জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়াকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ কি আসন্ন? নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ওই সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘লিবিয়ায় জনসাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে যে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’ নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি সদস্য দেশ ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থাকে, আর ১০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। লিবিয়ার সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলেও লিবিয়ার সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বরং সহিংসতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে সেখানে কর্মরত বিদেশীরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিদেশীরা ছিল গাদ্দাফি সমর্থকদের টার্গেট।
এমনকি লিবিয়ার এই সঙ্কটে গাদ্দাফি উত্তর আফ্রিকার ভাড়াটে সৈন্যদের পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। সেখানে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। হাজার হাজার মানুষ, যাদের প্রায় সবাই বিদেশী, তারা লিবিয়া-তিউনিশিয়া সীমান্তে অবস্থান করছেন শুধু নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের আশায়। এরই মধ্যে লিবিয়ায় গাদ্দাফি সমর্থক ও বিরোধীদের মাঝে ‘যুদ্ধ’ আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। গাদ্দাফি বিরোধীরা পূর্বাঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও গাদ্দাফি সমর্থক সেনাবাহিনী এখন পূর্বাঞ্চল দখল করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদ এই সিদ্ধান্ত নিল। যদিও এই সিদ্ধান্তে সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়নি। কিন্তু প্রয়োজনে ‘যে কোন ব্যবস্থা’ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ‘যে কোন ব্যবস্থার’ ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সামরিক হস্তক্ষেপ’, যেমনটি হয়েছিল ইরাকের ক্ষেত্রে। যদিও ইরাকের পরিস্থিতি আর লিবিয়ার পরিস্থিতিকে একসঙ্গে মেলান যাবে না। তবে মিল আছে এক জায়গায় আর তা হচ্ছে লিবিয়ার তেলসম্পদের ব্যাপারে পশ্চিমা স্বার্থ। ইরাকের তেলসম্পদের ব্যাপারে পশ্চিমাদের যেমন স্বার্থ ছিল, আজ লিবিয়ার তেল সম্পদের ব্যাপারেও পশ্চিমাদের তেমনই স্বার্থ রয়েছে। লিবিয়ার তেলের উপর ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এমনকি ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে লিবিয়ার গ্যাস যায় ইতালিতে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ডেমিনোতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তাতে তিউনিশিয়া ও মিসরের শাসকদের (২৩ ও ৩০ বছর) পতন ঘটেছে। একই পথ অনুসরণ করে গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসন এখন ‘তাসের ঘর’ এর মতো ভেঙে পড়ার উপক্রম। লিবিয়া এখন বাস্তবিক অর্থেই দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পূর্বাঞ্চলে বিপ্লবীরা তাদের নিজস্ব প্রশাসন চালু করেছে। ডোমিনোতত্ত্বের মতে, পরের দেশ এখন কোনটি? ইয়েমেন, আলজেরিয়া নাকি বাহরাইন? প্রতিটি দেশেই গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার নানা সুযোগ-সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও (আলজেরিয়ায় ১৯৯২ সাল থেকে চালু হওয়া জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হয়েছে। ইয়েমেন প্রেসিডেন্ট সালেহ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বাহরাইনে বিরোধী দলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে), এ অঞ্চলের পরিস্থিতি শান্ত তা বলা যাবে না। গণঅসন্তোষের ঢেউ এসে লেগেছে সৌদি আরবেও। আর বাহরাইনে বিরোধীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে সেখানে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। সরকারের পক্ষে সেখানে সৌদি সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছে।
আমরা যদি ডোমিনোতত্ত্ব অনুসরণ করি, তাহলে লিবিয়ায় একটি সামরিক আগ্রাসন এখন অনিবার্য। যেমনটি আমরা এক সময় প্রত্যক্ষ করেছিলাম ইন্দোচীনে কিংবা ল্যাতিন আমেরিকায়। চিলি, নিকারাগুয়া, গ্রানাডা, এল-সালভাদর কিংবা গুয়েতেমালার ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে? সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করার জন্যই কি দেশে দেশে গণঅভ্যুত্থানের ‘সৃষ্টি’ করা হচ্ছে? আমরা যেন ভুলে না যাই পারস্য উপসাগরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ট্রাইক ফোর্স’। বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম ফ্লিটের ঘাঁটি। মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন ধরে এত্বধঃবত্ গরফফষব ঊধংঃ চড়ষরপু নিয়ে কাজ করছে। আজকে মিসরে ‘ফেসবুক’ ও ‘টুইটার’ ভিত্তিক যে বিপ্লবের জন্ম (জবাড়ষঁঃরড়হ ২.০), তা প্রমোট করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যারা ইন্টারনেটভিত্তিক এই গণবিক্ষোভকে সংগঠিত করেছিল, তাদের অনেকেই ওয়াশিংটনে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কধভধুধ গড়াবসবহঃ কিংবা অঢ়ত্রষ ৬ গড়াবসবহঃ-কে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, মিসরে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা, যাদের মাধ্যমে সেখানে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। আল বারাদির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওয়াশিংটনের সমর্থন ছিল। এখন লিবিয়ার ব্যাপারেও দীর্ঘস্থায়ী একটি স্ট্রাটেজি কাজ করছে। লিবিয়াতে যদি দীর্ঘদিন অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা পার্শ্ববর্তী নাইজার, আলজেরিয়া ও সুদানেও ছড়িয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হবে অস্থিতিশীলতার। আর এই অস্থিতিশীলতা বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে অনেকটা ‘ইরাকি মডেলে’ সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এমনকি ন্যাটোর সৈন্য মোতায়েনের প্রশ্নও তখন উঠবে। এরই মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ লিবিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ও গাদ্দাফির সম্পদ আটক করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা এখন তৈরি হয়েছে। লিবিয়ার তেলসম্পদের উপর (লিবিয়া ১২তম তেল রফতানিকারক দেশ) পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আগ্রহ ব্যাপক। তিনটি দেশ লিবিয়ার তেলের উপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল (ইতালির ২৯ ভাগ, ফ্রান্সের ১৪ ভাগ, স্পেনের ১০ ভাগ)। তারা চাইবে তেলের উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। প্রয়োজনে পশ্চিমা শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়াকে ভাগ করতেও দ্বিধা করবে না। লিবিয়া কার্যত এখন দু’ভাগে বিভক্ত।
পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে। আর পশ্চিমাঞ্চল (ত্রিপোলিসহ) নিয়ন্ত্রণ করছে গাদ্দাফির সমর্থকরা। পূর্বাঞ্চলেও তেলকূপ রয়েছে, যেখানে কাজ করছে ঊঘও (ইতালি), ঞঙঞঅখ (ফ্রান্স) ও জঊচঝঙ (স্পেন) এর মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলো। লিবিয়ায় সঙ্কট যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অবধারিতভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে (তেলের দাম বেড়ে এখন ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে)। ফলে বিশ্বে তেল সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। এই সুযোগে গ্রিনল্যান্ডের পাশ ঘেঁষে আর্কটিক সাগরে (অত্পঃরপ ঝবধ) তেল উত্তোলনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে এটা চেয়ে আসছে। কিন্তু পরিবেশবাদীদের বাধার কারণে আর্কটিক সাগরে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলন শুরু হয়নি। এখানে তেলের বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের একজন গবেষক উধারফ খলঁহমমত্বহ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ২৩ ফেব্রুয়ারি এ ধরনের একটি সংবাদই প্রকাশ করে। লিবিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ শুধু আজকেই তৈরি হয়নি। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ৭টি দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে ৫ বছরের মধ্যে সরকারের পতনের কথা বলেছিলেন তিনি। ওই ৭টি দেশ হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরান। ইরাকে পরিবর্তন এসেছে অনেক আগেই। এখন লিবিয়ার পালা। আর ইরানের পরিস্থিতিও লক্ষ্য রাখার মতো। ২০০৯ সাল থেকেই সেখানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সোমালিয়া ও সুদানে পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বড় ধরনের একটি পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা হয়েছে। লিবিয়া সেই পরিবর্তনেরই একটা অংশ। একটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লিবিয়া। এরই মধ্যে এক হাজারের ওপরে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শেষদিন পর্যন্ত গাদ্দাফি ত্রিপোলি ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। তবে স্পষ্টতই তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তিনি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন। আজ না হোক কাল তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প কী? লিবিয়ায় কোনো বিরোধী শক্তি নেই। রাজনৈতিকভাবে সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। গাদ্দাফির সমর্থকরা রয়েছেন বটে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে তারা সংগঠিত নন। গাদ্দাফির ক্ষমতার উত্স হচ্ছে তার নিজ গোত্র ও উপজাতীয়দের একটা অংশ। গাদ্দাফি ক্ষমতা পরিচালনা করেন ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের’ মাধ্যমে। এই ‘পিপলস কংগ্রেস’ অনেকটা সংসদের মতো কাজ করে। গ্রাম তথা মিউনিসিপ্যালিটি পর্যায়ে ‘পিপলস কংগ্রেস’ তথা ‘পিপলস কমিটি’র শাখা রয়েছে। যাদের প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত হয়েছে ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেস’। গাদ্দাফি সরকারের কোনো পদে নেই। কার্যত তিনি প্রেসিডেন্ট হলেও লিবিয়ায় তাকে সম্বোধন করা হয় বিপ্লবের নেতা হিসেবে। ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি বাদশাহ ইদ্রিসকে উত্খাত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। আজ ৪১ বছর পরও তিনি বিপ্লবের নেতা।
লিবিয়ায় একটা পরিবর্তন আসন্ন। সত্যিকার অর্থেই সেখানে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনগণের প্রতিনিধিত্বও সেখানে নিশ্চিত হয়নি। ব্যক্তি গাদ্দাফি সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন। তার কথাই সেখানে আইন। তার কথার বরখেলাপ করা যায় না। মজার ব্যাপার, লিবিয়াতে কোনো সংবিধানও নেই। কীভাবে সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তন সাধিত হবে, সে ব্যাপারেও কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। গাদ্দাফির একটি বই রয়েছে—‘গ্রিন বুক’। এই ‘গ্রিন বুক’ই হচ্ছে লিবিয়ার সংবিধান। আর ‘গ্রিন বুক’ এ বলা হয়েছে, ‘বিপ্লবের নেতা’কে অর্থাত্ গাদ্দাফিকে পরিবর্তন করা যাবে না। বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন এসেছে। মানুষ তার অধিকারের ব্যাপারে আজ যথেষ্ট সচেতন। তাই আরব বিশ্বজুড়েই চলছে গণবিক্ষোভ। ইয়েমেন থেকে শুরু করে বাহরাইন সর্বত্রই পরিবর্তনের দাবি। প্রতিটি দেশেই ক্ষমতাসীনরা আছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ওই সব দেশে আদৌ কোনো গণতন্ত্র নেই। আজ একটি সুযোগ এসেছে। তিউনিশিয়া ও মিসরে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সেখানে যে পরিবর্তন আসবে তাতে আমি আশাবাদী নই। কেননা, সেনা সমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং সেই ক্ষেত্রই প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ দুটো দেশে পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা পরিচালনা করছে। লিবিয়ার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখনও গাদ্দাফির হাতে। যদিও সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে পূর্বাঞ্চলে সাবেক একজন বিচারমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের ঊর্ধ্বতন নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন হিলারি ক্লিনটন। এতে করে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এই সরকারকে সমর্থন করছে। কিন্তু তাতে করে ত্রিপোলিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
ত্রিপোলির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনও গাদ্দাফির হাতে। এখন যদি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়, তাহলে যুদ্ধ শুধু লিবিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে যাবে। সম্ভবত গাদ্দাফি এমনটাই চাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রচণ্ড মার্কিন বিরোধিতা সৃষ্টি করে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তিনি পারবেন বলে মনে হয় না। হস্তক্ষেপ হলেই সেখানে আরও রক্তপাত হবে। আরও মানুষ মারা যাবে। দেশটি ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমনটি হয়েছে ইরাকে। সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য একটাই—গাদ্দাফির দেশত্যাগ। এই মুহূর্তে লিবীয় সঙ্কটের কোনো সমাধানও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সত্যি সত্যিই যদি পশ্চিমা শক্তি লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তা লিবিয়ার জন্য অনেক দুঃখ বয়ে নিয়ে আসবে। জাতিসংঘ লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করল। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত লিবিয়ার সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করবে না। যদিও লিবিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে এবং একতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতির কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু অনেক দেরি করে ফেলেছেন গাদ্দাফি। একজন নুরি আল মালিকি (ইরাকের প্রধানমন্ত্রী) কিংবা একজন কারজাই (আফগান প্রেসিডেন্ট) এরই মধ্যে লিবিয়ায় ‘তৈরি’ হয়ে গেছে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
এমনকি লিবিয়ার এই সঙ্কটে গাদ্দাফি উত্তর আফ্রিকার ভাড়াটে সৈন্যদের পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। সেখানে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। হাজার হাজার মানুষ, যাদের প্রায় সবাই বিদেশী, তারা লিবিয়া-তিউনিশিয়া সীমান্তে অবস্থান করছেন শুধু নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের আশায়। এরই মধ্যে লিবিয়ায় গাদ্দাফি সমর্থক ও বিরোধীদের মাঝে ‘যুদ্ধ’ আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। গাদ্দাফি বিরোধীরা পূর্বাঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও গাদ্দাফি সমর্থক সেনাবাহিনী এখন পূর্বাঞ্চল দখল করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদ এই সিদ্ধান্ত নিল। যদিও এই সিদ্ধান্তে সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়নি। কিন্তু প্রয়োজনে ‘যে কোন ব্যবস্থা’ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ‘যে কোন ব্যবস্থার’ ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সামরিক হস্তক্ষেপ’, যেমনটি হয়েছিল ইরাকের ক্ষেত্রে। যদিও ইরাকের পরিস্থিতি আর লিবিয়ার পরিস্থিতিকে একসঙ্গে মেলান যাবে না। তবে মিল আছে এক জায়গায় আর তা হচ্ছে লিবিয়ার তেলসম্পদের ব্যাপারে পশ্চিমা স্বার্থ। ইরাকের তেলসম্পদের ব্যাপারে পশ্চিমাদের যেমন স্বার্থ ছিল, আজ লিবিয়ার তেল সম্পদের ব্যাপারেও পশ্চিমাদের তেমনই স্বার্থ রয়েছে। লিবিয়ার তেলের উপর ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এমনকি ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে লিবিয়ার গ্যাস যায় ইতালিতে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ডেমিনোতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তাতে তিউনিশিয়া ও মিসরের শাসকদের (২৩ ও ৩০ বছর) পতন ঘটেছে। একই পথ অনুসরণ করে গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসন এখন ‘তাসের ঘর’ এর মতো ভেঙে পড়ার উপক্রম। লিবিয়া এখন বাস্তবিক অর্থেই দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পূর্বাঞ্চলে বিপ্লবীরা তাদের নিজস্ব প্রশাসন চালু করেছে। ডোমিনোতত্ত্বের মতে, পরের দেশ এখন কোনটি? ইয়েমেন, আলজেরিয়া নাকি বাহরাইন? প্রতিটি দেশেই গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার নানা সুযোগ-সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও (আলজেরিয়ায় ১৯৯২ সাল থেকে চালু হওয়া জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হয়েছে। ইয়েমেন প্রেসিডেন্ট সালেহ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বাহরাইনে বিরোধী দলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে), এ অঞ্চলের পরিস্থিতি শান্ত তা বলা যাবে না। গণঅসন্তোষের ঢেউ এসে লেগেছে সৌদি আরবেও। আর বাহরাইনে বিরোধীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে সেখানে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। সরকারের পক্ষে সেখানে সৌদি সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছে।
আমরা যদি ডোমিনোতত্ত্ব অনুসরণ করি, তাহলে লিবিয়ায় একটি সামরিক আগ্রাসন এখন অনিবার্য। যেমনটি আমরা এক সময় প্রত্যক্ষ করেছিলাম ইন্দোচীনে কিংবা ল্যাতিন আমেরিকায়। চিলি, নিকারাগুয়া, গ্রানাডা, এল-সালভাদর কিংবা গুয়েতেমালার ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে? সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করার জন্যই কি দেশে দেশে গণঅভ্যুত্থানের ‘সৃষ্টি’ করা হচ্ছে? আমরা যেন ভুলে না যাই পারস্য উপসাগরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ট্রাইক ফোর্স’। বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম ফ্লিটের ঘাঁটি। মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন ধরে এত্বধঃবত্ গরফফষব ঊধংঃ চড়ষরপু নিয়ে কাজ করছে। আজকে মিসরে ‘ফেসবুক’ ও ‘টুইটার’ ভিত্তিক যে বিপ্লবের জন্ম (জবাড়ষঁঃরড়হ ২.০), তা প্রমোট করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যারা ইন্টারনেটভিত্তিক এই গণবিক্ষোভকে সংগঠিত করেছিল, তাদের অনেকেই ওয়াশিংটনে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কধভধুধ গড়াবসবহঃ কিংবা অঢ়ত্রষ ৬ গড়াবসবহঃ-কে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, মিসরে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা, যাদের মাধ্যমে সেখানে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। আল বারাদির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওয়াশিংটনের সমর্থন ছিল। এখন লিবিয়ার ব্যাপারেও দীর্ঘস্থায়ী একটি স্ট্রাটেজি কাজ করছে। লিবিয়াতে যদি দীর্ঘদিন অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা পার্শ্ববর্তী নাইজার, আলজেরিয়া ও সুদানেও ছড়িয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হবে অস্থিতিশীলতার। আর এই অস্থিতিশীলতা বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে অনেকটা ‘ইরাকি মডেলে’ সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এমনকি ন্যাটোর সৈন্য মোতায়েনের প্রশ্নও তখন উঠবে। এরই মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ লিবিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ও গাদ্দাফির সম্পদ আটক করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা এখন তৈরি হয়েছে। লিবিয়ার তেলসম্পদের উপর (লিবিয়া ১২তম তেল রফতানিকারক দেশ) পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আগ্রহ ব্যাপক। তিনটি দেশ লিবিয়ার তেলের উপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল (ইতালির ২৯ ভাগ, ফ্রান্সের ১৪ ভাগ, স্পেনের ১০ ভাগ)। তারা চাইবে তেলের উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। প্রয়োজনে পশ্চিমা শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়াকে ভাগ করতেও দ্বিধা করবে না। লিবিয়া কার্যত এখন দু’ভাগে বিভক্ত।
পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে। আর পশ্চিমাঞ্চল (ত্রিপোলিসহ) নিয়ন্ত্রণ করছে গাদ্দাফির সমর্থকরা। পূর্বাঞ্চলেও তেলকূপ রয়েছে, যেখানে কাজ করছে ঊঘও (ইতালি), ঞঙঞঅখ (ফ্রান্স) ও জঊচঝঙ (স্পেন) এর মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলো। লিবিয়ায় সঙ্কট যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অবধারিতভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে (তেলের দাম বেড়ে এখন ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে)। ফলে বিশ্বে তেল সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। এই সুযোগে গ্রিনল্যান্ডের পাশ ঘেঁষে আর্কটিক সাগরে (অত্পঃরপ ঝবধ) তেল উত্তোলনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে এটা চেয়ে আসছে। কিন্তু পরিবেশবাদীদের বাধার কারণে আর্কটিক সাগরে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলন শুরু হয়নি। এখানে তেলের বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের একজন গবেষক উধারফ খলঁহমমত্বহ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ২৩ ফেব্রুয়ারি এ ধরনের একটি সংবাদই প্রকাশ করে। লিবিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ শুধু আজকেই তৈরি হয়নি। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ৭টি দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে ৫ বছরের মধ্যে সরকারের পতনের কথা বলেছিলেন তিনি। ওই ৭টি দেশ হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরান। ইরাকে পরিবর্তন এসেছে অনেক আগেই। এখন লিবিয়ার পালা। আর ইরানের পরিস্থিতিও লক্ষ্য রাখার মতো। ২০০৯ সাল থেকেই সেখানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সোমালিয়া ও সুদানে পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বড় ধরনের একটি পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা হয়েছে। লিবিয়া সেই পরিবর্তনেরই একটা অংশ। একটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লিবিয়া। এরই মধ্যে এক হাজারের ওপরে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শেষদিন পর্যন্ত গাদ্দাফি ত্রিপোলি ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। তবে স্পষ্টতই তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তিনি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন। আজ না হোক কাল তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প কী? লিবিয়ায় কোনো বিরোধী শক্তি নেই। রাজনৈতিকভাবে সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। গাদ্দাফির সমর্থকরা রয়েছেন বটে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে তারা সংগঠিত নন। গাদ্দাফির ক্ষমতার উত্স হচ্ছে তার নিজ গোত্র ও উপজাতীয়দের একটা অংশ। গাদ্দাফি ক্ষমতা পরিচালনা করেন ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের’ মাধ্যমে। এই ‘পিপলস কংগ্রেস’ অনেকটা সংসদের মতো কাজ করে। গ্রাম তথা মিউনিসিপ্যালিটি পর্যায়ে ‘পিপলস কংগ্রেস’ তথা ‘পিপলস কমিটি’র শাখা রয়েছে। যাদের প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত হয়েছে ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেস’। গাদ্দাফি সরকারের কোনো পদে নেই। কার্যত তিনি প্রেসিডেন্ট হলেও লিবিয়ায় তাকে সম্বোধন করা হয় বিপ্লবের নেতা হিসেবে। ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি বাদশাহ ইদ্রিসকে উত্খাত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। আজ ৪১ বছর পরও তিনি বিপ্লবের নেতা।
লিবিয়ায় একটা পরিবর্তন আসন্ন। সত্যিকার অর্থেই সেখানে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনগণের প্রতিনিধিত্বও সেখানে নিশ্চিত হয়নি। ব্যক্তি গাদ্দাফি সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন। তার কথাই সেখানে আইন। তার কথার বরখেলাপ করা যায় না। মজার ব্যাপার, লিবিয়াতে কোনো সংবিধানও নেই। কীভাবে সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তন সাধিত হবে, সে ব্যাপারেও কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। গাদ্দাফির একটি বই রয়েছে—‘গ্রিন বুক’। এই ‘গ্রিন বুক’ই হচ্ছে লিবিয়ার সংবিধান। আর ‘গ্রিন বুক’ এ বলা হয়েছে, ‘বিপ্লবের নেতা’কে অর্থাত্ গাদ্দাফিকে পরিবর্তন করা যাবে না। বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন এসেছে। মানুষ তার অধিকারের ব্যাপারে আজ যথেষ্ট সচেতন। তাই আরব বিশ্বজুড়েই চলছে গণবিক্ষোভ। ইয়েমেন থেকে শুরু করে বাহরাইন সর্বত্রই পরিবর্তনের দাবি। প্রতিটি দেশেই ক্ষমতাসীনরা আছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ওই সব দেশে আদৌ কোনো গণতন্ত্র নেই। আজ একটি সুযোগ এসেছে। তিউনিশিয়া ও মিসরে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সেখানে যে পরিবর্তন আসবে তাতে আমি আশাবাদী নই। কেননা, সেনা সমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং সেই ক্ষেত্রই প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ দুটো দেশে পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা পরিচালনা করছে। লিবিয়ার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখনও গাদ্দাফির হাতে। যদিও সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে পূর্বাঞ্চলে সাবেক একজন বিচারমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের ঊর্ধ্বতন নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন হিলারি ক্লিনটন। এতে করে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এই সরকারকে সমর্থন করছে। কিন্তু তাতে করে ত্রিপোলিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
ত্রিপোলির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনও গাদ্দাফির হাতে। এখন যদি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়, তাহলে যুদ্ধ শুধু লিবিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে যাবে। সম্ভবত গাদ্দাফি এমনটাই চাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রচণ্ড মার্কিন বিরোধিতা সৃষ্টি করে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তিনি পারবেন বলে মনে হয় না। হস্তক্ষেপ হলেই সেখানে আরও রক্তপাত হবে। আরও মানুষ মারা যাবে। দেশটি ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমনটি হয়েছে ইরাকে। সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য একটাই—গাদ্দাফির দেশত্যাগ। এই মুহূর্তে লিবীয় সঙ্কটের কোনো সমাধানও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সত্যি সত্যিই যদি পশ্চিমা শক্তি লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তা লিবিয়ার জন্য অনেক দুঃখ বয়ে নিয়ে আসবে। জাতিসংঘ লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করল। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত লিবিয়ার সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করবে না। যদিও লিবিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে এবং একতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতির কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু অনেক দেরি করে ফেলেছেন গাদ্দাফি। একজন নুরি আল মালিকি (ইরাকের প্রধানমন্ত্রী) কিংবা একজন কারজাই (আফগান প্রেসিডেন্ট) এরই মধ্যে লিবিয়ায় ‘তৈরি’ হয়ে গেছে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment