পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য ও ৩৫টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর তিনটি পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিরা যখন প্রতিবাদমুখর হয়েছে, ঠিক তখনই সন্তু লারমার কিছু বক্তব্য তাকে আবারও বিতর্কিত করে তুলেছে। তার ওই বক্তব্য সংবিধানবিরোধী, বাঙালি বিদ্বেষী ও সর্বোপরি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। সন্তু লারমা কিছু বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছেন একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে গত ১৬ আগষ্ট। ওই দৈনিকটির নানা কর্মকান্ড
কান্ড, বিশেষ করে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর পর পত্রিকাটির ভুমিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা কথা চালু রয়েছে, অতীতে পাহাড়িদের তথাকথিত ‘নানা সমস্যা’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পত্রিকাটির কোনো কার্পণ্য ছিল না; কিন্তু পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিরা যে সেখানে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে আসছিলেন, কিংবা তাদের সুখ-দুঃখের খবর খুব কমই ছাপা হয়েছে ওই পত্রিকাটিতে। তাই সরকার যখন কয়েকটি সেনাক্যাম্প বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন সঙ্গত কারণেই পত্রিকাটি সন্তু লারমার সাক্ষাৎকার ছাপবে-এতে আমি অবাক হইনি। আমার প্রত্যাশা ছিল সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে বাঙালি নেতাদের সাক্ষাৎকারও তারা ছাপবে। একজন বাঙালি এমপিও তো ছিলেন ওই অঞ্চল থেকে গত সংসদে। তিনিও তো পরিস্হিতির মুল্যায়ন করতে পারতেন। না, আমাকে অবাক করে দিয়ে পত্রিকাটি বাঙালি নেতাদের কোনো সাক্ষাৎকারই ছাপাল না। অথচ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক সেখানে বাঙালি। সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাদেরও কিছু বক্তব্য থাকতে পারে। তবে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে আমি স্বাগত জানাই।
পত্রিকাটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমা যে সব বক্তব্য দিয়েছেন,
তা নিম্নরুপ
১. পাহাড়িদের জায়গা দখল করে সেটলারদের সেখানে বসানো হয়েছে। সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই;
২. দেশে প্রচুর খাস জমি রয়েছে, সেখানে সেটেলারদের পুনর্বাসন সম্ভব;
৩. ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্বত্য চুক্তির (১৯৯৭) পর সেখান থেকে সেটলারদের সরিয়ে পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল;
৪. সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত তাদের জানানো হয়নি;
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন চলছে;
৬. অপারেশন উত্তরণের অবসান না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্হিতি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই;
৭. দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য অঞ্চলকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই;
৮. ইউপিডিএফ চাঁদাবাজি, খুন, সন্ত্রাস ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত এবং ইউপিডিএফের সন্ত্রাস ছাড়া পাহাড়ে আর কোনো সন্ত্রাস নেই; ৯. পার্বত্য অঞ্চল ঢাকার চেয়েও শান্তিপুর্ণ
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামে খাস জমি বলে কিছু নেই;
১১. জনসংহতি সমিতির কিছু সদস্য দালালি করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সন্তু লারমা যা বলেছেন, তা কি সত্য বলেছেন? কোন অধিকার বলে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন? তাকে এই অধিকার কে দিয়েছে? তিনি নির্বাচিত কোনো নেতা নন। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। জনগণের ভোটে তিনি কখনও বিজয়ী হয়ে আসেননি। আজকে নির্বাচিত কোনো পাহাড়ি নেতা যদি এসব কথা বলতেন, তাহলে তার পেছনে যুক্তি ছিল। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। ১০ বছর ধরে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের তথাকথিত চেয়ারম্যান। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা ‘দখল’ করে আছেন। পাহাড়িরা সবাই তার উপর আস্হাশীল, এটা আমি মনে করি না। জনসংহতি সমিতিতে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। একটি অংশ আলাদা অবস্হান নিয়েছে। সুতরাং তাকে পাহাড়িদের একক নেতা বলা যাবে না। তবুও দেশের এক শ্রেণীর মানুষ তাকে পাহাড়িদের নেতা মনে করেন। এটি ভুল। বরং সরকারের উচিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। পাহাড়িরা এ অঞ্চলের ভুমিপুত্র নন। অর্থাৎ তারা এ অঞ্চলের মুল বাসিন্দা নন। বরং ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, চাকমারা বাংলাদেশে আশ্রিত একটি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। একাধিক চাকমা বুদ্ধিজীবীর লেখায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। চাকমারা বহিরাগত। তাদের আদি বাসস্হান চম্পকনগর কিংবা পুর্বপুরুষ বিজয়গিরি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ইতিহাসে নেই। ইতিহাসে দেখা গেছে, চাকমা রাজারা মুসলমান নবাব-শাসক-সুবেদার-সুলতানের এত বেশি প্রভাবাধীন ছিলেন যে, তারা তাদের চাকমা নাম পরিহার করে মুসলিম নাম ধারণ করেন (রাজা সুলভ খাঁ ১৭১২, রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫, রাজা সেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭, রাজা দৌলত খাঁ ১৭৭৬ ইত্যাদি)। চাকমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) আনুমানিক দেড়শ’ বছর পরে। ইতিহাস যদি আমাদের এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, তাহলে সন্তু লারমার কী অধিকার আছে ‘সেটলারদের’ (যারা বাঙালি) এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র পুনর্বাসন করার? সন্তু লারমার পুর্বপুরুষদের মতো বাঙালিরাও এ অঞ্চলে বসতি স্হাপন করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। আমরা এর আগে একাধিকবার বলেছি, বাঙালিরা সাংবিধানিক অধিকার বলেই (সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭ ও ৪২ অনুচ্ছেদ) এ অঞ্চলে সন্তু লারমার মতোই বসবাস করছেন। সন্তু লারমা বাঙালিদের পুনর্বাসনের কথা বলে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন এবং এখন সংবিধান লংঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ আনা যায়। তার এই দাবি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন। তবে অত্যন্ত চালাক সন্তু লারমা এবার প্রথমবারের মতো একটি শব্দ যোগ করেছেন। আর তা হচ্ছে ‘সম্মানজনকভাবে’। অর্থাৎ বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে হবে সম্মানজনকভাবে। হায়রে মায়াকান্না! সন্তু লারমা বলেছেন দেশে প্রচুর খাস জমি রয়েছে। সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসন সম্ভব। এটিও মিথ্যা তথ্য। দেশে খাস জমি রয়েছে বটে, তা প্রচুর নয়। উপরন্তু শিল্প-কল-কারখানা স্হাপন করার কারণে দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের জানাচ্ছে যে, গত ২০ বছরে দেশে প্রায় ৫০ লাখ একর কৃষিজমি কমেছে (১৬ আগষ্ট)।
দেশে এভাবে যদি কৃষিজমি কমতে থাকে, তাহলে তা খাদ্য উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। সন্তু বাবু কী চান কৃষিজমিতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এনে বসিয়ে দেয়া হোক? কৃষিজমির পরিমাণ কমিয়ে সন্তু বাবু কি চান বাংলাদেশকে স্হায়ীভাবে খাদ্যে পরনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে? বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এরা যাবে কোথায়? রাষ্ট্র, সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি এ ধরনের দাবি তোলার। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো খাস জমি নেই বলে সন্তু লারমা যে মন্তব্য করেছেন, তা সত্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান ১৯০০ (যা এখনও মেনে চলা হয়) ধারা ৩৪ ও ধারা ৫০-এ খাস জমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৪-এ উল্লেখ করা হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্র ব্যতীত খাস জমি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। আর ধারা ৫০-এ বলা হয়েছে একজন পাহাড়ি হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে ০.৩০ একর খাস জমি দখল করতে পারবেন। খাস জমি যদি নাই থাকে, তাহলে আইনে খাস জমির কথা উল্লেখ করা হলো কেন? আসলে সন্তু লারমা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।
সন্তু লারমা বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল। কথাটা কি সত্য? যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে অন্যায় করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ জন্য রয়েছে সংসদ। সংসদে সিদ্ধান্ত হবে, বিতর্ক হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে কে? তারা কি জেনেভা কনভেনশন লংঘন করছে না? তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, এটা তাদের কাজ নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নে তারা আমাদের পার্টনার; কিন্তু তাদের কোনো অধিকার নেই দেশবাসীকে বিভক্ত করার। প্রসঙ্গক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন এসে গেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তারা কাজ করছে। এটা প্রশংসার যোগ্য; কিন্তু তারা কি সেখানে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কর্মসুচি হাতে নিয়েছে? তারা কি বাঙালি শিশু সন্তানদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছে? নাকি তাদের কর্মসুচি শুধু পাহাড়ি, বিশেষ করে চাকমাদের কেন্দ্র করে? বাঙালি মুসলমানরা কি ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে চাকরি পাচ্ছে? এটা কি সত্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে?
ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে একটি মুল্যায়ন হওয়া উচিত। সন্তু বাবু বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন (!) চলছে। কথাটা কি সত্য? দেশে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। একটি নির্বাচিত সরকার যেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করছে, সেখানে দেশের একটি অংশে সেনাশাসন থাকে কিভাবে? তার এই মন্তব্য কি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি নষ্ট করবে না? আর ৫টি জায়গার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সেনাবাহিনী রয়েছে। পরিস্হিতির অবনতি হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত কয়েকটি সেনাক্যাম্প স্হাপন করা হয়েছিল। সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা যদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত না থাকত, যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতীতে ‘যুদ্ধ’ না করত, তাহলে তো অতিরিক্ত সেনাক্যাম্প স্হাপন করার প্রয়োজন হতো না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্হিতি স্বাভাবিক রাখতেই সেখানে অতিরিক্ত সেনাক্যাম্প স্হাপন করা হয়েছিল। এসব ক্যাম্প রাখতে হবে। কয়েকটি সেনাক্যাম্প এরই মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার ফলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এর মধ্যেই সেখানে আস্তানা গেড়েছে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের এ তথ্যই দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, সন্তু লারমা চান পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো শাসন করুক। এখন সন্তু লারমাকেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সন্তু লারমা যখন সব সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার দাবি করছেন, তখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে তথাকথিত ‘গঞ্জুশ বাহিনী’ ও ‘সন্তুষ বাহিনী’র কথা (নয়া দিগন্ত, ১৯ আগষ্ট)। যারা কাপ্তাই এলাকায় বসবাস করেন, নদীপথে পণ্য আনা-নেয়া করেন, তাদের কাছে ‘গঞ্জুশ বাহিনী’ কিংবা ‘সন্তুষ বাহিনী’র নাম অপরিচিত নয়। এরা চাঁদাবাজ। চাঁদা দেয়া প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামুলক। শান্তি বাহিনীর সাবেক সদস্যরাই (যার নেতা ছিলেন সন্তু লারমা) এখন ‘গঞ্জুশ বাহিনী’ গড়ে তুলে এক ব্যাপক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। সন্তু লারমা এদের কর্মকান্ড বন্ধ করার উদ্যোগ নেননি কেন? তিনি কি চান এই চাঁদা-সংস্কৃতি এখানে চালু থাকুক? তিনি কি চান এ ধরনের হাজারটা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা একটি প্রশাসন গড়ে তুলুক? শান্তি চুক্তির আগে তো পরিস্হিতি তেমনই ছিল। রাষ্ট্র কোনো পর্যায়েই এই চাঁদাবাজি-সংস্কৃতিকে চলতে দিতে পারে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই সেখানে সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন। আমাদের অনেক সন্তান, যারা সেনাবাহিনীতে থেকে মশার কামড় খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, নিজ ভুখন্ড রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেছেন, সন্তু লারমা আজ তাদের কৃতিত্ব না দিয়ে তাদের অবদানকে অস্বীকার করেছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঢাকার চেয়েও শান্তিপুর্ণ বলে যে মন্তব্য সন্তু লারমা করেছেন, তা প্রকারান্তরে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। তিনি তো বলেই দিলেন ঢাকার পরিস্হিতি ভালো নয়। সরকার এ ক্ষেত্রে কী বলবে! মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও বা কী!
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী। যে কারণে রাঙ্গামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে অনগ্রসর লুসাই, চাক, খুমি, খিয়াং, পাংখো, রিয়াং, বোম, তংচঙ্গ্যা, মুরং এবং স্হানীয় বাঙালিরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই; কিন্তু সন্তু লারমা, যিনি চাকমা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি চাচ্ছেন না ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক। কেন? এটা কি এ জন্য যে, তিনি চান না চাক, লুসাই, খুমি, খিয়াং কিংবা পাংখো জাতির কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক? পাহাড়িদের মধ্যে শুধু চাকমারাই (যাদের মাঝে উচ্চশিক্ষার হার ৯০ ভাগের উপরে) উচ্চশিক্ষা নেবে, অন্যরা নেবে না-এটাই কি সন্তু লারমার মনের বাসনা? অন্য জাতি-গোষ্ঠী যদি শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর থাকে, তাহলে ‘চাকমা আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠা করা সহজ। পাংখো কিংবা বোম জাতির কেউ বিসিএস দিয়েছে, ডাক্তার হয়েছে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে-এটা মনে হয় না। অথচ ‘কোটা সিষ্টেমে’র সুবিধা নিয়েছে শুধু চাকমারাই। অনগ্রসর বোম, রিয়াং, পাংখো কিংবা লিয়াংরা এই সুবিধা পায়নি। সংবিধানের ২৮(১) ধারা মতে রাষ্ট্র কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারে না; কিন্তু বৈষম্য তো তৈরি হয়ে গেছেই। এখন সময় এসেছে তা সংশোধন করার। ‘কোটা ব্যবস্হা’ থাকুক; কিন্তু এই ‘কোটা ব্যবস্হায়’ পাহাড়ি ১৩টি জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে দিতে হবে।
সন্তু লারমার এই বক্তব্যে আমি কষ্ট পেয়েছি। এদেশ আমাদের সবার। পাহাড়িরা আলাদা নয়। তারাও এদেশের সন্তান। বাঙালিরাও এদেশের সন্তান। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ নয়, বাংলাদেশেরই একটি এলাকা। বাঙালি আর পাহাড়ি মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের আলাদা ভাবলে চলবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে (সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার) বাঙালিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা দেখতে হবে। সন্তু লারমা অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে আছেন। একটি সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন তাকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়, তখন সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি দখল করে রাখার। সন্তু লারমা পদত্যাগ করে নতুনদের পথ করে দিতে পারেন। আঞ্চলিক পরিষদে নয়া নেতৃত্ব দরকার, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ওই অঞ্চলের উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবেন।
লেখকঃ রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইলঃ tsrahmanbd@yahoo.com (সুত্র, আমার দেশ, ২৩/০৮/২০০৯)
কান্ড, বিশেষ করে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর পর পত্রিকাটির ভুমিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা কথা চালু রয়েছে, অতীতে পাহাড়িদের তথাকথিত ‘নানা সমস্যা’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পত্রিকাটির কোনো কার্পণ্য ছিল না; কিন্তু পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিরা যে সেখানে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে আসছিলেন, কিংবা তাদের সুখ-দুঃখের খবর খুব কমই ছাপা হয়েছে ওই পত্রিকাটিতে। তাই সরকার যখন কয়েকটি সেনাক্যাম্প বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন সঙ্গত কারণেই পত্রিকাটি সন্তু লারমার সাক্ষাৎকার ছাপবে-এতে আমি অবাক হইনি। আমার প্রত্যাশা ছিল সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে বাঙালি নেতাদের সাক্ষাৎকারও তারা ছাপবে। একজন বাঙালি এমপিও তো ছিলেন ওই অঞ্চল থেকে গত সংসদে। তিনিও তো পরিস্হিতির মুল্যায়ন করতে পারতেন। না, আমাকে অবাক করে দিয়ে পত্রিকাটি বাঙালি নেতাদের কোনো সাক্ষাৎকারই ছাপাল না। অথচ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক সেখানে বাঙালি। সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাদেরও কিছু বক্তব্য থাকতে পারে। তবে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে আমি স্বাগত জানাই।
পত্রিকাটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমা যে সব বক্তব্য দিয়েছেন,
তা নিম্নরুপ
১. পাহাড়িদের জায়গা দখল করে সেটলারদের সেখানে বসানো হয়েছে। সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই;
২. দেশে প্রচুর খাস জমি রয়েছে, সেখানে সেটেলারদের পুনর্বাসন সম্ভব;
৩. ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্বত্য চুক্তির (১৯৯৭) পর সেখান থেকে সেটলারদের সরিয়ে পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল;
৪. সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত তাদের জানানো হয়নি;
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন চলছে;
৬. অপারেশন উত্তরণের অবসান না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্হিতি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই;
৭. দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য অঞ্চলকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই;
৮. ইউপিডিএফ চাঁদাবাজি, খুন, সন্ত্রাস ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত এবং ইউপিডিএফের সন্ত্রাস ছাড়া পাহাড়ে আর কোনো সন্ত্রাস নেই; ৯. পার্বত্য অঞ্চল ঢাকার চেয়েও শান্তিপুর্ণ
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামে খাস জমি বলে কিছু নেই;
১১. জনসংহতি সমিতির কিছু সদস্য দালালি করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সন্তু লারমা যা বলেছেন, তা কি সত্য বলেছেন? কোন অধিকার বলে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন? তাকে এই অধিকার কে দিয়েছে? তিনি নির্বাচিত কোনো নেতা নন। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। জনগণের ভোটে তিনি কখনও বিজয়ী হয়ে আসেননি। আজকে নির্বাচিত কোনো পাহাড়ি নেতা যদি এসব কথা বলতেন, তাহলে তার পেছনে যুক্তি ছিল। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। ১০ বছর ধরে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের তথাকথিত চেয়ারম্যান। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা ‘দখল’ করে আছেন। পাহাড়িরা সবাই তার উপর আস্হাশীল, এটা আমি মনে করি না। জনসংহতি সমিতিতে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। একটি অংশ আলাদা অবস্হান নিয়েছে। সুতরাং তাকে পাহাড়িদের একক নেতা বলা যাবে না। তবুও দেশের এক শ্রেণীর মানুষ তাকে পাহাড়িদের নেতা মনে করেন। এটি ভুল। বরং সরকারের উচিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। পাহাড়িরা এ অঞ্চলের ভুমিপুত্র নন। অর্থাৎ তারা এ অঞ্চলের মুল বাসিন্দা নন। বরং ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, চাকমারা বাংলাদেশে আশ্রিত একটি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। একাধিক চাকমা বুদ্ধিজীবীর লেখায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। চাকমারা বহিরাগত। তাদের আদি বাসস্হান চম্পকনগর কিংবা পুর্বপুরুষ বিজয়গিরি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ইতিহাসে নেই। ইতিহাসে দেখা গেছে, চাকমা রাজারা মুসলমান নবাব-শাসক-সুবেদার-সুলতানের এত বেশি প্রভাবাধীন ছিলেন যে, তারা তাদের চাকমা নাম পরিহার করে মুসলিম নাম ধারণ করেন (রাজা সুলভ খাঁ ১৭১২, রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫, রাজা সেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭, রাজা দৌলত খাঁ ১৭৭৬ ইত্যাদি)। চাকমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) আনুমানিক দেড়শ’ বছর পরে। ইতিহাস যদি আমাদের এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, তাহলে সন্তু লারমার কী অধিকার আছে ‘সেটলারদের’ (যারা বাঙালি) এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র পুনর্বাসন করার? সন্তু লারমার পুর্বপুরুষদের মতো বাঙালিরাও এ অঞ্চলে বসতি স্হাপন করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। আমরা এর আগে একাধিকবার বলেছি, বাঙালিরা সাংবিধানিক অধিকার বলেই (সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭ ও ৪২ অনুচ্ছেদ) এ অঞ্চলে সন্তু লারমার মতোই বসবাস করছেন। সন্তু লারমা বাঙালিদের পুনর্বাসনের কথা বলে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন এবং এখন সংবিধান লংঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ আনা যায়। তার এই দাবি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন। তবে অত্যন্ত চালাক সন্তু লারমা এবার প্রথমবারের মতো একটি শব্দ যোগ করেছেন। আর তা হচ্ছে ‘সম্মানজনকভাবে’। অর্থাৎ বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে হবে সম্মানজনকভাবে। হায়রে মায়াকান্না! সন্তু লারমা বলেছেন দেশে প্রচুর খাস জমি রয়েছে। সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসন সম্ভব। এটিও মিথ্যা তথ্য। দেশে খাস জমি রয়েছে বটে, তা প্রচুর নয়। উপরন্তু শিল্প-কল-কারখানা স্হাপন করার কারণে দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের জানাচ্ছে যে, গত ২০ বছরে দেশে প্রায় ৫০ লাখ একর কৃষিজমি কমেছে (১৬ আগষ্ট)।
দেশে এভাবে যদি কৃষিজমি কমতে থাকে, তাহলে তা খাদ্য উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। সন্তু বাবু কী চান কৃষিজমিতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এনে বসিয়ে দেয়া হোক? কৃষিজমির পরিমাণ কমিয়ে সন্তু বাবু কি চান বাংলাদেশকে স্হায়ীভাবে খাদ্যে পরনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে? বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এরা যাবে কোথায়? রাষ্ট্র, সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি এ ধরনের দাবি তোলার। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো খাস জমি নেই বলে সন্তু লারমা যে মন্তব্য করেছেন, তা সত্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান ১৯০০ (যা এখনও মেনে চলা হয়) ধারা ৩৪ ও ধারা ৫০-এ খাস জমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৪-এ উল্লেখ করা হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্র ব্যতীত খাস জমি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। আর ধারা ৫০-এ বলা হয়েছে একজন পাহাড়ি হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে ০.৩০ একর খাস জমি দখল করতে পারবেন। খাস জমি যদি নাই থাকে, তাহলে আইনে খাস জমির কথা উল্লেখ করা হলো কেন? আসলে সন্তু লারমা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।
সন্তু লারমা বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল। কথাটা কি সত্য? যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে অন্যায় করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ জন্য রয়েছে সংসদ। সংসদে সিদ্ধান্ত হবে, বিতর্ক হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে কে? তারা কি জেনেভা কনভেনশন লংঘন করছে না? তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, এটা তাদের কাজ নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নে তারা আমাদের পার্টনার; কিন্তু তাদের কোনো অধিকার নেই দেশবাসীকে বিভক্ত করার। প্রসঙ্গক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন এসে গেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তারা কাজ করছে। এটা প্রশংসার যোগ্য; কিন্তু তারা কি সেখানে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কর্মসুচি হাতে নিয়েছে? তারা কি বাঙালি শিশু সন্তানদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছে? নাকি তাদের কর্মসুচি শুধু পাহাড়ি, বিশেষ করে চাকমাদের কেন্দ্র করে? বাঙালি মুসলমানরা কি ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে চাকরি পাচ্ছে? এটা কি সত্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে?
ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে একটি মুল্যায়ন হওয়া উচিত। সন্তু বাবু বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন (!) চলছে। কথাটা কি সত্য? দেশে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। একটি নির্বাচিত সরকার যেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করছে, সেখানে দেশের একটি অংশে সেনাশাসন থাকে কিভাবে? তার এই মন্তব্য কি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি নষ্ট করবে না? আর ৫টি জায়গার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সেনাবাহিনী রয়েছে। পরিস্হিতির অবনতি হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত কয়েকটি সেনাক্যাম্প স্হাপন করা হয়েছিল। সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা যদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত না থাকত, যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতীতে ‘যুদ্ধ’ না করত, তাহলে তো অতিরিক্ত সেনাক্যাম্প স্হাপন করার প্রয়োজন হতো না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্হিতি স্বাভাবিক রাখতেই সেখানে অতিরিক্ত সেনাক্যাম্প স্হাপন করা হয়েছিল। এসব ক্যাম্প রাখতে হবে। কয়েকটি সেনাক্যাম্প এরই মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার ফলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এর মধ্যেই সেখানে আস্তানা গেড়েছে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের এ তথ্যই দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, সন্তু লারমা চান পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো শাসন করুক। এখন সন্তু লারমাকেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সন্তু লারমা যখন সব সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার দাবি করছেন, তখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে তথাকথিত ‘গঞ্জুশ বাহিনী’ ও ‘সন্তুষ বাহিনী’র কথা (নয়া দিগন্ত, ১৯ আগষ্ট)। যারা কাপ্তাই এলাকায় বসবাস করেন, নদীপথে পণ্য আনা-নেয়া করেন, তাদের কাছে ‘গঞ্জুশ বাহিনী’ কিংবা ‘সন্তুষ বাহিনী’র নাম অপরিচিত নয়। এরা চাঁদাবাজ। চাঁদা দেয়া প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামুলক। শান্তি বাহিনীর সাবেক সদস্যরাই (যার নেতা ছিলেন সন্তু লারমা) এখন ‘গঞ্জুশ বাহিনী’ গড়ে তুলে এক ব্যাপক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। সন্তু লারমা এদের কর্মকান্ড বন্ধ করার উদ্যোগ নেননি কেন? তিনি কি চান এই চাঁদা-সংস্কৃতি এখানে চালু থাকুক? তিনি কি চান এ ধরনের হাজারটা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা একটি প্রশাসন গড়ে তুলুক? শান্তি চুক্তির আগে তো পরিস্হিতি তেমনই ছিল। রাষ্ট্র কোনো পর্যায়েই এই চাঁদাবাজি-সংস্কৃতিকে চলতে দিতে পারে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই সেখানে সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন। আমাদের অনেক সন্তান, যারা সেনাবাহিনীতে থেকে মশার কামড় খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, নিজ ভুখন্ড রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেছেন, সন্তু লারমা আজ তাদের কৃতিত্ব না দিয়ে তাদের অবদানকে অস্বীকার করেছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঢাকার চেয়েও শান্তিপুর্ণ বলে যে মন্তব্য সন্তু লারমা করেছেন, তা প্রকারান্তরে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। তিনি তো বলেই দিলেন ঢাকার পরিস্হিতি ভালো নয়। সরকার এ ক্ষেত্রে কী বলবে! মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও বা কী!
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী। যে কারণে রাঙ্গামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে অনগ্রসর লুসাই, চাক, খুমি, খিয়াং, পাংখো, রিয়াং, বোম, তংচঙ্গ্যা, মুরং এবং স্হানীয় বাঙালিরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই; কিন্তু সন্তু লারমা, যিনি চাকমা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি চাচ্ছেন না ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক। কেন? এটা কি এ জন্য যে, তিনি চান না চাক, লুসাই, খুমি, খিয়াং কিংবা পাংখো জাতির কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক? পাহাড়িদের মধ্যে শুধু চাকমারাই (যাদের মাঝে উচ্চশিক্ষার হার ৯০ ভাগের উপরে) উচ্চশিক্ষা নেবে, অন্যরা নেবে না-এটাই কি সন্তু লারমার মনের বাসনা? অন্য জাতি-গোষ্ঠী যদি শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর থাকে, তাহলে ‘চাকমা আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠা করা সহজ। পাংখো কিংবা বোম জাতির কেউ বিসিএস দিয়েছে, ডাক্তার হয়েছে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে-এটা মনে হয় না। অথচ ‘কোটা সিষ্টেমে’র সুবিধা নিয়েছে শুধু চাকমারাই। অনগ্রসর বোম, রিয়াং, পাংখো কিংবা লিয়াংরা এই সুবিধা পায়নি। সংবিধানের ২৮(১) ধারা মতে রাষ্ট্র কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারে না; কিন্তু বৈষম্য তো তৈরি হয়ে গেছেই। এখন সময় এসেছে তা সংশোধন করার। ‘কোটা ব্যবস্হা’ থাকুক; কিন্তু এই ‘কোটা ব্যবস্হায়’ পাহাড়ি ১৩টি জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে দিতে হবে।
সন্তু লারমার এই বক্তব্যে আমি কষ্ট পেয়েছি। এদেশ আমাদের সবার। পাহাড়িরা আলাদা নয়। তারাও এদেশের সন্তান। বাঙালিরাও এদেশের সন্তান। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ নয়, বাংলাদেশেরই একটি এলাকা। বাঙালি আর পাহাড়ি মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের আলাদা ভাবলে চলবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে (সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার) বাঙালিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা দেখতে হবে। সন্তু লারমা অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে আছেন। একটি সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন তাকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়, তখন সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি দখল করে রাখার। সন্তু লারমা পদত্যাগ করে নতুনদের পথ করে দিতে পারেন। আঞ্চলিক পরিষদে নয়া নেতৃত্ব দরকার, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ওই অঞ্চলের উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবেন।
লেখকঃ রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইলঃ tsrahmanbd@yahoo.com (সুত্র, আমার দেশ, ২৩/০৮/২০০৯)
0 comments:
Post a Comment