রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিরোধ থেকেই গেল

সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিরোধিতা রয়েই গেল। সংবিধান সংশোধন নিয়ে যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা প্রধান বিরোধী দলকে সংলাপে ডাকলেও বিএনপি ওই সংলাপে যায়নি। কেন তারা যায়নি, তা তারা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েও দিয়েছে। এমনকি সংসদে এলডিপিকে প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সদস্য ড. কর্নেল অলি আহমদও সংলাপে যোগ দেননি। আমাকে তিনি জানিয়েছেন, যে প্রক্রিয়ায় তাকে সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তা শোভন ছিল না। অনেকটা দায়সারাগোছের কাজটি করেছে বিশেষ কমিটি। বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ব্যক্তিগতভাবে সংসদ ভবনের আটতলায় অবস্থিত কর্নেল অলির অফিসে যদি 'চা-পান' করতে যেতেন, তাহলে ভালো করতেন। এমনকি তিনি যদি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন, সেটা তার অবস্থানকে জাতির কাছে আরও শক্তিশালী করত। এখন কিছুই হলো না। এমনকি খোদ মহাজোটের শরিকদের মধ্যেও সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে দ্বিমত আছে। যেখানে জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রধর্ম চায়, সেখানে শরিক বাম ঘরানার ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদেরও অবস্থান ভিন্ন। তারা রাষ্ট্রধর্ম চান না। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, সংবিধানে যেমনি ধর্মনিরপেক্ষতা থাকছে, ঠিক তেমনি থাকছে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম'ও। এটা তো পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক। ভবিষ্যতে এটা নিয়েও একটি সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকছে কিনা তা অনিশ্চিত। তবে এতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। বিশেষ করে ৫৮গ(৩) ধারা নিয়ে এখন নানা কথা উঠেছে। এখানে 'ব্যক্তি' অর্থাৎ সাবেক প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) মুখ্য হয়ে উঠেছেন, পদ্ধতিটি মুখ্য হয়ে ওঠেনি।

অতীতেও দেখা গেছে, ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতা ছাড়ার আগে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুখ্য হয়ে উঠলেন। তখন আপত্তি উঠেছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। শুধু আপত্তি বললে ভুল বলা হবে। তারা এ প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এখন পরিস্থিতি অনেকটা সেদিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরে গেলেন ১৭ মে। এর পর কী হবে? কেন্দ্রবিন্দু এখন আবারও 'ব্যক্তিকে' নিয়ে। বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের পদত্যাগের পর ১৭ মে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। তিনি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন আয়োজন করবেন। বিএনপি ইতিমধ্যে তার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমরা বারবার আমাদের প্রধান বিচারপতিদের বিতর্কিত করছি। এরা আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। জাতীয় গার্ডিয়ান। জাতিকে অনেক পথনির্দেশনাও দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যা করা যায় তা হচ্ছে, ৫৮গ(৩) ধারায় পরিবর্তন এনে এখানে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন করা যেতে পারে, যারা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে একজনের নাম প্রস্তাব করবে, যার ব্যাপারে কোনো আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ ও একজন বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ৫৮গ(৪), ৫৮গ(৫) ও ৫৮গ(৬) ধারাগুলোর বিলুপ্তিও প্রয়োজন। এসব ধারায় একজন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ও রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণ করার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন বাধ্যতামূলক করা ও নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথাও সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কেউ কেউ সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের কথা বলছেন। এটা পরিবর্তন করা ঠিক হবে না (দলের বিপক্ষে ভোটদান প্রসঙ্গে)। এটা করা হলে 'হর্স ট্রেডিং' হবে, সাংসদরা বিকিকিনির শিকার হবেন। সংবিধানের ষষ্ঠভাগে ৯৫, ৯৬ ও ৯৮নং অনুচ্ছেদেও পরিবর্তন প্রয়োজন। ষষ্ঠভাগে বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন [৯৬(৩)] ও শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। সপ্তম ভাগে (১১৮নং অনুচ্ছেদ) নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা ও আর্থিকভাবে সরকারের ওপর নিরপেক্ষ না থাকার বিধান সংযোজন করা যেতে পারে।

সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদে যেখানে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস'-এর কথা বলা হয়েছে, তার কী হবে, সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েই গেল। সংবিধানের ২(ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা বলা হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না। তাতে করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার জন্ম দিতে পারে। ইসলামপন্থি দলগুলো এটা থেকে ফায়দা লুটতে পারে। ইউরোপের অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। আমেরিকার মতো রাষ্ট্রেও প্রেসিডেন্ট বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম যদি থাকে, তা হলে তাতে ক্ষতির কিছু নেই। রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পরবিরোধী হলেও রাষ্ট্রধর্ম রাখলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রে তেমন কোনো বাধা আসবে না। এখন রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিলে সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, যেখানে বলা হয়েছে_ 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এটা তো আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক চরিত্র। এটা যদি বাতিল হয়ে যায় তা হলে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে।

বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, তাতে করে গণতন্ত্রের নামে প্রধানমন্ত্রীর এক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধানের ৫৫(১), ৫৫(২), ৫৬(১), ৫৮(২) ইত্যাদি ধারা এমনভাবে সংযোজিত হয়েছে যে, তাতে করে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে, যাকে 'প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র' হিসেবে অভিহিত করা যায়। এখানে মন্ত্রিসভার যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্রে এই যৌথ নেতৃত্বই আসল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষপাতী আমি। বর্তমান সংবিধানে ৪৮(৩) ধারায় রাষ্ট্রপতির দুটি ক্ষমতা আছে। এক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও দুই. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। এর বাইরে প্রতিটি সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সম্পন্ন করবেন। এই ধারায় পরিবর্তন প্রয়োজন। শ্রীলংকা ও ফ্রান্স রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হলেও সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন। আমরা বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু ক্ষমতা তুলে দিতে পারি। অতীতে সংবিধানে যে ১৪টি সংশোধনী আনা হয়েছে, তা কখনও গণভোটে প্রেরণ করা হয়নি। কিন্তু ১৪২(১) ধারায় গণভোটে প্রেরণের বিধান রয়েছে। এখন উচ্চ আদালতের রায়ে 'সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছে'। যদি তাই হয়, তা হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত ১৪১(ক)(১) ধারার কী হবে? ১৯৭২ সালের সংবিধানে তো জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো বিধান ছিল না। ঠিক তেমনি চতুর্থ সংশোধনীসহ আরও অনেক সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।

সংবিধান সংশোধন খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। এখন যে দল বিগত নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের ৩২.৪৫ ভাগ ভোট পেয়েছিল (জোটগতভাবে প্রায় ৩৮ ভাগ), সংবিধান সংশোধনীতে তাদের যদি কোনো বক্তব্য না থাকে অথবা তাদের বক্তব্য যদি অন্তর্ভুক্ত করা না যায়, তা হলে তো প্রশ্ন থেকেই যাবে। প্রায় ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা করা হবে এতে করে। প্রধান বিরোধী দলকে সংলাপে না আনার ব্যর্থতা বিশেষ কমিটিকে বহন করতে হবে। সংসদে সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংবিধানের ১৪২(১)(আ) ধারামতে, সরকার সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। রাজনীতি হচ্ছে 'An art of the compromise. সরকারে যারা থাকেন, তাদের আরও সহনীয় হতে হয়। হতে হয় আরও উদার ও উন্মুক্ত। এখন সরকার যেভাবে চাচ্ছে, সেভাবেই সংবিধান সংশোধিত হচ্ছে। ফলে বিরোধ থেকেই গেল। যে রাজনীতি পরস্পর পরস্পরকে শত্রু মনে করে, যে রাজনীতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়, সেই রাজনীতি থেকে ৪০ বছরেও আমরা বের হয়ে আসতে পারলাম না। দুঃখটা এখানেই।
[সূত্রঃ সমকাল, ১৮/০৫/১১]

0 comments:

Post a Comment