একজন কুলসুমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এখন থেকে ২৩-২৪ বছর আগে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। আমি তখন পিএইচডির ছাত্র, আর কুলসুম আফগান শরণার্থী, জার্মানিতে আশ্রিত। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত আগ্রাসন কুলসুমকে কাবুল ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টের ‘ওয়াহাব ডলমেচার ব্যুরো’তে আমি নিয়মিত আড্ডা দিতাম, সঙ্গ দিতাম বন্ধু আবদুল ওয়াহাবকে। কুলসুম এসেছিল একটা ডকুমেন্ট অনুবাদ করতে। সেখানেই পরিচয়। অনেকদিন কুলসুম আমাকে মাইন নদীর পাশে তার অ্যাপার্টমেন্টে ‘আফগান ফুড’ রান্না করে খাইয়েছে।
২৩-২৪ বছর পর ২০০৯ সালের নভেম্বরে আফগানিস্তানের নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন মনে পড়ে গেল কুলসুমের কথা। আমি সোভিয়েত বৈদেশিক নীতি নিয়ে গবেষণা করেছি। সঙ্গত কারণেই কুলসুমের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হতো। কুলসুমের এতকিছু বোঝার কথা নয়। পেশায় সে ছিল নার্স। আমার বয়সীই। এক ডাক্তারকে ভালোবেসেছিল। তাকে নিয়ে যখন ঘর বাঁধবে, ঠিক তখনই যুদ্ধে সে ছিটকে পড়ল। কুলসুম আফগানিস্তানে যেতে চাইত। যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা কুলসুম আমাকে অনেকদিন শুনিয়েছে। বলত, যুদ্ধ বন্ধ হলেই সে আফগানিস্তানে ফিরে যাবে। আমি নিশ্চিত নই ফ্রাঙ্কফুর্ট গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে এখনও কুলসুম চাকরি করে কিনা; কিন্তু আমি নিশ্চিত, কুলসুমের আর আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধ সেখানে থামেনি এখনও। গত ৩০ বছর ধরেই দেশটিতে যুদ্ধ চলছে। শুধু যুদ্ধের পক্ষগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে দেশটি যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নিল, তখন শত শত মুজাহিদিন তৈরি হলো, যুদ্ধ করল এরা সোভিয়েত সেনাদের সঙ্গে। এক সময় গর্বাচেভ এসে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার কর নিলেন। ফলে যারা কাবুলে ক্ষমতায় থাকলেন (নজিবুল্লাহ), তারা থাকতে পারলেন না। মুজাহিদিনরা ক্ষমতা নিলেন (১৯৯২); কিন্তু যুদ্ধ থামল না। মুজাহিদিনরা নিজেরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন (গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বনাম বুরহানউদ্দীন রব্বানী)। গঠিত হলো তালেবান (১৯৯৫)। মুজাহিদিনদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে মোল্লা ওমরের তালেবানরা দখল করে নিল কাবুল (১৯৯৬)। যুদ্ধ তখনও বন্ধ হয়নি। তারপর তালেবানরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলো (২০০১)। মার্কিন যুদ্ধবিমান কাবুলে বোমাবর্ষণ করে তালেবানদের হটিয়েছিল সত্য; কিন্তু যুদ্ধ এখনও বন্ধ হয়নি এবং ২০০৯ সালের শেষে এসেও যুদ্ধ যে বন্ধ হবে, তারও আলামত কেউ দেখছে না। যুদ্ধ এখনও চলছে। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, যুদ্ধ আরও কিছুদিন চলবে এবং কুলসুমের মতো ‘যুদ্ধ শরণার্থীরা’ আর কোনোদিনই আফগানিস্তানে ফিরে যেতে পারবেন না।
শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ওবামা, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে এখনও ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। আফগানিস্তানে রয়েছে ২৩ ডিভিশন মার্কিন সৈন্য, সেই সঙ্গে ন্যাটোর রয়েছে আরও ২০ ডিভিশন সৈন্য; কিন্তু তাতে কুলুচ্ছে না। জেনারেল ম্যাকক্রিষ্টাল, যিনি আফগানিস্তানে মার্কিন কমান্ডার, তার চাই আরও সৈন্য। তিনি দেন-দরবার করছেন। আরও ৪০ হাজার সৈন্য তিনি চেয়েছেন বটে; কিন্তু সব না পেলেও কিছু তো পাবেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও ওবামাকে সেখানে সৈন্য পাঠাতেই হবে! আফগানিস্তানের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদ, বিশেষ করে তুর্কমেনিস্তানের গ্যাসের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, চীন থেকে ভারত। পাইপলাইনে এই গ্যাস সরবরাহ করতে হলে দরকার আফগানিস্তানের সাহায্য ও সহযোগিতার (এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তালেবানরাও মিত্র হতে পারে)। তবে এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র তথা জাতিসংঘ অনেক বেশি চিন্তিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে। আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল ২০ আগষ্ট; কিন্তু ব্যাপক ভোট কারচুপি, অনিয়ম আর জালিয়াতির অভিযোগে অনেক ভোট বাতিল হয়ে যায়। ফলে কারজাইয়ের পক্ষে প্রাপ্ত ভোট ৫০ ভাগের নিচে নেমে যায়। আর তাতে করেই সৃষ্টি হয়েছে দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটির। আগামী ৭ নভেম্বর হবে দ্বিতীয় দফা ভোট। কারজাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন একজন, আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট করলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এই আশংকায়।
আফগানিস্তানে তথাকথিত নির্বাচনের নামে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেই গণতন্ত্র শত শত কুলসুমের জন্য আফগানিস্তানে কোনো বার্তা কি বয়ে আনবে? প্রথম দফা নির্বাচনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার (ফরেন পলিসি, ২৪ অক্টোবর), বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ৩ হাজার ৪৫০ কোটি। ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়’ জাতিসংঘ এ অর্থ জুগিয়েছে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয় না হলেও, কিছু অর্থ ব্যয় তো হবেই! ধরে নিচ্ছি সব মিলিয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ব্যয় হবে আফগানিস্তানে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়! অথচ এখনও আফগান শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। স্বাস্হ্যসেবা এক রকম নেই বললেই চলে। মেয়েদের শিক্ষা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্ধ। যুদ্ধের কারণে অবকাঠামো ভেঙে গেছে পরিপুর্ণভাবে। এই ৫ হাজার কোটি টাকায় বেশক’টি স্কুল করা যেত, হাসপাতালও করা যেত বেশক’টি। এখন শুধু হামিদ কারজাইকে বৈধতা দেয়ার জন্যই ব্যয় করা হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকা! প্রথম দফা নির্বাচনে যারা ভোট দিয়েছিল, তাদের কারও কারও বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল তালেবানরা। তারা এবারও নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়েছে। নির্বাচনে খুব যে ভোট পড়বে, তা মনে হয় না। নির্বাচন আফগান জনগণের জন্য কোনো শুভবার্তা বয়ে আনবে না। নিশ্চিত করতে পারবে না স্হিতিশীলতা। কারজাই যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত(?) হনও, তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। প্রথমত, তিনি নিজে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, প্রথম দফা নির্বাচনে আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিলেন। সেই অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় একই অভিযোগ তিনি আনলেন। কারজাইয়ের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি হিলারি ক্লিনটন নিজেও চান কারজাই বিজয়ী হোক। তাতে করে কারজাইকে সামনে রেখে নীতি প্রণয়ন করা সহজ। কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে কারজাইয়ের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারজাইকে সামনে রেখে একটি মাফিয়াচক্র এখন কাবুলের ক্ষমতা পরিচালনা করছে, যাকে বলা হচ্ছে------। এই চক্রে রয়েছে তার দুই ভাই আহমেদ ওয়ালি, যিনি সিআইএ’র প্যারোলে ছিলেন ও মাহমুদ, যুদ্ধবাজ নেতা শের মোহাম্মদ আখুনজাদা, জেনারেল দোস্তাম, জেনারেল ফাহিম, মোহাক্কিক প্রমুখ। মাদক ব্যবসার সঙ্গে এদের অনেকে জড়িত। হিলারি ক্লিনটন এক সময় আফগানিস্তানকে চিহ্নিত করেছিলেন --- হিসেবে, অর্থাৎ রাষ্ট্র যেখানে অবৈধ মাদক উৎপাদন ও বিপণনকে উৎসাহিত করে। এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এখন কারজাইয়ের অন্যতম পরামর্শদাতা। টিআই’র রিপোর্টে আফগানিস্তানকে ৫ম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর দুর্নীতিবাজরাই এখন কারজাইয়ের ক্ষমতার উৎস। এসব হোয়াইট হাউস প্রশাসনের অজানা নয়। তারা জানেন। তারপরও তারা কারজাইকে সমর্থন করছেন শুধু জাতীয় স্বার্থের কারণে।
৭ নভেম্বরের নির্বাচনে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান একজন ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডেন্ট পাবে সত্য; কিন্তু তিনি আফগানিস্তানের শান্তি ও স্হিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারবেন না। তালেবানরা যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা আরও বেশি সংগঠিত। আফগানিস্তানে স্হিতিশীলতা নিশ্চিত করার পথ একটাই-তালেবানদের সঙ্গে ‘সংলাপ’-এ যাওয়া ও আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার নিশ্চিত করা। যতদিন আফগানিস্তানে বিদেশি সৈন্য থাকবে, ততদিন তালেবানদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকবেই। সাধারণ মানুষ তালেবানদের রাজনীতি সমর্থন করেন না; কিন্তু বিদেশি সেনা উপস্হিতিও তারা সমর্থন করেন না। সাধারণ আফগানরা ধর্মভীরু। কুলসুমকে দেখেছি জার্মান নাগরিকত্ব নিয়েও সে তার মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি। তাই সাধারণ আফগানরা বিদেশি সংস্কৃতির উপস্হিতি কোনোক্রমেই মেনে নেবে না। অতীতেও নেয়নি, আগামীতেও নেবে না। তাই ওয়াশিংটন পোষ্টে ইউগেন রবিনসন যখন মন্তব্য করেন------, তখন তিনি সত্য কথাটাই বলেন। যারা গর্ডন গোল্ডষ্টাইন -এর কালে পঠিত গ্রন্হ ------পড়েছেন, তারা জানেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কী মুল্য দিতে হয়েছিল। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছিল ৫৭০ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ের অর্থের পরিমাণ, বর্তমান বিচারে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। ২০০১ থেকে এখন অব্দি, অথবা আফগান যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ কত হতে পারে-এ পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই; কিন্তু এর পরিমাণ যে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার হবে-তা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। তাই একজন ----- (ইউগেন রবিনসনের ভাষায়) যদি সত্যি সত্যিই সেনা প্রত্যাহারের একটি সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি যৌক্তিক হবে এবং নিঃসন্দেহে তিনি জনপ্রিয় হবেন। তাই ৫ হাজার কোটি টাকার নির্বাচনের আদৌ কোনো মুল্য নেই আফগান জনগণের কাছে।
পুনশ্চ, গত ২৫ অক্টোবর আমার কলাম (প্রসঙ্গ জ্বালানি নিরাপত্তা ও রনো ভাইয়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে) প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আমাকে জানিয়েছেন, তিনি শুধু একবার ১৯৯৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তবে দু’বার কানাডায় গেছেন। তাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন। (সুত্র,আমার দেশ, ০১/১১/২০০৯)
২৩-২৪ বছর পর ২০০৯ সালের নভেম্বরে আফগানিস্তানের নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন মনে পড়ে গেল কুলসুমের কথা। আমি সোভিয়েত বৈদেশিক নীতি নিয়ে গবেষণা করেছি। সঙ্গত কারণেই কুলসুমের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হতো। কুলসুমের এতকিছু বোঝার কথা নয়। পেশায় সে ছিল নার্স। আমার বয়সীই। এক ডাক্তারকে ভালোবেসেছিল। তাকে নিয়ে যখন ঘর বাঁধবে, ঠিক তখনই যুদ্ধে সে ছিটকে পড়ল। কুলসুম আফগানিস্তানে যেতে চাইত। যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা কুলসুম আমাকে অনেকদিন শুনিয়েছে। বলত, যুদ্ধ বন্ধ হলেই সে আফগানিস্তানে ফিরে যাবে। আমি নিশ্চিত নই ফ্রাঙ্কফুর্ট গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে এখনও কুলসুম চাকরি করে কিনা; কিন্তু আমি নিশ্চিত, কুলসুমের আর আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধ সেখানে থামেনি এখনও। গত ৩০ বছর ধরেই দেশটিতে যুদ্ধ চলছে। শুধু যুদ্ধের পক্ষগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে দেশটি যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নিল, তখন শত শত মুজাহিদিন তৈরি হলো, যুদ্ধ করল এরা সোভিয়েত সেনাদের সঙ্গে। এক সময় গর্বাচেভ এসে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার কর নিলেন। ফলে যারা কাবুলে ক্ষমতায় থাকলেন (নজিবুল্লাহ), তারা থাকতে পারলেন না। মুজাহিদিনরা ক্ষমতা নিলেন (১৯৯২); কিন্তু যুদ্ধ থামল না। মুজাহিদিনরা নিজেরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন (গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বনাম বুরহানউদ্দীন রব্বানী)। গঠিত হলো তালেবান (১৯৯৫)। মুজাহিদিনদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে মোল্লা ওমরের তালেবানরা দখল করে নিল কাবুল (১৯৯৬)। যুদ্ধ তখনও বন্ধ হয়নি। তারপর তালেবানরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলো (২০০১)। মার্কিন যুদ্ধবিমান কাবুলে বোমাবর্ষণ করে তালেবানদের হটিয়েছিল সত্য; কিন্তু যুদ্ধ এখনও বন্ধ হয়নি এবং ২০০৯ সালের শেষে এসেও যুদ্ধ যে বন্ধ হবে, তারও আলামত কেউ দেখছে না। যুদ্ধ এখনও চলছে। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, যুদ্ধ আরও কিছুদিন চলবে এবং কুলসুমের মতো ‘যুদ্ধ শরণার্থীরা’ আর কোনোদিনই আফগানিস্তানে ফিরে যেতে পারবেন না।
শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ওবামা, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে এখনও ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। আফগানিস্তানে রয়েছে ২৩ ডিভিশন মার্কিন সৈন্য, সেই সঙ্গে ন্যাটোর রয়েছে আরও ২০ ডিভিশন সৈন্য; কিন্তু তাতে কুলুচ্ছে না। জেনারেল ম্যাকক্রিষ্টাল, যিনি আফগানিস্তানে মার্কিন কমান্ডার, তার চাই আরও সৈন্য। তিনি দেন-দরবার করছেন। আরও ৪০ হাজার সৈন্য তিনি চেয়েছেন বটে; কিন্তু সব না পেলেও কিছু তো পাবেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও ওবামাকে সেখানে সৈন্য পাঠাতেই হবে! আফগানিস্তানের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদ, বিশেষ করে তুর্কমেনিস্তানের গ্যাসের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, চীন থেকে ভারত। পাইপলাইনে এই গ্যাস সরবরাহ করতে হলে দরকার আফগানিস্তানের সাহায্য ও সহযোগিতার (এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তালেবানরাও মিত্র হতে পারে)। তবে এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র তথা জাতিসংঘ অনেক বেশি চিন্তিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে। আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল ২০ আগষ্ট; কিন্তু ব্যাপক ভোট কারচুপি, অনিয়ম আর জালিয়াতির অভিযোগে অনেক ভোট বাতিল হয়ে যায়। ফলে কারজাইয়ের পক্ষে প্রাপ্ত ভোট ৫০ ভাগের নিচে নেমে যায়। আর তাতে করেই সৃষ্টি হয়েছে দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটির। আগামী ৭ নভেম্বর হবে দ্বিতীয় দফা ভোট। কারজাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন একজন, আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট করলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এই আশংকায়।
আফগানিস্তানে তথাকথিত নির্বাচনের নামে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেই গণতন্ত্র শত শত কুলসুমের জন্য আফগানিস্তানে কোনো বার্তা কি বয়ে আনবে? প্রথম দফা নির্বাচনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার (ফরেন পলিসি, ২৪ অক্টোবর), বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ৩ হাজার ৪৫০ কোটি। ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়’ জাতিসংঘ এ অর্থ জুগিয়েছে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয় না হলেও, কিছু অর্থ ব্যয় তো হবেই! ধরে নিচ্ছি সব মিলিয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ব্যয় হবে আফগানিস্তানে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়! অথচ এখনও আফগান শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। স্বাস্হ্যসেবা এক রকম নেই বললেই চলে। মেয়েদের শিক্ষা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্ধ। যুদ্ধের কারণে অবকাঠামো ভেঙে গেছে পরিপুর্ণভাবে। এই ৫ হাজার কোটি টাকায় বেশক’টি স্কুল করা যেত, হাসপাতালও করা যেত বেশক’টি। এখন শুধু হামিদ কারজাইকে বৈধতা দেয়ার জন্যই ব্যয় করা হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকা! প্রথম দফা নির্বাচনে যারা ভোট দিয়েছিল, তাদের কারও কারও বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল তালেবানরা। তারা এবারও নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়েছে। নির্বাচনে খুব যে ভোট পড়বে, তা মনে হয় না। নির্বাচন আফগান জনগণের জন্য কোনো শুভবার্তা বয়ে আনবে না। নিশ্চিত করতে পারবে না স্হিতিশীলতা। কারজাই যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত(?) হনও, তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। প্রথমত, তিনি নিজে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, প্রথম দফা নির্বাচনে আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিলেন। সেই অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় একই অভিযোগ তিনি আনলেন। কারজাইয়ের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি হিলারি ক্লিনটন নিজেও চান কারজাই বিজয়ী হোক। তাতে করে কারজাইকে সামনে রেখে নীতি প্রণয়ন করা সহজ। কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে কারজাইয়ের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারজাইকে সামনে রেখে একটি মাফিয়াচক্র এখন কাবুলের ক্ষমতা পরিচালনা করছে, যাকে বলা হচ্ছে------। এই চক্রে রয়েছে তার দুই ভাই আহমেদ ওয়ালি, যিনি সিআইএ’র প্যারোলে ছিলেন ও মাহমুদ, যুদ্ধবাজ নেতা শের মোহাম্মদ আখুনজাদা, জেনারেল দোস্তাম, জেনারেল ফাহিম, মোহাক্কিক প্রমুখ। মাদক ব্যবসার সঙ্গে এদের অনেকে জড়িত। হিলারি ক্লিনটন এক সময় আফগানিস্তানকে চিহ্নিত করেছিলেন --- হিসেবে, অর্থাৎ রাষ্ট্র যেখানে অবৈধ মাদক উৎপাদন ও বিপণনকে উৎসাহিত করে। এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এখন কারজাইয়ের অন্যতম পরামর্শদাতা। টিআই’র রিপোর্টে আফগানিস্তানকে ৫ম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর দুর্নীতিবাজরাই এখন কারজাইয়ের ক্ষমতার উৎস। এসব হোয়াইট হাউস প্রশাসনের অজানা নয়। তারা জানেন। তারপরও তারা কারজাইকে সমর্থন করছেন শুধু জাতীয় স্বার্থের কারণে।
৭ নভেম্বরের নির্বাচনে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান একজন ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডেন্ট পাবে সত্য; কিন্তু তিনি আফগানিস্তানের শান্তি ও স্হিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারবেন না। তালেবানরা যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা আরও বেশি সংগঠিত। আফগানিস্তানে স্হিতিশীলতা নিশ্চিত করার পথ একটাই-তালেবানদের সঙ্গে ‘সংলাপ’-এ যাওয়া ও আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার নিশ্চিত করা। যতদিন আফগানিস্তানে বিদেশি সৈন্য থাকবে, ততদিন তালেবানদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকবেই। সাধারণ মানুষ তালেবানদের রাজনীতি সমর্থন করেন না; কিন্তু বিদেশি সেনা উপস্হিতিও তারা সমর্থন করেন না। সাধারণ আফগানরা ধর্মভীরু। কুলসুমকে দেখেছি জার্মান নাগরিকত্ব নিয়েও সে তার মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি। তাই সাধারণ আফগানরা বিদেশি সংস্কৃতির উপস্হিতি কোনোক্রমেই মেনে নেবে না। অতীতেও নেয়নি, আগামীতেও নেবে না। তাই ওয়াশিংটন পোষ্টে ইউগেন রবিনসন যখন মন্তব্য করেন------, তখন তিনি সত্য কথাটাই বলেন। যারা গর্ডন গোল্ডষ্টাইন -এর কালে পঠিত গ্রন্হ ------পড়েছেন, তারা জানেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কী মুল্য দিতে হয়েছিল। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছিল ৫৭০ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ের অর্থের পরিমাণ, বর্তমান বিচারে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। ২০০১ থেকে এখন অব্দি, অথবা আফগান যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ কত হতে পারে-এ পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই; কিন্তু এর পরিমাণ যে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার হবে-তা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। তাই একজন ----- (ইউগেন রবিনসনের ভাষায়) যদি সত্যি সত্যিই সেনা প্রত্যাহারের একটি সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি যৌক্তিক হবে এবং নিঃসন্দেহে তিনি জনপ্রিয় হবেন। তাই ৫ হাজার কোটি টাকার নির্বাচনের আদৌ কোনো মুল্য নেই আফগান জনগণের কাছে।
পুনশ্চ, গত ২৫ অক্টোবর আমার কলাম (প্রসঙ্গ জ্বালানি নিরাপত্তা ও রনো ভাইয়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে) প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আমাকে জানিয়েছেন, তিনি শুধু একবার ১৯৯৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তবে দু’বার কানাডায় গেছেন। তাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন। (সুত্র,আমার দেশ, ০১/১১/২০০৯)
0 comments:
Post a Comment