রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাহাড়ে অসন্তোষ কার স্বার্থে

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। গত ২১ মে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার দুর্গম মিতিঙ্গাছড়ি এলাকায় পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের চারজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মাঝে একজন হচ্ছেন অনিমেষ চাকমা, যিনি ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতা। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইউপিডিএফের ডাকে গত ২৩ মে রাঙ্গামাটিতে পূর্ণদিবস সড়ক ও নৌ অবরোধ পালিত হয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সোবহান বিবিসি’র বাংলা বিভাগকে জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হচ্ছে। যদিও এটা নিশ্চিত নয় যে সরকার এ ব্যাপারে নীতিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা। আমি ধরে নিচ্ছি, প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলা স্বরাষ্ট্র সচিব যখন এ ধরনের একটি বক্তব্য দেন, তখন এর পেছনে সত্যতা আছে। সরকার জনস্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য শুধুই কি ইউপিডিএফ দায়ী? জনসংহতি সমিতি কি দায়ী নয়? জনসংহতি সমিতির ক্যাডাররা তো হত্যা করেছে ইউপিডিএফের নেতা ও কর্মীদের। একই অপরাধে তো দুটো সংগঠনই সমানভাবে দায়ী। নিষিদ্ধ করলে তো দুটো সংগঠনকেই নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আসলে পাহাড়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই এই হত্যাকাণ্ড। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড এই প্রথম নয়। অতীতেও বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করেছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা, যাদের বেশিরভাগই জনসংহতি সমিতির সঙ্গে জড়িত।

পাহাড়ে সন্ত্রাস এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল পাহাড়ে শান্তি আসবে বলে। কিন্তু সেই শান্তি এখনও আসেনি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকবে। অর্থাত্ যে যেখানে আছে, সে সেখানে থাকবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমরা লক্ষ্য করলাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার পর পাহাড়িদের নেতা হিসেবে দাবিদার সন্তু লারমা একের পর এক যে বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন, তাতে তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বারবার ফুটে উঠেছিল। তিনি একাধিকবার বাঙালিদের ওখান থেকে প্রত্যাহার করার দাবি করে আসছিলেন। এমনকি এক পর্যায়ে দাতা সংস্থা বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সন্তু বাবুর এই বক্তব্যকে পরোক্ষভাবে সমর্থনও করে। সন্তু বাবুর এ ধরনের বক্তব্য তাকে শুধু বিতর্কিতই করেনি, বরং তার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, সন্তু লারমা এ ধরনের বক্তব্য রাখার কোনো অধিকার রাখেন না। কেননা তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেনি। তিনি চাকমাদেরও এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন না। ইউপিডিএফও পাহাড়ি তথা চাকমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয়ত, চাকমাদের মতো বাঙালিরাও সেখানকার ‘সেটলার’। বিরান পাহাড়ি ভূমিতে প্রথমে চাকমা তথা অন্য পাহাড়িরা বসবাস করতে শুরু করে। প্রায় একই সময় বাঙালিরাও সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। তবে নিঃসন্দেহে তারা সংখ্যায় কম ছিল। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা কিংবা লুসাই জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ নয়। বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠী হচ্ছে সাঁওতাল ও খাসিয়ারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্তিক বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি উপজাতির মাত্র ৬ লাখ মানুষ ‘আদিবাসী’ দাবি করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে না।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশক’টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তাতেও মন গলেনি সন্তু বাবুর। এরপরও তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। তাদের কর্মযোগ্যতা, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অথচ সেই সেনাবাহিনীকে বারবার বিতর্কিত করছেন সন্তু বাবু। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা নিজেদের উত্সর্গ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। কিছু কিছু এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার ফলে ওইসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বরকলের ঘটনা এর বড় প্রমাণ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বরকলের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র আছে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় অভিযোগ করা হয়েছিল, জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র ক্যাডাররা সব অস্ত্র জমা দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে ওই অভিযোগের পেছনে সত্যতা ছিল। শান্তিচুক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এর একটা ভালো দিক হচ্ছে, ভারতে আশ্রিত চাকমারা তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে এসেছেন। সরকার তাদের এককালীন টাকা দিয়ে পুনর্বাসিত করেছে। কিন্তু আমরা কখনও চাইব না পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। পূর্ব তিমুর ছিল এক সময় ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ, একটি প্রদেশ। কিন্তু খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমরুকে পশ্চিমা বিশ্ব স্বাধীন করেছিল তাদের স্বার্থে। পূর্ব তিমুর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৯ সালে। আর দক্ষিণ সুদান, যেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে অতি সম্প্রতি গণভোটের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আগে দক্ষিণ সুদান ছিল সুদানের একটি অংশ। পূর্ব তিমুরের মতো দক্ষিণ সুদানে তেল পাওয়া গেছে। পশ্চিমাদের স্বার্থ এখানে অনেক। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের শঙ্কাটা তাই অনেক বেশি। আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সপ্তম সভায়ও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে (আমার দেশ, ১০ এপ্রিল, ২০১১)। সেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ঘন ঘন সফর, ইউএনডিপির কর্মকাণ্ড ইত্যাদি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

যারা দেশ, জাতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবেন, তাদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পার্বত্য সাধারণ উপজাতীয়রা গভীর জঙ্গলে বসবাস করে। তারা ছোটখাটো দোকান কিংবা জুম চাষ করে, কৃষিপণ্য বিক্রি করে অতি কষ্টে দিন যাপন করে। মিশনারিরা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এদের ধর্মান্তরিত করছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কী হারে উপজাতীয়রা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, তা একটা পরিসংখ্যান নিলেই জানা যাবে। উপজাতীয়দের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। শুধু তাই নয়, ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রজেক্টে পাহাড়ি ধর্মান্তরিত লোকদের চাকরি দেয়া হচ্ছে। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সেখানে চাকরি পাচ্ছে না। বাঙালিদের সঙ্গে সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। পাহাড়ি অঞ্চলে একজন উপজাতীয় ড্রাইভার যে বেতন পান, অনেক বাঙালি কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও সেই বেতন পান না। পাহাড়ে স্পষ্টতই একটি বিভাজন তৈরি করা হয়েছে, যা সংবিধানের ১৯ নং (সুযোগের সমতা), ২৭ নং (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ২৮ নং (ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কিন্তু দুঃখ লাগে, তথাকথিত সুশীল সমাজ কোনোদিনও এ প্রশ্নে মুখ খোলেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তারা মানববন্ধন করলেও, ওখানে বসবাসকারী বাঙালিরা যে ষড়যন্ত্র ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, সে ব্যাপারে একবারও তারা কথা বলেননি। বিদেশিরা পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছিল। স্থানীয় লোকদের ব্যাপক ধর্মান্তরিত করে তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধন করেছিল। আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়েও ওই একই ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ ব্যাপারে সোচ্চার ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

আজ বরকলের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পাহাড়ে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। পাহাড়ে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড সেখানে বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পগুলোতে ফের সেনাক্যাম্প স্থাপন করা দরকার। ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করাও ঠিক হবে না। কেননা সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনটি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচালনা করার অধিকার রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়াও জরুরি। নির্বাচন না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা সুযোগ পাচ্ছে। আরও একটা কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো ধরনের নির্বাচন কিংবা দায়বদ্ধতা ছাড়াই সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটা অবৈধ ও অশোভন। একটানা দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর এ দেশের রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। সন্তু বাবু থাকছেন কোন আইন বলে? আমরা বরকলের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। সরকার দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে—এটাই প্রত্যাশা করি।

0 comments:

Post a Comment