আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে লাদেন অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। লাদেন এখন মৃত, ইতিহাসের অংশ। এই লাদেন অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক করুণ ইতিহাস, অনেক মৃত্যু। তিনি ইসলাম ধর্মের নতুন এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার এই ব্যাখ্যা বিতর্কিত ছিল এবং সব মুসলিম বিশ্বের মানুষ তা গ্রহণ করে নিয়েছিল, তাও বলা যাবে না। কিন্তু এটা সত্য, তিনি মুসলিম বিশ্বের শত শত 'জিহাদি' তৈরি করেছিলেন, যারা ইসলামের নামে 'শহীদ' হতে প্রস্তুত ছিলেন। লাদেন ইসলামের আদি ধারায় ফিরে যেতে চেয়েছেন। ওয়াহাবি মতবাদে এই আদি ধারার কথা বলা হয়েছে। কেউ কেউ একে 'সালাফি' মতবাদ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। সৌদি রাজপরিবার এই ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী। ওয়াহাবি মতবাদের প্রবক্তা হচ্ছেন একজন সৌদি ইসলামিক প-িত মুহম্মদ বিন আবদ আল ওয়াহাব। তার জন্ম ১৭০৩ সালে। সৌদি রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌউদ একসময় ওই মতবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যা তারা আজো ধরে রেখেছেন। বলা হয় সৌদি আরব এই ওয়াহাবি মতবাদকে প্রমোট করছে। ওয়াহাবি মতবাদে জিহাদকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। ওয়াহাবি মতবাদিরা পীর ভক্তি, মাজার পূজা, মিলাদ, কবর জিয়ারত, শিরক ও বিদআতের ব্যাপারে বিশ্বাসী নন। লাদেন বিশ্বাস করতেন জিহাদের মাধ্যমে বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি ঘটেছে, সেখানে কোথাও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তার ঘটেনি। আমাদের এ অঞ্চলে হাজার বছর আগে ইসলাম প্রচারের জন্য যারা এসেছিলেন, তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের আশ্রয় নেননি। তারা শান্তির বাণী প্রচার করে গেছেন এবং এ দেশকে ভালোবেসে, এ দেশে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাদেন এ কোন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য নেমেছিলেন? শত শত তরুণ যুবককে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন 'জিহাদি' কর্মকা-ে অংশ নিতে। শত শত কোটি ডলারের মালিক ছিলেন ওসামা। এ অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। বিশাল এক নেটওয়ার্ক তিনি গড়ে তুলেছেন আরব বিশ্বে, ইরাক থেকে শুরু করে আলজিরিয়া। ইয়েমেনে রয়েছে-আল-কায়েদার শক্ত ঘাঁটি। এই আল-কায়েদা নামক সংগঠনটির জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর থেকেই বিন লাদেনের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরিণত হন 'বিশ্বের একনাম্বার সন্ত্রাসী হিসেবে। ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর তাঁকে পাওয়া গেল পাকিস্তানের এবোটাবাদ শহরে।
নিঃসন্দেহে লাদেন অপরাধ করেছেন। বিচারে তার ফাঁসি হতে পারতো_ সেটাই বরং স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল এখন। মৃত ওসামা বিন লাদেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল। লাদেনের জনপ্রিয়তা বাড়বে বৈ কমবে না এতে করে। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর জন্য কোনো ধরনের হুমকি কি না? মুসলমান বিশ্বে অসন্তোষ আছে। বিশ্বায়নের নামে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের আধিপত্যবাদ! এ ক্ষেত্রে ইসলামিক প-িতদের কারো কারো মতে (যেমন মিসরের ঝধুুরফ ছঁঃন) ওংষধস রং ঃযব ংড়ষঁঃরড়হ; ইসলামই সমাধানের পথ। বছরের পর বছর এখন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না, যখন ইসরাইলী কমান্ডোরা ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এবং তার বিচার হয় না, তখন লাদেনের মতো নেতারা জিহাদের ডাক দেয়। এই তথাকথিত 'জিহাদ' মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়নি এটা সত্য, কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়, তখন এক ধরনের ক্ষোভ ও ঘৃণা মুসলিম বিশ্বে জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রসন চালিয়েছিল এই যুক্তিতে যে লাদেনকে তালেবানরা আশ্রয় দিয়েছিল। সেই ২০০১ থেকে ২০১১ আফগানিস্তানে এখনো মার্কিন সৈন্য আছে। ওবামা শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তার হাতেও 'রক্ত' এখন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে সব মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এখন বলছেন সেই সময়সীমা ২০১৪। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের 'বড় স্বার্থ' রয়েছে আফগানিস্তানে। এখানে থাকতে হবে। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ, গ্যাস ও তেল। এখানে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অন্য কোনো শক্তি এই জ্বালানি সম্পদে ভাগ বসাবে (বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া), তা চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে বসেই মধ্য এশিয়ার 'জ্বালানি সম্পদ' নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তান এ 'ইসলামি জঙ্গিবাদ'-এর জন্ম হয়েছে। এই জঙ্গিবাদও মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি! 'ন্যাটোর এশীয়করণ' হবে এ অঞ্চলে ঘিরে। তাই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইরাকে বলা হয়েছিল ডগউ বা মরণাস্ত্র রয়েছে। বলা হয়েছিল এই মরণাস্ত্র এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই যুক্তি তুলে ২০০৩ সালে দেশটি দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। ডগউ পাওয়া যায়নি। কিন্তু সাদ্দামের ফাঁসি হয়েছে। ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরাকের তেল বিক্রি করে ইরাক পুনর্গঠনের কাজ করছে কিছু মার্কিন কোম্পানি। আজ ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ-এর নামে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের টার্গেট লিবিয়ার তেল। লিবিয়া হচ্ছে উত্তর আফ্রিকায় যাওয়ার 'গেটওয়ে'। লিবিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী আফ্রিকার দেশগুলো নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। অঋজওঈঙগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই।
ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসবাদ, তা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা ইসলাম নয়। কিন্তু এই সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আক্রমণ করা কিংবা তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করাও গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা জাতিসংঘ সনদ ৪.১ ও ৪.৪-এর পরিপন্থী, যেখানে 'সার্বভৌমত্ব' ও 'আঞ্চলিক অখ-তার' কথা বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই 'সন্ত্রাসী' কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। 'চৎববসঢ়ঃরাব ঝঃৎরশব' আগাম আক্রমণের যে ধারণা বুশ ব্যবহার করেছিলেন কিংবা এখন ওবামা ব্যবহার করলেন, তা বাহ্যত যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। ইতিহাসে আছে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে হেগের ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব নিকারাগুয়ায় 'অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ' করাও কন্ট্রা বিদ্রোহীদের (যারা ওই সময় নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল) সাহায্যের অপরাধে অভিমত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায়কে স্বীকার করে নেয়নি। অথচ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯৪-২ ভোটে আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল সেদিন।
লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন একটি 'অধ্যায়ের' সূচনা হলো। এই 'মৃত্যু' মুসলিম বিশ্বে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটাও লক্ষ্য রাখার বিষয়। তবে ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব আজ অনেক বেশি মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের 'ইমেজ' বৃদ্ধি করা। প্রেসিডেন্ট ওবামার 'কায়রো ভাষণ' একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে কম। বেশ কিছু মুসলিম দেশে আল-কায়েদার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান, ও সোমালিয়ায় এদের প্রভাব ও কর্তৃর্ত্ব অনেক বেশি। সোমালিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।' আল সাদার্ব নামের সংগঠনটি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইসলামিক শরিয়া আইন চালু করেছে। আলজেরিয়াতে জন্ম হয়েছিল অষ-ছঁধবফধ রহ ঃযব ওংষধসরপ গধমযৎবন (অছওগ), ও ঝধষধভরংঃ এৎড়ঁঢ় ভড়ৎ চৎবধপযরহম ধহফ পড়সনধঃ-এরা আত্মঘাতী বোমাবাজি ও বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল। অছওগ পুরো মাগরের অঞ্চলে তৎপর। এখন ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে এসব জঙ্গিকে মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের ব্যাপারে জঙ্গিদের সঙ্গে 'সংলাপ' শুরু করাও জরুরি। ওসামা বিন লাদেনের পর এখন মার্কিনিদের টার্গেট মোল্লাহ ওমর। দীর্ঘ ১০ বছরেও মোল্লাহ ওমরের অস্তিত্ব আফগানিস্তানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূল ধারার তালেবানদের সঙ্গে যদি 'সংলাপ শুরু করা না যায়, তাহলে আফগান সমস্যার সমধান হবে না। যদিও আল-কায়েদা ও তালেবান আন্দোলন এক নয়। এদের মাঝে মতপার্থক্যও আছে।
আল-কায়েদা যেখানে বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল, সেখানে তালেবানরা শুধু আফগানিস্তানেও ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ওবামার জন্য আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার জরুরি। প্রেসিডেন্ট ওবামার দায়িত্ব আরো বাড়ল। আরব সাগরে টহলরত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ কার্ল ভিনসন থেকে লাদেনের মৃতদেহ আরব সাগরে সমাহিত করে সমস্যার সমধান করা যাবে না। মুসলিম বিশ্বে আস্থা অর্জন করতে হলে উদ্যোগী হতে হবে ওবামাকেই। ওসামার মৃত্যুর মধ্যে এ সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে গেল মাত্র। লাদেনকে হত্যা করে ওবামা ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার 'বিজয়'কে নিশ্চিত করেছেন_ এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব, পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কেও এখন নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এই জটিলতা আঞ্চলিক উত্তেজনা যেমনি বাড়বে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়, তা হবে প্রধান অন্তরায়।[পূর্বে প্রকাশ @ যায়যায়দিন ১৪.০৫.২০১১]
ইসলাম শান্তির ধর্ম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি ঘটেছে, সেখানে কোথাও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তার ঘটেনি। আমাদের এ অঞ্চলে হাজার বছর আগে ইসলাম প্রচারের জন্য যারা এসেছিলেন, তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের আশ্রয় নেননি। তারা শান্তির বাণী প্রচার করে গেছেন এবং এ দেশকে ভালোবেসে, এ দেশে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাদেন এ কোন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য নেমেছিলেন? শত শত তরুণ যুবককে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন 'জিহাদি' কর্মকা-ে অংশ নিতে। শত শত কোটি ডলারের মালিক ছিলেন ওসামা। এ অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। বিশাল এক নেটওয়ার্ক তিনি গড়ে তুলেছেন আরব বিশ্বে, ইরাক থেকে শুরু করে আলজিরিয়া। ইয়েমেনে রয়েছে-আল-কায়েদার শক্ত ঘাঁটি। এই আল-কায়েদা নামক সংগঠনটির জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর থেকেই বিন লাদেনের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরিণত হন 'বিশ্বের একনাম্বার সন্ত্রাসী হিসেবে। ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর তাঁকে পাওয়া গেল পাকিস্তানের এবোটাবাদ শহরে।
নিঃসন্দেহে লাদেন অপরাধ করেছেন। বিচারে তার ফাঁসি হতে পারতো_ সেটাই বরং স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল এখন। মৃত ওসামা বিন লাদেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল। লাদেনের জনপ্রিয়তা বাড়বে বৈ কমবে না এতে করে। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর জন্য কোনো ধরনের হুমকি কি না? মুসলমান বিশ্বে অসন্তোষ আছে। বিশ্বায়নের নামে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের আধিপত্যবাদ! এ ক্ষেত্রে ইসলামিক প-িতদের কারো কারো মতে (যেমন মিসরের ঝধুুরফ ছঁঃন) ওংষধস রং ঃযব ংড়ষঁঃরড়হ; ইসলামই সমাধানের পথ। বছরের পর বছর এখন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না, যখন ইসরাইলী কমান্ডোরা ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এবং তার বিচার হয় না, তখন লাদেনের মতো নেতারা জিহাদের ডাক দেয়। এই তথাকথিত 'জিহাদ' মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়নি এটা সত্য, কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়, তখন এক ধরনের ক্ষোভ ও ঘৃণা মুসলিম বিশ্বে জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রসন চালিয়েছিল এই যুক্তিতে যে লাদেনকে তালেবানরা আশ্রয় দিয়েছিল। সেই ২০০১ থেকে ২০১১ আফগানিস্তানে এখনো মার্কিন সৈন্য আছে। ওবামা শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তার হাতেও 'রক্ত' এখন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে সব মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এখন বলছেন সেই সময়সীমা ২০১৪। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের 'বড় স্বার্থ' রয়েছে আফগানিস্তানে। এখানে থাকতে হবে। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ, গ্যাস ও তেল। এখানে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অন্য কোনো শক্তি এই জ্বালানি সম্পদে ভাগ বসাবে (বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া), তা চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে বসেই মধ্য এশিয়ার 'জ্বালানি সম্পদ' নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তান এ 'ইসলামি জঙ্গিবাদ'-এর জন্ম হয়েছে। এই জঙ্গিবাদও মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি! 'ন্যাটোর এশীয়করণ' হবে এ অঞ্চলে ঘিরে। তাই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইরাকে বলা হয়েছিল ডগউ বা মরণাস্ত্র রয়েছে। বলা হয়েছিল এই মরণাস্ত্র এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই যুক্তি তুলে ২০০৩ সালে দেশটি দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। ডগউ পাওয়া যায়নি। কিন্তু সাদ্দামের ফাঁসি হয়েছে। ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরাকের তেল বিক্রি করে ইরাক পুনর্গঠনের কাজ করছে কিছু মার্কিন কোম্পানি। আজ ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ-এর নামে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের টার্গেট লিবিয়ার তেল। লিবিয়া হচ্ছে উত্তর আফ্রিকায় যাওয়ার 'গেটওয়ে'। লিবিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী আফ্রিকার দেশগুলো নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। অঋজওঈঙগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই।
ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসবাদ, তা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা ইসলাম নয়। কিন্তু এই সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আক্রমণ করা কিংবা তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করাও গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা জাতিসংঘ সনদ ৪.১ ও ৪.৪-এর পরিপন্থী, যেখানে 'সার্বভৌমত্ব' ও 'আঞ্চলিক অখ-তার' কথা বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই 'সন্ত্রাসী' কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। 'চৎববসঢ়ঃরাব ঝঃৎরশব' আগাম আক্রমণের যে ধারণা বুশ ব্যবহার করেছিলেন কিংবা এখন ওবামা ব্যবহার করলেন, তা বাহ্যত যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। ইতিহাসে আছে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে হেগের ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব নিকারাগুয়ায় 'অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ' করাও কন্ট্রা বিদ্রোহীদের (যারা ওই সময় নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল) সাহায্যের অপরাধে অভিমত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায়কে স্বীকার করে নেয়নি। অথচ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯৪-২ ভোটে আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল সেদিন।
লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন একটি 'অধ্যায়ের' সূচনা হলো। এই 'মৃত্যু' মুসলিম বিশ্বে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটাও লক্ষ্য রাখার বিষয়। তবে ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব আজ অনেক বেশি মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের 'ইমেজ' বৃদ্ধি করা। প্রেসিডেন্ট ওবামার 'কায়রো ভাষণ' একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে কম। বেশ কিছু মুসলিম দেশে আল-কায়েদার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান, ও সোমালিয়ায় এদের প্রভাব ও কর্তৃর্ত্ব অনেক বেশি। সোমালিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।' আল সাদার্ব নামের সংগঠনটি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইসলামিক শরিয়া আইন চালু করেছে। আলজেরিয়াতে জন্ম হয়েছিল অষ-ছঁধবফধ রহ ঃযব ওংষধসরপ গধমযৎবন (অছওগ), ও ঝধষধভরংঃ এৎড়ঁঢ় ভড়ৎ চৎবধপযরহম ধহফ পড়সনধঃ-এরা আত্মঘাতী বোমাবাজি ও বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল। অছওগ পুরো মাগরের অঞ্চলে তৎপর। এখন ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে এসব জঙ্গিকে মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের ব্যাপারে জঙ্গিদের সঙ্গে 'সংলাপ' শুরু করাও জরুরি। ওসামা বিন লাদেনের পর এখন মার্কিনিদের টার্গেট মোল্লাহ ওমর। দীর্ঘ ১০ বছরেও মোল্লাহ ওমরের অস্তিত্ব আফগানিস্তানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূল ধারার তালেবানদের সঙ্গে যদি 'সংলাপ শুরু করা না যায়, তাহলে আফগান সমস্যার সমধান হবে না। যদিও আল-কায়েদা ও তালেবান আন্দোলন এক নয়। এদের মাঝে মতপার্থক্যও আছে।
আল-কায়েদা যেখানে বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল, সেখানে তালেবানরা শুধু আফগানিস্তানেও ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ওবামার জন্য আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার জরুরি। প্রেসিডেন্ট ওবামার দায়িত্ব আরো বাড়ল। আরব সাগরে টহলরত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ কার্ল ভিনসন থেকে লাদেনের মৃতদেহ আরব সাগরে সমাহিত করে সমস্যার সমধান করা যাবে না। মুসলিম বিশ্বে আস্থা অর্জন করতে হলে উদ্যোগী হতে হবে ওবামাকেই। ওসামার মৃত্যুর মধ্যে এ সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে গেল মাত্র। লাদেনকে হত্যা করে ওবামা ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার 'বিজয়'কে নিশ্চিত করেছেন_ এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব, পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কেও এখন নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এই জটিলতা আঞ্চলিক উত্তেজনা যেমনি বাড়বে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়, তা হবে প্রধান অন্তরায়।[পূর্বে প্রকাশ @ যায়যায়দিন ১৪.০৫.২০১১]
0 comments:
Post a Comment