন আমাকে সাহায্য করে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে, রাজনীতির গতিপথ কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে। কিন্তু আমি বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কাছ থেকে কী গ্রহণ করব? তিনি তো আমার আদর্শ হতে পারেন না। যার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, তিনি হাজার হাজার মানুষের হƒদয় ভেঙে দেন। তিনি এ দেশের অতি সাধারণ মানুষের আদর্শ হতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমান, কিংবা বিচারপতি মোস্তফা কামালÑ এরা আদর্শ। আমি আমার অনেক প্রবন্ধে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এমনকি বিচারপতি মোস্তফা কামালের উদ্ধৃতিও আমি দিয়েছি। কিন্তু বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কী দেব! যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেন না, সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কিভাবে?
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনীÑ সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। আমি সাধারণ শিক্ষক একজন। আমি ঝুঁকি নিতে পারি না। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কী সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের আদি মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু ইতিমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হল। আবার একই রায়ে বলা হল আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পরবিরোধী নয়। যদি বাতিল হয়, সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটো কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এ জন্য যে, বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন? সংবিধান তো তাই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ) এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান।
যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা তাকে তো অনেক দিয়েছেন। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। দু’দুবার অন্যকে ‘সুপারসিড’ করে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনা, বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাইমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলংক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারত। এক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিশ্বাস করেন, তারা তো ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজবেনই। আমি আরও খুশি হতাম বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগের দিন যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তখন যদি তিনি ঘোষণা করতেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না, তাহলে তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বলেছেন, ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে সবকিছু। এটা ‘ডিপ্লোমেটিক অ্যানসার’। জবাব এড়িয়ে যাওয়া। তার এ জবাবই বলে দেয় তার কিছুটা হলেও ওই পদটির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। এটা আমাকে অবাক করেছে। একজন বিচারপতি তো সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকেন। এই রাষ্ট্র তো বিচারপতি ও বিজ্ঞ খায়রুল হককে অনেক কিছু দিয়েছে। তিনি কোন দিনই প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন না। কিন্তু হয়েছেন। তাকে নিয়ে এত যখন বিতর্ক, তখন তার বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়া উচিত তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না। যেমনটি করেছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান।
আরও একটি বিষয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি কষ্ট পেয়েছি। তা হচ্ছে, তার স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে আইনজীবীদের এনরোলমেন্ট নিয়ে লাগামহীন অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি করেছেন। কতিপয় মুখচেনা আর রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে একই ঘরানার লোকদের এনরোলমেন্ট করে গেছেন তিনি। এর ফলে হাইকোর্ট বিভাগের অনেক যোগ্য আইনজীবীও আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বাদ পড়েছেন। এটা করা কি তার ঠিক হয়েছে? তিনি কেন রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না? এখন কেউ যদি তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়, তাহলে কি তিনি ভুল করবেন? বিচারপতিরা আমাদের নমস্য। তারা যদি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত কিংবা প্রভাবিত হন, তাহলে তা জাতির জন্য খারাপ। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সুন্দরবনে ‘প্রমোদ ভ্রমণে’ গিয়েছিলেন। তিনি সুন্দরবনে যেতেই পারেন। একজন নাগরিক হিসেবে এই অধিকার তার আছে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কিভাবে সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন, তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যুগান্তরের অপর একটি প্রতিবেদন। তিনি তো অতীতে অনেককে ‘শাস্তি’ দিয়েছেন। বিচারপতিদের হাত অনেক লম্বা। তারা যখন এজলাসে থাকেন, তখন কথা বলা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না, তাতে আদালত অবমাননা হয়। এখন তিনি অবসরে। এখন সাহস করে বলা যায়। সত্য উদ্ঘাটিত হোক। তিনি যদি অন্যায় করে থাকেন, তারও ‘বিচার’ হওয়া উচিত। তিনি যদি সত্যি সত্যিই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, প্রমোদ ভ্রমণের নামে সরকারি অর্থের অপচয় করে থাকেন, তাহলে দুদকের উচিত তাকে নোটিশ দেয়া। ব্যাখ্যা চাওয়া। অতীতে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে তো দুদক নোটিশ দিয়েছিল। কিংবা বিচারপতি খায়রুল হক নিজেও পারেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলোর একটা ব্যাখ্যা দিতে। না হলে প্রশ্ন থাকবেই। তারপরও আমি তাকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। কেননা তিনি আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি। সংবাদপত্রে যখন লিড স্টোরি ছাপা হয়Ñ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছেন খায়রুল হক (যুগান্তর, ১৮ মে), তখন তার প্রতি আস্থাটা কেন যেন আর থাকে না। আমার ধারণা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন, বিচারপতি হক নিজেকে বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যদি নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে প্রত্যাহার করে না নেন, তাহলে বিতর্ক বাড়বে। তিনি নিজে আরও বেশি বিতর্কিত হবেন। একসময় এমন সব ‘তথ্য’ বেরিয়ে আসবে, তাতে করে তিনি নিজে এবং সমগ্র জাতি আরও লজ্জিত হবে। তাকে উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তার সঙ্গে আমার আগামীতে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অনুরোধ করব, এ দেশের সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে থাকে, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত তারা। সুবিধাভোগীরা টাকার জোরে সব অন্যায়কে ‘জায়েজ’ করে নেয়। আপনি এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আপনাকে মানুষ মনে রাখবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে যদি আপনি দাঁড়ান, দুঃখী মানুষরা আপনাকে মনে রাখবে। মাওলানা ভাসানী কোনদিন ক্ষমতায় যাননি। ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিও তিনি করেননি। কিন্তু সাধারণ মানুষ, কৃষকদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। দ্বিতীয় আরেকজন মাওলানা ভাসানীর জš§ হয়নি আজও। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আপনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকুন, এটাই আমরা চাই। কেননা আপনি বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আর আমাদের ভরসার স্থান এখনও উচ্চ আদালত। ওই আদালত এবং আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেখতে চাই। ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিনের কী পরিণতি, আমরা সবাই তা জানি। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আমরা আপনাকে ওই কাতারে দেখতে চাই না।
আরও একটা কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার আমি পক্ষে। ভোলার উপনির্বাচন প্রমাণ করেছে আমরা এখনও দলীয় সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমাদের মানসিকতায় এখনও আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সংবিধানের ৫৮(খ) ও ৫৮(গ)-তে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই কমিটি এই কাজটি করতে পারে। বিশেষ করে ৫৮গ(৩), ৫৮গ(৪), ৫৮গ(৬) ধারায় পরিবর্তন এনে এখানে বিচারপতিদের পরিপূর্ণভাবে বাদ দেয়া যেতে পারে। একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে বাধ্যবাধকতা ও নীতি নির্ধারণী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। একজন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অনেক বিতর্কের জš§ দিয়ে গেছেন। আগামীতে আরও বিতর্ক হোকÑ এটা কারোই কাম্য নয়।
[ পূর্ব প্রকাশ @ দৈনিক যুগান্তর ২৮ মে ২০১১]
0 comments:
Post a Comment