রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের কেন পরাজয়

শেষ পর্যন্ত যা আশা করা হয়েছিল, তাই হয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বিধান সভার নির্বাচনে সিপিএম-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের পরাজয় ঘটেছে। আর দীর্ঘ ১২ বছর এককভাবে যিনি বামফ্রন্টের ক্ষমতা থেকে সরানোর আন্দোলন করে আসছিলেন, সেই মমতা ব্যানার্জি এখন হতে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের নয়া মুখ্যমন্ত্রী। ইতোমধ্যে গত শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পদত্যাগ করেছেন। বিধান সভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের আসন সংখ্যা ২৯৪। এর মধ্যে ২১৮ আসন পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট। এই জোটে কংগ্রেসও রয়েছে। অন্যদিকে বামফ্রন্ট পেয়েছে ৬৯ আসন। এখানে বলা ভালো, ১৯৭৭ সাল থেকেই বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল। তারা পরপর আটবার বিধান সভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু এবার বিধি বাম। এবারে তাদের হেরে যেতে হল।
বামফ্রন্টের এই পরাজয়ে তেমন অবাক হননি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পরিস্থিতি এবার ছিল বামফ্রন্টের প্রতিকূলে। সংবাদপত্রগুলো সেখানে আভাস দিয়ে আসছিল যে, পরিবর্তন আসছে। যদিও ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট তথা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে এটা ছিল এক ধরনের প্রপাগান্ডা। তিনি বারবার বলে আসছিলেন পত্রিকাগুলো ভুল তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু ১৩ মে যখন ফলাফল ঘোষণা করা হল, তখন দেখা গেল সংবাদপত্রগুলোর ভবিষ্যত্ই সত্য বলে প্রমাণিত হল। বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারালো। প্রশ্ন হল, বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারালো কেন? প্রথমেই যে কথাটি বলা যায়, তা হচ্ছে সিঙ্গুর ও বন্দীগ্রামের ঘটনা। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। বামফ্রন্ট সেখানে গাড়ী তৈরীর কারখানা করতে চেয়েছিল। টাটাকে ওই জমি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ওই এলাকার কৃষকরা এর বিরুদ্ধে ছিল। তারা চায়নি তাদের বাপ-দাদার ভিটেতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। সিপিএম সাধারণ মানুষদের নিয়ে রাজনীতির কথা বললেও ওই গ্রামের সাধারণ মানুষের দাবির প্রতি এতটুকু সমবেদনা পর্যন্ত দেখায়নি। এমনকি কোন সহানুভূতিও ছিল না। সেদিন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নন্দীগ্রাম তথা সিঙ্গুরের গ্রামবাসীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
তিনি সরকারের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি অনশন পর্যন্ত করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তার একটি ইমেজ গড়ে ওঠে সারা পশ্চিমবঙ্গে। দ্বিতীয় আরো একটি বিষয়, তা হচ্ছে সিপিএম কর্মীদের সন্ত্রাস। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রগুলো যারা নিয়মিত পাঠ করেন, তারা জানেন ও পত্রিকায় পড়েছেন যে, বিভিন্ন স্থানে সিপিএম-এর ক্যাডাররা একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি করে কৃষকদের হত্যা করেছিল। অভিযুক্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বামফ্রন্ট। ঠিক তেমনি সিপিএম-এর ক্যাডাররা যখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হত, তখন প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিত না। মমতা ব্যার্নাজি এককভাবে এইসব  ‘বাম সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। যা কি না তার ইমেজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। এসব কিছুই নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, জ্যোতি বসুর মত একজন  ক্যারিসমেটিক নেতার অভাব ছিল সিপিএম-এ। ২০০০ সালের নভেম্বরে ৮৭ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন জ্যোতি বসু। তিনি ছিলেন দলের জন্য অবিসংবাদিত এক নেতা। তার দক্ষ নেতৃত্বে বামফ্রন্ট বারবার বিধান সভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। তার পদত্যাগের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। গেল বিধান সভার নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছিল সত্য, কিন্তু তখন জ্যোতি বসুর মৃত্যুতে তার দল সমবেদনা ভোট পেয়েছিল। সেদিনও মমতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিন্তু তিনি পারেননি। এবার পারলেন। তবে মানতেই হবে ধনুক ভাঙ্গা পণ করেছিলেন মমতা, যেভাবেই হোক বামফ্রন্টকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে হটাতে হবে। তাই হল। বামফ্রন্ট এবার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। একটা দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে, তখন দলের মাঝে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, সুবিধাভোগিতা বৃদ্ধি পায়। দলের  নেতৃত্ব দলের স্বার্থে এসব উপেক্ষা করে। না হলে বাম আদর্শে বিশ্বাসী সিপিএম-এর কর্মীরা গুণ্ডাবাজি করবে, দুর্নীতি করবে, এটা বিশ্বাস করা যায় না।  বাস্তবতা হচ্ছে, সিপিএম -এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। জনসমর্থন তারা হারিয়েছেন এ কারণেই। তবে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে তথা ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে সিপিএম একটি শক্তি, এটা অস্বীকার করা যাবে না। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যখন সাবেক সোভিয়েট  ইউনিয়ন ও চীনা রাজনীতি নির্ভর হয়ে উঠেছিল, তখন সিপিআই (এম) এই দুই শিবিরের বাইরে তৃতীয় একটি বাম ধারার সূচনা করেছিল। মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়েও সিপিআই (এম) সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এবং পশ্চিমবঙ্গসহ কেরালা ও ত্রিপুরায় সরকার গঠনও  করেছেন। সিপিআই (এম)-এর রাজনীতির সাথে ইউরো কমিউনিজম-এর তুলনা করা যায়। মধ্য সত্তুরের দশকে পশ্চিম ইউরোপের তিনটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি (স্পেন, ইটালি ও ফ্রান্স) এই ইউরো কমিউনিজম-এর রাজনীতি শুরু করেছিল, সেখানে তারা সংসদীয় রাজনীতি শুরু করেছিল। বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটলেও, সিপিআই(এম) সমাজতন্ত্রকে এখনও আদর্শ হিসেবে ধরে রেখেছে। তবে নিঃসন্দেহে তাদের রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম ভারতের বাইরে তাসখন্দে। ওই সিপিআই থেকে একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে ১৯৬৪ সালে গঠন করেছিল সিপিআই(এম)। পরবর্তীতে সিপিআই(এম) থেকে একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে ১৯৬৯-৭০ সালে গঠন করেছিল সিপিআই (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট), যারা নক্সালবাড়ী আন্দোলনের সূচনা করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। ওই সময় সিপিআই ও সিপিআই(এম) অন্য কয়েকটি বাম সংগঠনকে নিয়ে গঠন করেছিল যুক্তফ্রন্ট। তারা ১৯৬৭ সালের বিধান সভার নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু তা সুখের হয়নি। ভারতীয় কংগ্রেস সত্তরের দশকের শুরুতে ‘নয়া রাজনীতি’ শুরু করলে সিপিআই কংগ্রেসের ওই রাজনীতিকে সমর্থন করেছিল। এমনকি ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন, তখন সিপিআই ওই জরুরী অবস্থার ঘোষণাকে সমর্থন করেছিল। ১৯৭৭-৭৮ সালে ভারতব্যাপী লোকসভা ও বেশ ক’টি রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচনে কংগ্রেস-সিপিআই আঁঁতাতের ভরাডুবি ঘটে। অচিরেই সিপিআই নেতৃত্ব তাদের ভুল বুঝতে পারে। ১৯৭৭ সালের বিধান সভার নির্বাচন প্রথমবারের মত সিপিআই (এম) ১৭৭ আসনে বিজয়ী হলেও সেদিন সিপিআই(এম) এককভাবে সরকার গঠন করেনি। তারা একটি বামফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিল। সেই থেকে শুরু। ২০০১ সালের ১৮মে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেস এবার কংগ্রেসের সাথে ঐক্য করলেও, গেল বিধান সভার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি একাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জি বর্তমানে ভারতের রেলমন্ত্রী। তার দল তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রের কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক। এবারও একটা পর্যায়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল যে তৃণমূল এবারও এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে কীনা। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে কংগ্রেস- তৃণমূল ঐক্য টিকে যায়। তবে কোন কোন কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিদ্রোহী প্রার্থীরা এককভাবে নির্বাচন করেছেন। এবার কংগ্রেসকে দেয়া হয়েছে ৬৪ আসন, আর তৃণমূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ২২৮ আসনে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছেলেও এবার কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তিনি রাজ্যের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে আমি অবাক হব না।
মমতা বিজয়ী হয়েছেন। তিনি হবেন পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাংলাদেশ-ভারত সমস্যাগুলোর ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি অবগত আছেন বলা হয়ে থাকে। মমতা বাংলাদেশের সমস্যার ব্যাপারে কিছুটা দুর্বল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দ যারাই নয়াদিল্লি সফর করেছেন তারা মমতার সাথে দেখা করেছেন। তার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। এটা  অনেকটা রুটিনওয়ার্ক হয়ে গিয়েছিল। আজ মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশের জন্য কতটুকু কী করতে পারবেন, আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
রাজনীতির প্রতি অবিচল থেকে, সঠিক রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে গেলে লক্ষ্যে যে পৌঁছান যায়, মমতা ব্যানার্জি তার বড় প্রমাণ। তিনি কোনদিন ‘কমপ্রোমাইজ’ করেননি। রাজনীতির জন্য বিয়েও করেননি। এক সময় যুব কংগ্রেসের নেত্রী ছিলেন মমতা। কিন্তু মূল দল কংগ্রেসের সাথে তার বিরোধের সৃষ্টি হয়। আর সে কারণেই ১৯৯৭ সালে তিনি গঠন করেন তৃণমূল কংগ্রেস। তার সঠিক নেতৃত্বের কারণে তৃণমূল কংগ্রেস আজ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। কেন্দ্রে তারা অন্যতম শরিক। অত্যন্ত সাদাসিধে, চপ্পল পায়ে দেয়া একজন ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ মমতা ব্যানার্জি। তার এই সাদাসিধে জীবন যেন পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্রতারই প্রতীক। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার উপর অনেক দায়িত্ব আজ বর্তাবে। বেকার সমস্যার সমাধান, কৃষকদের সমস্যার সমাধান সেই সাথে শিল্পায়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে আজ তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোরও হতে হবে। এতে করে সাফল্য তিনি কতটুকু পাবেন, তা বিচার হবে আগামীতে। আমরা মমতা ব্যানার্জির বিজয়কে স্বাগত জানাই।
[পূর্বে প্রকাশ @ দৈনিক ইত্তেফাক ১৪.০৫.২০১১]

0 comments:

Post a Comment