রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন

বাপ্পির সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প দিনের। চমত্কার একটি ছেলে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অন্য হাজারটা তরুণের মতো চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছে না। উচ্চপর্যায়ের আত্মীয়-স্বজনও নেই বাপ্পির, যাকে ‘ধরে’ একটি চাকরি জোগানো সম্ভব। বাপ্পি তা করেনি। করার ইচ্ছেও নেই। বাপ্পি তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে ফ্রিল্যান্স আউটসোসিং করে সে প্রতিমাসে যা আয় করছে, তা অনেকের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। মাত্র ২৩ বছরের যুবক বাপ্পি তাই ‘চাকরি’ নিয়ে ভাবে না। ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংই তার ধ্যান-ধারণা। এটা নিয়েই সে আরো এগিয়ে যেতে চায়। বাংলদেশের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) একটি বিশাল সম্ভাবনার খাত। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলাম তথ্যপ্রযুক্তি আউটসোসিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম ৩০টি দেশের মধ্যে। বাংলাদেশে মোট ১৫০টি আউটসোর্সিং ফার্মে প্রায় ২৫ হাজার কর্মী কাজ করছে। এ খাতে এ যাবত্ বাংলাদেশের উপার্জিত আয় খুব আশাব্যঞ্জক না হলেও ভারত আউটসোর্সিং করে আয় করেছে প্রায় ৬ হাজার কোটি রুপি। অথচ এই সম্ভাবনাময় খাতটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেরক প্রতি বছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে, যাদের অনেকেই বেকার থাকছে। ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বেরুচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই ‘জব মার্কেটে’ ঢুকতে পরছে না। এর মাঝে আবার সরকার নতুন করে বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ৫৮টি আবেদনের মধ্যে ৪২টির যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ ন্যূনতম আরো অন্তত ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে কোন কোন বিষয় পড়ানো হবে? ইউজিসির চেয়ারম্যান সাহেব বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে উত্সাহী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাজারে এর কী চাহিদা রয়েছে? একজন ছাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সাহিত্যে অর্নাস করে কোথায় চাকরি পাবে? এ ব্যাপারে শিক্ষানীতিতে কোন দিকনিদের্শনা নেই। যারা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন, তাদেরও সুস্পষ্ট কোন চিন্তুা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। যে মুহূর্তে একটিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন নেই, সেখানে আরো ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। এখানে শুধু সার্টিফিকেট-বাণিজ্য হবে। আর এই সার্টিফিকেট-বাণিজ্য কেউ বন্ধ করতে পারবে না। অতীতেও আমরা পারিনি। এখন একজন বাপ্পি আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তির আরো সম্প্রসারণ দরকার। সাধারণ বিষয়ে ছাত্র সংখ্যা না বাড়িয়ে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে, সেখানে ছাত্র সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। তাহলে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা একটা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারবো, যারা হাজার হাজার ‘বাপ্পির মতো’ তরুণ তৈরি করবে, যারা আর বেকার থাকবে না, সরকারকেও এদের কর্মসংস্থানের জন্য চিন্তা করতে হবে না। পৃথিবীর কোন দেশেই সরকার সবাইকে চাকরি দিতে পারে না বা দেয় না। বেসরকারি খাত যেমনি রয়েছে, তেমনি এখন সৃষ্টি হয়েছে আউটসোর্সিং। বাপ্পির মতো তরুণরা নিজের বাসায় থেকেই এই কাজগুলো করতে পারে। তার অফিসে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। নির্ধারিত সময়ে অফিস করারও কোন প্রয়োজন নেই। শুধু প্রয়োজন যোগাযোগ ও নিজের যোগ্যতা বাড়ানো। এ খাতে বৈদেশিক আয়ের সম্ভাবনা প্রচুর। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এমনিতেই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। বর্তমানে দেশে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে হচ্ছে। আর মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ হচ্ছে বৈদেশিক উত্স থেকে, যা কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই বক্তব্যটি আমাদের অর্থমন্ত্রীর। অর্থমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের চিন্তায় ফেলে দেয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং। লিবিয়া তথা আরব বিশ্ব থেকে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সহজ কাজ নয়। সরকারের জন্য এটা একটা বাড়তি বোঝা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের জনশক্তি স্থানান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে। এরা রাজধানীতে এসে বস্তি তৈরি করছে। সৃষ্টি করছে নানা সমস্যা। পরিবেশ দুষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। খাদ্য নিরাপত্তা এখন ঝুঁকির মুখে। খাদ্য আমদানিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। এমনিতেই বিশ্ব নতুন করে এক ধরনের খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। এ কথা স্বীকার করেছেন সয়ং বিশ্ব ব্যাংকর প্রধান। তাই সংগত কারণেই বাংলাদেশের জন্য চিন্তাটা অনেক বেশি। দেশে খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে, এটা সত্য, কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্য, জনসংখ্যাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও খুব আশার কথা বলে না। পত্র-পত্রিকায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে যেসব খবরা খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা কোন আশার কথা বলে না। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি (যুগান্তর, ৬ এপ্রিল)। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এ অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতির এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের আশঙ্কা সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট, বিনিয়োগে বেহাল অবস্থা, প্রকট অবকাঠামো সমস্যা, নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দুর্নীতির উচ্চমাত্রা আর চাঁদাবাজির কারণে অধোগতিতে চলবে অর্থনীতির ধারা (ঐ)। অর্থনীতির এই অবস্থা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করতে পারে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে সরকার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মাঝে আছে। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সাথে তারা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছে। এই রিপোর্টটি আদৌ কোনদিন প্রকাশিত হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি রুলও ইস্যু হয়েছে। এই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে শেয়ারের সূচক যখন ৬০০ পয়েন্ট নিচে নেমে গিয়েছিল, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না যে একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র এর সাথে জড়িত। সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে? ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে শেয়ার মার্কেটে। এদের অসন্তোষ সরকারের জন্য কোন শুভ সংবাদ নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখনও শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি হয়েছিল। তখন তদন্ত কমিটি ৩৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। ২০১১ সালে এসে তদন্ত কমিটিও কিছু দোষী ব্যক্তিকে কারসাজির সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কী? না হলে অসন্তোষ বাড়বেই। উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। জাতীয় কমিটি বিএনপির সাথে কথা বলতে চাইলেও বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখানেও সেই ‘বিরোধ’ রয়ে গেল। সংবিধান একটি জাতির, এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। এখানে বিশেষ করে এ ধরনের জাতীয় প্রশ্নে সরকারের সাথে বিরোধী দলের ন্যূনতম ঐকমত্য প্রয়োজন। চল্লিশ বছরে পা দিয়েও আমাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করলো, জাতি হিসাবে আমরা আজো বিভক্ত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার যদি একক উদ্যোগে সংবিধান সংশোধন করে, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়াবে মাত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের জন্য একটি ‘গলার কাঁটা’। সারা বিশ্বব্যাপীই খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে। এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি অসাধু চক্র, যারা উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের (চাল, তেল, চিনি, আটা) মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘হুমকিও’ এখানে ব্যর্থ। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চমূল্য সরকারের জন্য বড় হুমকি। অর্থনীতির মন্দার কারণে কৃচ্ছ সাধন যেখানে জরুরি, সেখানে সরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। চাকরির ক্ষেত্রে (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও) ‘প্রায়োরিটি’ পাচ্ছে সরকারি দলের লোকেরা। পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন ঝুঁকির মুখে। বিদ্যুত্ যেখানে ‘প্রায়োরিটি’, সেখানে অনুত্পাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ একটি প্রকল্পে দেশ নিরক্ষরমুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগকে (কালের কণ্ঠ, ২১ এপ্রিল), যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আলোকে দেশে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।

বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক সুবিধাভোগিতা, রাজনৈতিকভাবে একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা আরব বিশ্বে ‘বিপ্লবের’ জন্ম দিয়েছে। ‘আরব বসন্ত’-এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। ‘আরব বসন্ত’ থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। আমরা এ থেকে আদৌ কোন শিক্ষা নেবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তবে এটা সত্য, আরব বিশ্বের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার সাথে আমাদের যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে। আমাদের এখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রয়েছে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে, যা আরব বিশ্বের কোথাও নেই। এদেশে একদলীয় শাসন কিংবা রাজতন্ত্রও নেই। তবে এদেশে অদক্ষ একটি তরুণ সমাজ আছে, যাদের মেধা আছে। এখন প্রয়োজন সেই মেধাকে ব্যবহার করা। এটা যে করা যাবে না, তা নয়। এটা করা যাবে। এর জন্য প্রয়োজন সুষুম পরিকল্পনা। প্রয়োজন দক্ষ লোকদের যোগ্য স্থানে বসানো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজার হাজার গ্র্যজুয়েট তৈরি করে, একটা ‘সংকট’ সৃষ্টি করছে। ‘জব মার্কেটে’ চাপ বাড়াচ্ছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষাখাতকে আমরা যদি সম্প্রসারণ করতে পারতাম, তাহলে হাজারটা ‘বাপ্পির, জন্ম হতো, যারা সরকারের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে শুধুমাত্র ‘আউটসোসিং’ করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারত। বিষয়গুলো তাই বিবেচনায় নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। 
[পূর্বে প্রকাশা @ দৈনিক ইত্তেফাক ১৯ মে ২০১১] 

0 comments:

Post a Comment