সাতবেলা :: আদালতের রায়ে সংবিধান সংশোধন করা হলে তা সংসদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে কি?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: সংবিধান কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষের নয়, এটা সমগ্র জাতির। ১৬ কোটি লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই সংবিধান। অথচ সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে উচ্চ আদালতের একটি রায়ে? কিংবা বিশেষ কমিটির কলমের খোঁচায়? উচ্চ আদালতও কাজ করে সংবিধানের আওতায়। উচ্চ আদালত ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিল করে দুটি রায় দিয়েছেন। তাদের সেই রায়টি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ। উচ্চ আদালত এ ধরনের কাজ করতে পারেন। যদি সংবিধানের ধারার প্রয়োগ নিয়ে কিংবা সংবিধানের কিছু দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে উচ্চ আদালত উত্থাপিত সমস্যার সমাধান দেবেন। তারা সংবিধানের ব্যাখ্যাও দেবেন। আমরা তা মানতে বাধ্য। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু উচ্চ আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। সংবিধানের ৬৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত। আবার সংবিধানের ১৪২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তা সত্ত্বেও সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান, তা তৈরি করবে জাতীয় সংসদ এবং সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদনসহ তা গৃহীত হবে।
সাতবেলা: খসড়া সংবিধান সরকার প্রকাশ করছে না কেন?
ড.তারেক শামসুর রেহমান: এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানেই। আদালত যে রায় দিয়েছেন, কিংবা তাদের পর্যবেক্ষণে যে বিষয়গুলো এসেছে, এর বাইরে অন্য কোনো বিষয় খসড়া সংবিধানে রাখা হয়েছে কি না, তা জানার কোনো সুযোগ নেই। এখানে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। কেননা খসড়া সংবিধানে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, কোন কোন বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে, তা জানার কোনো সুযোগ কারও নেই। এমনকি তথ্য অধিকার আইন বলেও সাংবাদিকরা কোনো তথ্য জানতে পারছেন না। তবে অভিযোগ উঠেছে খসড়া সংবিধানে এমন অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যে ব্যাপারে আদালতের কোনো পর্যবেক্ষণ ছিল না। এরপর সরকার যে কমিটি করে দিয়েছে, সেই কমিটির কর্মপরিধি তথা তাদের বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। খোদ মহাজোট সরকারের শরিকরাও আজ সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভ্রান্ত। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মহাজোটের শরিকদের মাঝে কোন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সাতবেলা :: সংবিধান সংশোধনে গঠিত কমিটিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় নি। সংবিধানের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনকল্যাণের ক্ষেত্রে এই কমিটি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন কি?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: আদালতের রায়ের ফলে এখন সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সরকার একটি কমিটিও গঠন করেছে, যেখানে সব দলের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। এটা হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়।এখানে আমার কাছে যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তা হচ্ছেত ক. জাতীয় কমিটি যখন সংবিধান সংশোধন করছে, তখন প্রধান বিরোধী দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া তারা যদি সংবিধান সংশোধন করে, তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না? খ. কতগুলো মৌলিক প্রশ্নে (বিসমিল্লাহ, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস) জাতীয় কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত এই জাতির ওপর চাপিয়ে দেবে কি না? গ. সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে গণভোটের একটি বিধান আছে [১৪২ ১(ক)]। এখন আমরা কি একটি গণভোটের আয়োজন করব? বর্তমান সংসদে বিএনপির আসন সংখ্যা কম। কিন্তু ভোট পেয়েছে ৩৩ ভাগ। আর চারদলীয় জোট যদি ধরা হয়, তাহলে প্রদত্ত ভোটের হার প্রায় ৩৭ ভাগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল বা জোটের মতামত যদি নেয়া না হয়, তাহলে এই সংশোধনী অর্থহীন। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে এ কথাটা এখন উপলব্ধি করতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যত বৈঠকই করুন না কেন, সংবিধান সংশোধনে সবার মতামত নিতে হবে। এমনকি যারা সংবিধান নিয়ে ভাবেন, তাদের মতামত নেয়াটাও জরুরি। একজন আইনবিদ হলেই যে তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ হবেন, এটা মনে করা হলে ভুল করা হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপকও সংবিধান সম্পর্কে ভালো ও গ্রহণযোগ্য মতামত দিতে পারেন। এ কাজটি সুরঞ্জিত বাবুর করা উচিত। সংবিধানের মূল চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না।
সাতবেলা :: বিরোধী দল বলছে কোন সংবিধানে দেশ চলছে তা স্পষ্ট নয়। এই অভিযোগটি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছিল এভাবে, ‘আদালতের রায় প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে’|এর অর্থ সংবিধান এখন ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে গেছে। আমি এর অর্থ বুঝি এভাবে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ১৯৭২ সালের সংবিধান বলবত্ রয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে তো বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে।যেমন ১. সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আগে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। মূল নীতিতে (৮-১) বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। কিন্তু ১৯৭২ সালের মূল নীতিতে এ ধরনের উক্তি ছিল না। ২. মূল নীতিতে আছে সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার কথাটি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল শুধু সমাজতন্ত্রের কথা। বিশ্বায়নের এই যুগে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও এখন আর সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় না। ৩. আগের সংবিধানের ২৫(২) ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে এমনটি ছিল না। এখন কি আমরা ২৫(২) ধারাটি বাদ দেব? ৪. আগের সংবিধানে ৫৮(খ) ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ধারায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। তাহলে কি আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেব? ৫. আমাদের সংবিধানে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে। প্রথম সংশোধনী (১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই), দ্বিতীয় সংশোধনী (২২ সেপ্টেম্&বর, ৭৩) তৃতীয় সংশোধনী (১৯৭৪), চতুর্থ সংশোধনী (১৯৭৫), দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুমতি দেয়া হয়। আগে এটি ছিল না। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ধরলে তো জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকে না। যদি এ মুহূর্তে একটি সঙ্কট তৈরি হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি কী করবেন? ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুই দেশের সীমানা চিহ্নিতকরণ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যার বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়েছিল। এখন ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থ ওই সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত অধ্যায় হচ্ছে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন (চতুর্থ সংশোধনী)। নতুন করে যে সংশোধনী লেখা হচ্ছে, তাতে বাকশাল ব্যবস্থাকে আমরা কীভাবে দেখব? ঠিক তেমনি দ্বাদশ সংশোধনীতে আমরা আবার সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম। এখন এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?
সাতবেলা :: খসড়া সংবিধানে একই সাথে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকার কথা বলা হচ্ছে। এগুলো পরস্পর বিরোধী কি না?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: এগুলো যে পরস্পর বিরোধী তা মহাজোটের শরীকদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মহাজোটের শরিকদের মাঝে কোনো ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো কোনো ইস্যুতে মহাজোটের শরিকরা পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করছেন| পত্রপত্রিকায় তা ছাপাও হচ্ছে। জাসদের সভাপতি এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদে প্রথমবারের মতো এমপি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাখা হবে প্রকাশ্য মোনাফেকি । অথচ খোদ তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী নাকি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ রাখার পক্ষে । তবে কোনটা যে সঠিক আমরা নিজেরাও তা জানি না। মজার ব্যাপার হলো শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি এখন সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান, তিনি নিজে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই সংবিধানের খসড়ায় স্বাক্ষর করেননি। আজ তিনিই ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। আর এরশাদ সাহেব বলছেন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া ভালো।
সাতবেলা :: সংবিধান সংশোধনে আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ থাকলে বলতে পারেন।
ড.তারেক শামসুর রেহমান:: এ দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। হাজার বছর ধরে মানুষ এ ধর্ম লালন করে আসছে। আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সংবিধানে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না, যা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে আঘাত লাগে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে থাকা দরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয় না, তার সর্বশেষ উদাহরণ ভোলার উপনির্বাচন। সেখানে কী হয়েছিল তা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে বিতর্ক উঠেছে ৫৮ গ(৩) ধারা নিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। সব ধরনের বিতর্ক এড়াতে এ ধারায় একটি বাক্য সংযোজন করা যেতে পারে। বাক্যটি নিম্নরূপ : রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছেন তাহাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন। তবে শর্ত থাকে তিনি যদি সুপারসিডেট হইয়া প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে বিবেচিত হইবেন না। ৫৮ গ(৫) ধারা পরিবর্তন করে একটি এলডার্স কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে, যারা একজন প্রধান উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবেন। এলডার্স কাউন্সিল হবে ৩ সদস্যবিশিষ্ট (একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন বিশিষ্ট নাগরিক)।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সুধীজনের পক্ষ থেকে যোগ্য প্রস্তাব উঠেছে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। এই কাজগুলো যদি সুরঞ্জিত বাবু করেন, তাহলে তিনি বিতর্কিত হবেন না। নতুবা তিনি বিতর্কিত হবেন।
সাতবেলা: স্যার আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ড.তারেক শামসুর রেহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: সংবিধান কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষের নয়, এটা সমগ্র জাতির। ১৬ কোটি লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই সংবিধান। অথচ সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে উচ্চ আদালতের একটি রায়ে? কিংবা বিশেষ কমিটির কলমের খোঁচায়? উচ্চ আদালতও কাজ করে সংবিধানের আওতায়। উচ্চ আদালত ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিল করে দুটি রায় দিয়েছেন। তাদের সেই রায়টি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ। উচ্চ আদালত এ ধরনের কাজ করতে পারেন। যদি সংবিধানের ধারার প্রয়োগ নিয়ে কিংবা সংবিধানের কিছু দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে উচ্চ আদালত উত্থাপিত সমস্যার সমাধান দেবেন। তারা সংবিধানের ব্যাখ্যাও দেবেন। আমরা তা মানতে বাধ্য। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু উচ্চ আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। সংবিধানের ৬৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত। আবার সংবিধানের ১৪২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তা সত্ত্বেও সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান, তা তৈরি করবে জাতীয় সংসদ এবং সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদনসহ তা গৃহীত হবে।
সাতবেলা: খসড়া সংবিধান সরকার প্রকাশ করছে না কেন?
ড.তারেক শামসুর রেহমান: এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানেই। আদালত যে রায় দিয়েছেন, কিংবা তাদের পর্যবেক্ষণে যে বিষয়গুলো এসেছে, এর বাইরে অন্য কোনো বিষয় খসড়া সংবিধানে রাখা হয়েছে কি না, তা জানার কোনো সুযোগ নেই। এখানে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। কেননা খসড়া সংবিধানে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, কোন কোন বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে, তা জানার কোনো সুযোগ কারও নেই। এমনকি তথ্য অধিকার আইন বলেও সাংবাদিকরা কোনো তথ্য জানতে পারছেন না। তবে অভিযোগ উঠেছে খসড়া সংবিধানে এমন অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যে ব্যাপারে আদালতের কোনো পর্যবেক্ষণ ছিল না। এরপর সরকার যে কমিটি করে দিয়েছে, সেই কমিটির কর্মপরিধি তথা তাদের বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। খোদ মহাজোট সরকারের শরিকরাও আজ সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভ্রান্ত। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মহাজোটের শরিকদের মাঝে কোন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সাতবেলা :: সংবিধান সংশোধনে গঠিত কমিটিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় নি। সংবিধানের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনকল্যাণের ক্ষেত্রে এই কমিটি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন কি?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: আদালতের রায়ের ফলে এখন সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সরকার একটি কমিটিও গঠন করেছে, যেখানে সব দলের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। এটা হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়।এখানে আমার কাছে যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তা হচ্ছেত ক. জাতীয় কমিটি যখন সংবিধান সংশোধন করছে, তখন প্রধান বিরোধী দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া তারা যদি সংবিধান সংশোধন করে, তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না? খ. কতগুলো মৌলিক প্রশ্নে (বিসমিল্লাহ, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস) জাতীয় কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত এই জাতির ওপর চাপিয়ে দেবে কি না? গ. সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে গণভোটের একটি বিধান আছে [১৪২ ১(ক)]। এখন আমরা কি একটি গণভোটের আয়োজন করব? বর্তমান সংসদে বিএনপির আসন সংখ্যা কম। কিন্তু ভোট পেয়েছে ৩৩ ভাগ। আর চারদলীয় জোট যদি ধরা হয়, তাহলে প্রদত্ত ভোটের হার প্রায় ৩৭ ভাগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল বা জোটের মতামত যদি নেয়া না হয়, তাহলে এই সংশোধনী অর্থহীন। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে এ কথাটা এখন উপলব্ধি করতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যত বৈঠকই করুন না কেন, সংবিধান সংশোধনে সবার মতামত নিতে হবে। এমনকি যারা সংবিধান নিয়ে ভাবেন, তাদের মতামত নেয়াটাও জরুরি। একজন আইনবিদ হলেই যে তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ হবেন, এটা মনে করা হলে ভুল করা হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপকও সংবিধান সম্পর্কে ভালো ও গ্রহণযোগ্য মতামত দিতে পারেন। এ কাজটি সুরঞ্জিত বাবুর করা উচিত। সংবিধানের মূল চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না।
সাতবেলা :: বিরোধী দল বলছে কোন সংবিধানে দেশ চলছে তা স্পষ্ট নয়। এই অভিযোগটি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছিল এভাবে, ‘আদালতের রায় প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে’|এর অর্থ সংবিধান এখন ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে গেছে। আমি এর অর্থ বুঝি এভাবে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ১৯৭২ সালের সংবিধান বলবত্ রয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে তো বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে।যেমন ১. সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আগে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। মূল নীতিতে (৮-১) বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। কিন্তু ১৯৭২ সালের মূল নীতিতে এ ধরনের উক্তি ছিল না। ২. মূল নীতিতে আছে সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার কথাটি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল শুধু সমাজতন্ত্রের কথা। বিশ্বায়নের এই যুগে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও এখন আর সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় না। ৩. আগের সংবিধানের ২৫(২) ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে এমনটি ছিল না। এখন কি আমরা ২৫(২) ধারাটি বাদ দেব? ৪. আগের সংবিধানে ৫৮(খ) ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ধারায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। তাহলে কি আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেব? ৫. আমাদের সংবিধানে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে। প্রথম সংশোধনী (১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই), দ্বিতীয় সংশোধনী (২২ সেপ্টেম্&বর, ৭৩) তৃতীয় সংশোধনী (১৯৭৪), চতুর্থ সংশোধনী (১৯৭৫), দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুমতি দেয়া হয়। আগে এটি ছিল না। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ধরলে তো জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকে না। যদি এ মুহূর্তে একটি সঙ্কট তৈরি হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি কী করবেন? ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুই দেশের সীমানা চিহ্নিতকরণ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যার বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়েছিল। এখন ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থ ওই সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত অধ্যায় হচ্ছে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন (চতুর্থ সংশোধনী)। নতুন করে যে সংশোধনী লেখা হচ্ছে, তাতে বাকশাল ব্যবস্থাকে আমরা কীভাবে দেখব? ঠিক তেমনি দ্বাদশ সংশোধনীতে আমরা আবার সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম। এখন এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?
সাতবেলা :: খসড়া সংবিধানে একই সাথে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকার কথা বলা হচ্ছে। এগুলো পরস্পর বিরোধী কি না?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: এগুলো যে পরস্পর বিরোধী তা মহাজোটের শরীকদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মহাজোটের শরিকদের মাঝে কোনো ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো কোনো ইস্যুতে মহাজোটের শরিকরা পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করছেন| পত্রপত্রিকায় তা ছাপাও হচ্ছে। জাসদের সভাপতি এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদে প্রথমবারের মতো এমপি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাখা হবে প্রকাশ্য মোনাফেকি । অথচ খোদ তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী নাকি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ রাখার পক্ষে । তবে কোনটা যে সঠিক আমরা নিজেরাও তা জানি না। মজার ব্যাপার হলো শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি এখন সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান, তিনি নিজে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই সংবিধানের খসড়ায় স্বাক্ষর করেননি। আজ তিনিই ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। আর এরশাদ সাহেব বলছেন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া ভালো।
সাতবেলা :: সংবিধান সংশোধনে আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ থাকলে বলতে পারেন।
ড.তারেক শামসুর রেহমান:: এ দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। হাজার বছর ধরে মানুষ এ ধর্ম লালন করে আসছে। আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সংবিধানে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না, যা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে আঘাত লাগে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে থাকা দরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয় না, তার সর্বশেষ উদাহরণ ভোলার উপনির্বাচন। সেখানে কী হয়েছিল তা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে বিতর্ক উঠেছে ৫৮ গ(৩) ধারা নিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। সব ধরনের বিতর্ক এড়াতে এ ধারায় একটি বাক্য সংযোজন করা যেতে পারে। বাক্যটি নিম্নরূপ : রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছেন তাহাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন। তবে শর্ত থাকে তিনি যদি সুপারসিডেট হইয়া প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে বিবেচিত হইবেন না। ৫৮ গ(৫) ধারা পরিবর্তন করে একটি এলডার্স কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে, যারা একজন প্রধান উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবেন। এলডার্স কাউন্সিল হবে ৩ সদস্যবিশিষ্ট (একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন বিশিষ্ট নাগরিক)।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সুধীজনের পক্ষ থেকে যোগ্য প্রস্তাব উঠেছে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। এই কাজগুলো যদি সুরঞ্জিত বাবু করেন, তাহলে তিনি বিতর্কিত হবেন না। নতুবা তিনি বিতর্কিত হবেন।
সাতবেলা: স্যার আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ড.তারেক শামসুর রেহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
[২৯ এপ্রিল ২০১১ ]
0 comments:
Post a Comment