মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কর্তৃক পরিচালিত Navy Seal team six এর হাতে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর নানা প্রশ্নের এখন জন্ম হয়েছে। লাদেনের মৃত্যু নিঃসন্দেহে মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অবস্থান মার্কিন রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়েছে আগামি বছর, অর্থাত্ ২০১২ সালে সেখানে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাতে বারাক ওবামাকে একটু এগিয়ে রাখলো। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, তার কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র কী এই ‘যুদ্ধ’ এর অবসানের কথা ঘোষণা করবে? মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনের কথায় কিন্তু তা মনে হয় না। অন্যদিকে আল কায়দার সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ ক’টি সংস্থা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে মনে করা স্বাভাবিক যে ব্যক্তি ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু হয়েছে সত্য, কিন্তু যে সন্ত্রাসী সংগঠন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তিনি শুরু করেছিলেন, তা শেষ হবার নয়। আল কায়দা ইতোমধ্যেই প্রতিশোধের কথা বলেছে।
সবচেয়ে যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে বেশি করে, তা হচ্ছে গত ১০ বছর ধরে যে লোকটিকে সারা বিশ্ব খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তাকে কিনা পাওয়া গেল পাকিস্তানে? তাহলে কী পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার আশ্রয়ে ছিলেন লাদেন? বিষয়টি এখন নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অ্যাবোটাবাদে যে বাড়িতে লাদেন থাকতেন, ওই শহরটি ছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের স্থায়ী ঠিকানা। ওই শহরেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। যেখানে সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, সেখানে আশেপাশে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকান্ড থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে লাদেনের মতো ‘মোস্ট ওয়ানটেড পারসন’ যার মাথার মূল্য ধরা হয়েছিল আড়াই কোটি ডলার, তার খবর পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের হাতে থাকবে না কেন। বাড়িটি কার, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। নিশ্চই লাদেন এ বাড়িটি নিজে তৈরি করেননি? তিন তলার এই বাড়িটির মূল্য ধরা হয়েছে - বাংলাদেশী টাকায় ৭ কোটি টাকার ওপরে। যারা বাড়িটির ছবি দেখেছেন (যা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে), তারা দেখেছেন বাড়িটি কত সুন্দর। পেছনে পাহাড়। ছিমছাম একটা বাড়ি। অবসর জীবনের জন্য চমত্কার। কে তাকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল? আঙ্গুল যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) দিকে নির্দেশ করে আছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অনেকদিন থেকেই বলা হচ্ছে যে আইএসআই লাদেনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। এতদিন ধরে ধারণা ছিল যে লাদেন পাকিস্তানের FATA (Federal Administrative Tribal Area) অঞ্চলের কোন পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে আছেন। কিন্তু এটা এখন মিথ্যা প্রমাণিত হলো। অ্যাবোটাবাদের মত ছোট্ট একটি শহরে একটি বাড়িতে তিনি থাকলেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এটা জানবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে এখানে আরো একটি প্রশ্ন উঠেছে। খোদ আইএসআই কী শেষ পর্যন্ত লাদেনের খবর, জানিয়ে দিয়েছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে? পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন গেল ১১ এপ্রিল ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন আইএসআই প্রধান জেনারেল আহমেদ সুজা পাশা। জেনারেল পাশা সিআইএ প্রধান লিওন পেনেটার সাথে গোপন বৈঠকে মিলিতও হয়েছিলেন। তাদের মাঝে কী ধরনের আলোচনা হয়েছে, তার বিবরণ মিডিয়ায় জানান হয়নি। হতে পারে কোন ‘বড় ধরনের প্রাপ্তির’ আশায় আইএসআই লাদেনের খোঁজটি জানিয়ে দিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে। যদিও আইএসআই অঙ্গীকার করেছে যে তারা লাদেনের আস্তানার ঠিকানা জানতো। কিন্তু এই বক্তব্য কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তানের ভাবমূর্তি আজ বিশ্বে যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের ‘প্রমোট’ করছে। লাদেনের ঘটনায় এটা প্রমাণিত হলো। ভারত এখন দাবি করছে যে, ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতারা পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে। ভারত তাদের গ্রেফতার ও ভারতের কাছে হস্তান্তরের দাবি করেছে। বিশ্ব আসরে ভারতের এ দাবি আরো শক্তিশালী হবে এখন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে এখন বিশ্বব্যাপী ভিন্ন চোখে দেখা হবে। আগামিতে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা যদি ইউরোপ তথা আমেরিকায় নিষিদ্ধ হন আমি অবাক হবো না। প্রধানমন্ত্রী গিলানীর সরকারের জন্যও এটা খারাপ সংবাদ। দুটো কারণে গিলানী সরকারকে এখন ‘কঠিন পরীক্ষার’ মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, বিরোধী দল এটাকে ইস্যু করবে এবং সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবে। নেওয়াজ শরীফ এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয়ত, মার্কিন ৪টি হেলিকপ্টার তার টার্গেট এ (Geronimo- লাদেনের কোড-নাম) যখন হামলা করলো, তখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। এটা স্পষ্টতই পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এই অভিযোগটি তুলেছেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো এটাকেও ইস্যু করতে পারে। এমনিতেই সরকারের অবস্থান বেশ নড়বড়ে। চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ যাবত্ প্রায় ২০০ ড্রোন হামলা পাকিস্তানের ভেতরে পরিচালিত হয়েছে। বলা হয়েছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই বিমান হামলা হচ্ছে। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে -এইসব হামলায় পাকিস্তানি নাগরিকরা মারা যাচ্ছেন। এটা তো একটি স্বাধীন দেশে সার্বভৌমত্ব লংঘন করার শামিল। পাক সরকার এর বিরুদ্ধে কোন সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা ঠেকাতে। সরকারের জন্য এটা ভালো নয়। আরো একটি বিষয়, যা নিয়ে আমি চিন্তিত, তাহচ্ছে পাকিস্তান কী শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। লাদেনের মৃত্যুর খবর জানাজানি হবার পর লাহোরে বড় ধরনের জানাজা হয়েছে। লস্করই তালিবান নেতা হাফিজ মোহম্মদ সাঈদ এই জানাজা পরিচালনা করেন। সেখান থেকে প্রতিশোধের কথা উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিশোধের কথা বলেছে তেহরিক ই তালিবান নামে আরেকটি সংগঠন। কোয়েটায় লাদেনের সমর্থনে মিছিল বের হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার পাকিস্তানে এই জঙ্গীবাদী মনোভাব আরো শক্তিশালী হলো। এরা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। ধীরে-ধীরে পাকিস্তানে সনাতন রাজনীতির ‘মৃত্যু’ ঘটতে পারে এবং মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা পাকিস্তানে আরো শক্তিশালী হতে পারে। ফলশ্রুতিতে FATA অঞ্চল এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, অথবা আফগানিস্তানের সাথে মিশে গিয়ে বৃহত্তর একটি ‘পাখতুনিস্তান’ গঠন করতে পারে। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ আর লাহোর শহর কেন্দ্রিক ছোট্ট এক পাকিস্তান তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সামরিক নেতৃত্ব আজ কতটুকু বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন, সেটাই দেখার বিষয় এখন। সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তান আজ বড় ধরনের এক সঙ্কটের মুখোমুখি।
লাদেনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সাথে মৃত্যু হয়েছে একটি অধ্যায়ের। ওসামা বিন লাদেন তাকে ঘিরে একটি মিথ তৈরি করেছিলেন। তবে অনেক প্রশ্নেরই কোন জবাব হয়ত কোনদিনই পাওয়া যাবে না। এবং বিশ্ববাসী হয়ত কোনদিনই জানবে না কে বা কারা লাদেনকে কেন এবং কোন কাজে তৈরি করেছিল। যে ব্যক্তি সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যার সুপরিকল্পিত পরিকল্পনায় ৯/১১ এর জন্ম হয়েছিল, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে কোন ইন্টারনেট বা টেলিফোন ছাড়া অ্যাবোটাবাদে একাকী থাকতেন, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? যিনি শত শত ‘যোদ্ধ’ তৈরি করেছে যারা তার একটি মাত্র নির্দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে পারে, নেতা হিসেবে লাদেনের তো তাদের সাথেই থাকার কথা? ‘ইসলামের শত্রুদের’ বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ করার কথা, যেমনি করেছিলেন তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় লাদেন বাস করলেন স্ত্রী ও সন্তানসহ কোন ধরনের শংকা, উত্কণ্ঠা ছাড়া? এটা কী নতুন করে কোন প্রশ্নের জন্ম দেবে না? নাকি ওসামা বিন লাদেন আল কায়দার কর্মকাণ্ডে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন? এসব প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। ভবিষ্যত্ই আমাদের এসব প্রশ্নের জবাব দেবে।
লাদেনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নতুন একটি ‘অধ্যায়ের’ সূচনা হলো। এই ‘মৃত্যু’ মুসলিম বিশ্বে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটাও লক্ষ্য রাখার বিষয়। তবে ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব আজ অনেক বেশি মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইমেজ’ বৃদ্ধি করা। প্রেসিডেন্ট ওবামার ‘কায়ারো ভাষণ’ একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে কম। বেশ কিছু মুসলিম দেশে আল কায়দার মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি জঙ্গী সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান ও সোমালিয়ায় এদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব অনেক বেশি। সোমালিয়ায় ইসলামিক জঙ্গীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। আল সাদার্ব নামের সংগঠনটি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইসলামিক শারিয়া’ আইন চালু করেছে। আলজেরিয়াতে জন্ম হয়েছিল Al-Qaeda in the Islamic Maghreb (AQIM) ও Salabist Group for Preaching and Combat। এরা আত্মঘাতী বোমবাজি ও বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল। AQIM পুরো মাগবোর অঞ্চলে তত্পর। এখন ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে এসব জঙ্গীদের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের ব্যাপারে জঙ্গীদের সাথে ‘সংলাপ’ শুরু করাও জরুরি। ওসামা বিন লাদেনের পর এখন মার্কিনীদের টার্গেট মোল্লাহ ওমর। দীর্ঘ ১০ বছরেও মোল্লাহ ওমরের অস্তিত্ব আফগানিস্তানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূলধারার তালেবানদের সাথে যদি ‘সংলাপ’ শুরু করা না যায়, তাহলে আফগান সমস্যার সমাধান হবে না। যদিও ‘আল-কায়দা’ ও তালেবান আন্দোলন এক নয়। এদের মাঝে মতপার্থক্যও আছে। আল-কায়দা যেখানে বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল, সেখানে তালেবানরা শুধুমাত্র আফগানিস্তানেই ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ওবামার জন্য আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারও জরুরি। প্রেসিডেন্ট ওবামার দায়িত্ব আরো বাড়লো। আরব সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ কার্ল ভিনসন থেকে লাদেনের মৃতদেহ সামাহিত করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জন করতে হলে উদ্যোগী হতে হবে ওবামাকেই। লাদেনের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে এ সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে গেল মাত্র।
[ দৈনিক ইত্তেফাক ]
0 comments:
Post a Comment