যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার চীন সফর শেষ করেছেন। এই সফরে ওবামা ও চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও পরস্পরের মধ্যে নতুন এবং গভীর অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও বেশকটি ইস্যুতে এই দুটো দেশের মধ্যে মতানৈক্য রয়ে গেছে। এই মতানৈক্য বিশ্ব রাজনীতিতে কতটুকু প্রতিফলিত হয়, সেটা এখন দেখার বিষয়। ওবামার সঙ্গে আলোচনায় ওয়েন জিয়াবাও যখন বলেন, ‘সংঘর্ষের চেয়ে আলোচনাই উত্তম, আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে অংশীদারিত্ব ভালো’, তখন তা শুনতে ভালোই শোনায়। কিন্তু
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও মুদ্রানীতিতে দুটো দেশ একমত হতে না পারায় তা ওবামার চীন সফরের সাফল্যকে কিছুটা হলেও ্লান করে দিয়েছে। ওয়াশিংটন মনে করে, চীনা ইউয়ানের মুল্য অনেক কম; কিন্তু চীনা নেতারা এটা মানতে রাজি নন। ইরানের ব্যাপারেও দুই দেশ এক হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতকে চীনের অংশ বলে মনে করলেও দালাইলামার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পক্ষে হোয়াইট হাউস প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে চীনা নেতাদের অবস্হান ভিন্ন। উত্তর কোরিয়াকে ছয় জাতি আলোচনায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দু’দেশই একমত হয়েছে। দু’দেশ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে ওবামার প্রথম চীন সফর কোনো বড় ধরনের বিরোধ সৃষ্টি করতে না পারলেও স্পষ্টতই মতপার্থক্য রয়েই গেছে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব বাড়ছে। এখন এই একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চীন কী ভুমিকা নেয়, সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়।
ওবামা চীন সফরের আগে রাশিয়া সফর করেছিলেন গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে। তখনও কিছু কিছু বিষয়ে রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে তার দ্বিমত থেকে গিয়েছিল। বিশেষ করে রাশিয়া ন্যাটোর পুর্বমুখী সম্প্রসারণে আদৌ খুশি নয়। শুধু তাই নয়, পুর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্হারও বিরুদ্ধে রাশিয়া। যদিও ওবামা মস্কো থেকে ফিরে আসার পর এই মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা বাতিল ঘোষণা করেছেন। এর ফলে রাশিয়া পোল্যান্ডের সীমান্তে কালিনিনগ্রাদে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তাও বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছে। এতে করে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক উন্নত হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে (---) জর্জিয়ার সঙ্গে একটি নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছিল, যা ক্রেমলিনকে খুশি করতে পারেনি। জর্জিয়ার ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করছে রাশিয়া। তখন রাশিয়ার পর চীনের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে এই দুটো দেশের সঙ্গেই আগামীতে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে যুক্তরাষ্ট্রের। সম্পর্কের অবনতি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা।
যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন ওবামা প্রশাসন একটি ‘নতুন প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে হোয়াইট হাউসে এলেও গত দশ মাসে বলকান, ইরাক, ল্যাটিন আমেরিকায় তার পুর্বসুরি বুশের নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনেননি। কসোভোতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি করেছে ও সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও সেই সম্ভাবনা এখন কমে আসছে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার সম্ভাবনা আদৌ নেই; বরং সেখানে আরও ৪০ হাজার সেনা পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে ওবামা প্রশাসন। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট বার্ষিক ব্যয় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অর্থ যোগান দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। অথচ এই অর্থের একটি অংশ দিয়ে বিশ্বের শত কোটি মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানো যায়। বিশ্বে সামরিক খাতে যত ব্যয় হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র। সিপরি’র (---) মতে, ২০০৯ সালে বিশ্ব সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১ দশমিক ৪৬৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত সামরিক খাতে বাজেটের পরিমাণ ৬৮০ বিলিয়ন ডলার। ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি কংগ্রেসের কাছে আরও ৮৫ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য। যদি সুক্ষ্মভাবে খোঁজ নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ৬টি মহাদেশের প্রায় প্রতিটিতেই যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। এমনকি এন্টার্কটিকা মহাদেশেও ৫৪টি ‘সামরিক মিশন’ রয়েছে তাদের (----)।
যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী, ১১টি বিমানবাহী জাহাজ, ৬টি নৌ-ফ্লিট ও অত্যাধুনিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা, যা কিনা শত্রুর ছোড়া যে কোনো মিসাইল রকেট ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্হান শক্তিশালী করেছে। কিরঘিজস্তানের মানাস বিমানঘাঁটি ব্যবহারের সুবিধা তার রয়েছে। আর আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি (৩৯৯৩ একর থেকে ৫১৯৮ একর) সম্প্রসারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর্মেনিয়াসহ আরও ৭টি দেশকে নিয়ে রাশিয়া গঠন করেছিল একটি নিরাপত্তা সংস্হা, ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ (-----)। যুক্তরাষ্ট্র সেখানেও ‘বাগড়া’ দিয়েছে। আর্মেনিয়া থেকে এক কন্টিনজেন্ট সেনা সংগ্রহ করে তা যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে কসোভোতে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখন তা মোতায়েন করা হবে আফগানিস্তানে। বাল্টিক সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর রয়েছে বিমানবাহী জাহাজ ‘ইউএস কোল’। লিথুনিয়ার নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অষ্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফিনল্যান্ডেও রয়েছে তার উপস্হিতি। কৃষ্ণ সাগরে (---) যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্হিতি এ অঞ্চলে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ---। রুমানিয়ার শহর কনসটানজার কাছাকাছি মিখাইল শেগালনাইসেনু বিমানঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দফতর। বুলগেরিয়া ও রুমানিয়ার ৭টি বিমানঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। দেশ দুটো এখন ন্যাটোর সদস্য। চেক রিপাবলিকে সীমিত পরিসরে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তুলছে যুক্তরাষ্ট্র। পোল্যান্ডেও একই ব্যবস্হা নিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকাতেও যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্হান শক্তিশালী করেছে। কলাম্বিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ১০ বছরের সামরিক চুক্তি।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আলভারো উরিবে সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আন্দ্রেয়ান (---) অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলের ৭টি গুরুত্বপুর্ণ বিমানঘাঁটি (বানানকুইলা, সান আন্দ্রেয়াস, কার্টাজেনা, বোগোটা, বালি, মেডিলিন ও বুকারামাঙ্গা) এবং সেই সঙ্গে সেনাসদর দফতরও ব্যবহার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলের পালানকোয়েরো ঘাঁটি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সারা দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ কারণেই ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের বড় ভয়। তিনি ‘সম্ভাব্য’ একটি যুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাকে উৎখাতের কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে সারা ল্যাটিন আমেরিকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। অনেকেরই হয়তো স্মরণ থাকার কথা-যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো আফ্রিকাতে নতুন একটি কমান্ড গঠন করেছে (---)। এই কমান্ড নিয়েও নানা কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মালি ও সেনেগালে সেখানকার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গ্যাবন ও উগান্ডাতেও যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নৌপ্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার-সার্বক্ষণিক উপস্হিতি রয়েছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর। আর --- প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘যে কোনো হস্তক্ষেপের’ সম্ভাবনা আরও বাড়ল। সুদান ও সোমালিয়ার ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। এ দুটো দেশে ইসলামিক উগ্রপন্হীদের তৎপরতা রয়েছে। সুদানে চীনা সেনাবাহিনীর সীমিত উপস্হিতি রয়েছে। কেননা, চীন সুদান থেকে জ্বালানি নিয়ে থাকে। এখানে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। সুদানের তেল স্হাপনায় চীনা বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এই সেনা উপস্হিতি। পেন্টাগনের নজরে যে বিষয়টি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। পাঠক, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ সামরিক মহড়ার অনেক খবরই আপনারা জানেন। গত ৩০ অক্টোবর যে সামরিক মহড়া হয় (----), তার সংবাদ কি আপনাদের কাছে আছে? সম্ভবত বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্রেই এই যৌথ মহড়ার সংবাদটি প্রকাশিত হয়নি। দু’সপ্তাহব্যাপী এই প্রশিক্ষণের সময় উপস্হিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান জেনারেল বেঞ্জামিন মিস্ক্রন। এই প্রশিক্ষণে এক একটি ১৯ টন ওজনের ১৭টি ‘হেভি আরমারড ভেহিকল’ ব্যবহার করা হয়েছিল। এগুলো এখন মুম্বাইয়ে নিয়োজিত করা হয়েছে। এর আগে ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ নৌমহড়ায়ও অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। পাঠক, আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই কুয়েতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর উপস্হিতি রয়েছে। আর বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম ফ্লিটের ঘাঁটি। সৌদি আরবের কথা না হয় নাইবা বললাম। আর অতি সম্প্রতি ইয়েমেনে শিয়া বিদ্রোহীদের দমনে সে দেশের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যারা সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক, তারা লক্ষ্য করে থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন সিনিয়র সেনাকর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এরা হচ্ছেন-জেনারেল মিস্ক্রন (প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান), ভাইস অ্যাডমিরাল জন বার্ড (৭ম ফ্লিটের প্রধান) ও মেজর জেনারেল রুডলফ এলেস (ম্যারিন কোরের কমান্ডার)। ধারণা করছি, এ অঞ্চলে ‘স্হিতিশীলতার’ স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিট একটি গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করবে আগামী দিনে। ভারতে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও বাংলাদেশে তাদের সফর এ কথাই প্রমাণ করে।
বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর এই যে ‘উপস্হিতি’, তা চীন এবং রাশিয়া কীভাবে নেবে-এটা লক্ষ্য করার বিষয়। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো। তারা সাংহাই সহযোগিতা সংস্হারও সদস্য। আগামীতে তাদের স্বার্থ এক হতে পারে। চীনা প্রধানমন্ত্রী ‘অংশীদারিত্বের’ কথা বলেছেন। এটাই বিশ্ব রাজনীতির মোদ্দা কথা। আধিপত্য নয়, প্রভাব বিস্তার নয়, সামরিক আগ্রাসনও নয়, দরকার সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব। তাহলেই বিশ্বে স্হিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং আমরা একটি শান্তিপ্রিয় বিশ্ব পাব। ‘শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া’ ওবামার জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি যদি সত্যি সত্যিই ‘আগ্রাসী মনোভাব’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনতে পারেন তাহলে তার ‘নোবেল প্রাপ্তি’ সার্থক হবে।
লেখকঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক (সুত্র, আমার দেশ, ২২/১১/২০০৯)
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও মুদ্রানীতিতে দুটো দেশ একমত হতে না পারায় তা ওবামার চীন সফরের সাফল্যকে কিছুটা হলেও ্লান করে দিয়েছে। ওয়াশিংটন মনে করে, চীনা ইউয়ানের মুল্য অনেক কম; কিন্তু চীনা নেতারা এটা মানতে রাজি নন। ইরানের ব্যাপারেও দুই দেশ এক হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতকে চীনের অংশ বলে মনে করলেও দালাইলামার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পক্ষে হোয়াইট হাউস প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে চীনা নেতাদের অবস্হান ভিন্ন। উত্তর কোরিয়াকে ছয় জাতি আলোচনায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দু’দেশই একমত হয়েছে। দু’দেশ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে ওবামার প্রথম চীন সফর কোনো বড় ধরনের বিরোধ সৃষ্টি করতে না পারলেও স্পষ্টতই মতপার্থক্য রয়েই গেছে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব বাড়ছে। এখন এই একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চীন কী ভুমিকা নেয়, সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়।
ওবামা চীন সফরের আগে রাশিয়া সফর করেছিলেন গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে। তখনও কিছু কিছু বিষয়ে রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে তার দ্বিমত থেকে গিয়েছিল। বিশেষ করে রাশিয়া ন্যাটোর পুর্বমুখী সম্প্রসারণে আদৌ খুশি নয়। শুধু তাই নয়, পুর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্হারও বিরুদ্ধে রাশিয়া। যদিও ওবামা মস্কো থেকে ফিরে আসার পর এই মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা বাতিল ঘোষণা করেছেন। এর ফলে রাশিয়া পোল্যান্ডের সীমান্তে কালিনিনগ্রাদে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তাও বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছে। এতে করে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক উন্নত হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে (---) জর্জিয়ার সঙ্গে একটি নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছিল, যা ক্রেমলিনকে খুশি করতে পারেনি। জর্জিয়ার ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করছে রাশিয়া। তখন রাশিয়ার পর চীনের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে এই দুটো দেশের সঙ্গেই আগামীতে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে যুক্তরাষ্ট্রের। সম্পর্কের অবনতি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা।
যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন ওবামা প্রশাসন একটি ‘নতুন প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে হোয়াইট হাউসে এলেও গত দশ মাসে বলকান, ইরাক, ল্যাটিন আমেরিকায় তার পুর্বসুরি বুশের নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনেননি। কসোভোতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি করেছে ও সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও সেই সম্ভাবনা এখন কমে আসছে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার সম্ভাবনা আদৌ নেই; বরং সেখানে আরও ৪০ হাজার সেনা পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে ওবামা প্রশাসন। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট বার্ষিক ব্যয় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অর্থ যোগান দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। অথচ এই অর্থের একটি অংশ দিয়ে বিশ্বের শত কোটি মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানো যায়। বিশ্বে সামরিক খাতে যত ব্যয় হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র। সিপরি’র (---) মতে, ২০০৯ সালে বিশ্ব সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১ দশমিক ৪৬৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত সামরিক খাতে বাজেটের পরিমাণ ৬৮০ বিলিয়ন ডলার। ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি কংগ্রেসের কাছে আরও ৮৫ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য। যদি সুক্ষ্মভাবে খোঁজ নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ৬টি মহাদেশের প্রায় প্রতিটিতেই যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। এমনকি এন্টার্কটিকা মহাদেশেও ৫৪টি ‘সামরিক মিশন’ রয়েছে তাদের (----)।
যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী, ১১টি বিমানবাহী জাহাজ, ৬টি নৌ-ফ্লিট ও অত্যাধুনিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা, যা কিনা শত্রুর ছোড়া যে কোনো মিসাইল রকেট ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্হান শক্তিশালী করেছে। কিরঘিজস্তানের মানাস বিমানঘাঁটি ব্যবহারের সুবিধা তার রয়েছে। আর আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি (৩৯৯৩ একর থেকে ৫১৯৮ একর) সম্প্রসারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর্মেনিয়াসহ আরও ৭টি দেশকে নিয়ে রাশিয়া গঠন করেছিল একটি নিরাপত্তা সংস্হা, ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ (-----)। যুক্তরাষ্ট্র সেখানেও ‘বাগড়া’ দিয়েছে। আর্মেনিয়া থেকে এক কন্টিনজেন্ট সেনা সংগ্রহ করে তা যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে কসোভোতে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখন তা মোতায়েন করা হবে আফগানিস্তানে। বাল্টিক সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর রয়েছে বিমানবাহী জাহাজ ‘ইউএস কোল’। লিথুনিয়ার নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অষ্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফিনল্যান্ডেও রয়েছে তার উপস্হিতি। কৃষ্ণ সাগরে (---) যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্হিতি এ অঞ্চলে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ---। রুমানিয়ার শহর কনসটানজার কাছাকাছি মিখাইল শেগালনাইসেনু বিমানঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দফতর। বুলগেরিয়া ও রুমানিয়ার ৭টি বিমানঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। দেশ দুটো এখন ন্যাটোর সদস্য। চেক রিপাবলিকে সীমিত পরিসরে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তুলছে যুক্তরাষ্ট্র। পোল্যান্ডেও একই ব্যবস্হা নিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকাতেও যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্হান শক্তিশালী করেছে। কলাম্বিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ১০ বছরের সামরিক চুক্তি।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আলভারো উরিবে সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আন্দ্রেয়ান (---) অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলের ৭টি গুরুত্বপুর্ণ বিমানঘাঁটি (বানানকুইলা, সান আন্দ্রেয়াস, কার্টাজেনা, বোগোটা, বালি, মেডিলিন ও বুকারামাঙ্গা) এবং সেই সঙ্গে সেনাসদর দফতরও ব্যবহার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলের পালানকোয়েরো ঘাঁটি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সারা দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ কারণেই ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের বড় ভয়। তিনি ‘সম্ভাব্য’ একটি যুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাকে উৎখাতের কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে সারা ল্যাটিন আমেরিকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। অনেকেরই হয়তো স্মরণ থাকার কথা-যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো আফ্রিকাতে নতুন একটি কমান্ড গঠন করেছে (---)। এই কমান্ড নিয়েও নানা কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মালি ও সেনেগালে সেখানকার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গ্যাবন ও উগান্ডাতেও যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নৌপ্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার-সার্বক্ষণিক উপস্হিতি রয়েছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর। আর --- প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘যে কোনো হস্তক্ষেপের’ সম্ভাবনা আরও বাড়ল। সুদান ও সোমালিয়ার ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। এ দুটো দেশে ইসলামিক উগ্রপন্হীদের তৎপরতা রয়েছে। সুদানে চীনা সেনাবাহিনীর সীমিত উপস্হিতি রয়েছে। কেননা, চীন সুদান থেকে জ্বালানি নিয়ে থাকে। এখানে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। সুদানের তেল স্হাপনায় চীনা বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এই সেনা উপস্হিতি। পেন্টাগনের নজরে যে বিষয়টি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। পাঠক, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ সামরিক মহড়ার অনেক খবরই আপনারা জানেন। গত ৩০ অক্টোবর যে সামরিক মহড়া হয় (----), তার সংবাদ কি আপনাদের কাছে আছে? সম্ভবত বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্রেই এই যৌথ মহড়ার সংবাদটি প্রকাশিত হয়নি। দু’সপ্তাহব্যাপী এই প্রশিক্ষণের সময় উপস্হিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান জেনারেল বেঞ্জামিন মিস্ক্রন। এই প্রশিক্ষণে এক একটি ১৯ টন ওজনের ১৭টি ‘হেভি আরমারড ভেহিকল’ ব্যবহার করা হয়েছিল। এগুলো এখন মুম্বাইয়ে নিয়োজিত করা হয়েছে। এর আগে ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ নৌমহড়ায়ও অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। পাঠক, আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই কুয়েতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর উপস্হিতি রয়েছে। আর বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম ফ্লিটের ঘাঁটি। সৌদি আরবের কথা না হয় নাইবা বললাম। আর অতি সম্প্রতি ইয়েমেনে শিয়া বিদ্রোহীদের দমনে সে দেশের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যারা সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক, তারা লক্ষ্য করে থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন সিনিয়র সেনাকর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এরা হচ্ছেন-জেনারেল মিস্ক্রন (প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান), ভাইস অ্যাডমিরাল জন বার্ড (৭ম ফ্লিটের প্রধান) ও মেজর জেনারেল রুডলফ এলেস (ম্যারিন কোরের কমান্ডার)। ধারণা করছি, এ অঞ্চলে ‘স্হিতিশীলতার’ স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিট একটি গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করবে আগামী দিনে। ভারতে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও বাংলাদেশে তাদের সফর এ কথাই প্রমাণ করে।
বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর এই যে ‘উপস্হিতি’, তা চীন এবং রাশিয়া কীভাবে নেবে-এটা লক্ষ্য করার বিষয়। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো। তারা সাংহাই সহযোগিতা সংস্হারও সদস্য। আগামীতে তাদের স্বার্থ এক হতে পারে। চীনা প্রধানমন্ত্রী ‘অংশীদারিত্বের’ কথা বলেছেন। এটাই বিশ্ব রাজনীতির মোদ্দা কথা। আধিপত্য নয়, প্রভাব বিস্তার নয়, সামরিক আগ্রাসনও নয়, দরকার সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব। তাহলেই বিশ্বে স্হিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং আমরা একটি শান্তিপ্রিয় বিশ্ব পাব। ‘শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া’ ওবামার জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি যদি সত্যি সত্যিই ‘আগ্রাসী মনোভাব’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনতে পারেন তাহলে তার ‘নোবেল প্রাপ্তি’ সার্থক হবে।
লেখকঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক (সুত্র, আমার দেশ, ২২/১১/২০০৯)
0 comments:
Post a Comment