ঐশীরা কেমন আছে? ঐশী শহীদ মেজর কাজী আশরাফের মেয়ে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শহীদ হয়েছিলেন আশরাফ। সেই আশরাফের মেয়ে ঐশীর কান্নার ছবি ছাপা হয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিকে, আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে ২০০৯ সালের ৬ মার্চ। তখন ওর বয়স কতই বা হবে? দশ কিংবা এগারো। যে বয়সে মেয়েরা বাবাকে খুব কাছে পেতে চায়, সেই বয়সেই বাবাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল ঐশী। আজ দুই বছর পর ঐশী নিশ্চয়ই আরও একটু বড় হয়েছে। অনেক কিছু নিশ্চয়ই বোঝে ও এখন। কোন ক্লাসে পড়ে ঐশী? কোন স্কুলে যায়? কে তাকে স্কুলে নিয়ে যায়? দুই বছর আগে ঐশীর কান্নার ছবি,
বাবার কবরের পাশে বসে বাবাকে স্মরণ করার যে ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তা দেখে আমি লিখেছিলাম। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে ঐশী আরও একটু বড় হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্ন আমি দুই বছর আগে করেছিলাম, সেই প্রশ্ন আজও আমাকে করতে হচ্ছে—যারা ঐশীর বাবা কাজী আশরাফকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করল, তাদের শাস্তি কি হবে? গত ২৭ ফেব্রুয়ারি টিভিতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী শহীদ পরিবারদের মাঝে ‘চেক’ বিতরণ করছেন। নিশ্চয়ই ওই অনুষ্ঠানে ঐশী মা-সহ উপস্থিত ছিল। ‘চেক’ও নিশ্চয়ই একটা পেয়েছে। কিন্তু তাতে করে কি ঐশীকে তার বাবার আদর কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে?
বিডিআর হত্যাকাণ্ড এভাবে কত ঐশীকে তাদের বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করেছে তার হিসাব এই সমাজ কি রাখে? কতজনের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিনটি আমরা পালন করলাম। বনানীর সেনা কবর স্থান ওইদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল। কিন্তু রামি, সামি, রাইয়ান, জাহিন, লামিয়ারা কেমন আছে, কেমন করে তাদের দিন যাচ্ছে, কোনো সংবাদপত্রই আমাদের জানাল না সে কথা। রামি ও সামির বাবা ছিলেন মেজর মিজানুর রহমান। রামি ও সামিদের মা মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে আর করেননি মেজর মিজান। রামি ও সামিদের কাছে তিনি ছিলেন একাধারে বাবা এবং মা। এখন বাবা ও মাবিহীন রামি ও সামিদের জীবন কেমন কাটছে? বড় ভাই রামির বয়স এখন আমার হিসেব মতে ১২। এই ১২ বছরে একটি শিশু কি পারে তার ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে? একটু কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা এটাই। ১২ বছরের শিশুই আজ শহীদ মিজানের পরিবারের জ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকার।
আমি আজ দুই বছর পর কার কথা লিখব? দুই বছর আগে শহীদ মেজর মমিনুল ইসলামের স্ত্রী সোনিয়া প্রশ্ন রেখেছিলেন তার ছোট্ট শিশুটির ভবিষ্যত্ নিয়ে, যে শিশুটি কোনোদিন আর বাবার আদর পাবে না। আমি জানি না ওই ছোট্ট ‘বাবু’র কী নাম রেখেছিলেন সোনিয়া। জানতে ইচ্ছে করে, ‘ওই বাবু’টি কেমন আছে! ওর নিশ্চয়ই এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। একদিন বড় হয়ে ও জানবে, ওর বাবাকে কারা হত্যা করেছিল। হত্যাকারীরা যদি শাস্তি পায়, তাহলে সান্ত্বনা একটাই—হত্যাকারীদের এই সমাজ ‘শাস্তি’ দিয়েছে। আমি জানি, ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতি বছরই ওই দিনটি পালিত হবে। প্রতি বছরই প্রধানমন্ত্রী শহীদ পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবেন। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া ‘চেক’ বিতরণ করবেন। নিঃসন্দেহে ওই ‘চেক’ শহীদ পরিবারের জন্য একটি বড় পাওয়া। এই সমাজে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রয়োজন শহীদ পরিবার, বিশেষ করে শহীদদের স্ত্রীদের একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া। সম্ভবত অনেকেই এরই মধ্যে চাকরি পেয়েছেন। যারা পাননি তাদের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু নয়। আরও একটি কথা। শহীদদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা হোক। এটি হতে পারে শহীদদের সন্তানদের ‘ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্’-এ পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিয়ে। এর বাইরে দেশের ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শহীদদের সন্তানদের জন্য একটি ‘বিশেষ কোটা’ ব্যবস্থা চালু করতে পারে, যেখানে শহীদদের সন্তানরা বিনা বেতনে তাদের উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারবে। এমনিতেই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নানা কোটা’ রয়েছে। এসব ‘কোটায়’ সমাজের অবহেলিত শ্রেণী যেমনি ভর্তি হচ্ছে, ঠিক তেমনি ভর্তি হচ্ছে সুবিধাভোগী শ্রেণীরাও। তাহলে আমরা কেন শহীদদের সন্তানদের এই সুযোগটি দেব না? ঐশীদের বাবারা এই দেশটির জন্যই তাদের জীবন উত্সর্গ করেছেন। এ জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা অকৃতজ্ঞ নই।
কিছুটা হলেও আমরা দায়ভারমুক্ত হতে চাই। আমার মনে আছে, রিহ্যাবের অনেক সদস্য সেদিন প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা শহীদ পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেবেন। তার কী হলো? এদের অনেক ঘোষণার কথা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। আমরা তা ভুলে যাইনি। ভুলে যায়নি শহীদ পরিবাররাও। এটা কোনো স্টান্টবাজি ছিল না, এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় রিহ্যাবের সদস্যরা এই কাজটি করেননি—এটাই আমি ধরে নেব। বিডিআরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শহীদ অফিসারদের পাশাপাশি বেশ ক’জন সৈনিকের মৃত্যুর খবরও পত্র-পত্রিকায় তখন ছাপা হয়েছিল। তারাও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। তারাও কারও বাবা কিংবা সন্তান। এটা সত্য, তাদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় খুব কম লেখাই ছাপা হয়েছে। তবে তারাও ‘রক্তাক্ত’ ২৫ ফেব্রুয়ারির শিকার। তুলনামূলক বিচারে তাদের সংখ্যা কম—যে কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের সংবাদপত্রের পাতায় স্থান হয়নি। ধারণা করছি, তারাও ঘাতকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করায় টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। তারাও যেন শহীদের মর্যাদা পান এবং সব ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ সুবিধা পান, এটাই কামনা করব। তাদের সন্তানদের দিকেও যেন আমরা তাকাই।
বিডিআরের নাম এরই মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিডিআর বিদ্রোহের বিচার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এবং কোনো কোনো সেক্টরের বিচার সম্পন্নও হয়েছে। মাত্র একশ’ টাকা জরিমানা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাত বছরের শাস্তিও পেয়েছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে হত্যা ও লুণ্ঠনের মামলায় তদন্তের সময় আরও ২০ দিন, অর্থাত্ ২৩ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ তদন্ত শেষ না করায় আদালত উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এই বিচার কার্যক্রম চলছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও লুণ্ঠনের অপরাধে মোট আসামি ৮২৪ জন। এর মাঝে ২৩ জন বেসামরিক ব্যক্তিও রয়েছেন।
বিচারের কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে হতাশা আসতে বাধ্য। শহীদ পরিবারের মাঝেও হতাশা এসেছে। তারা বার বার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছেন। এরই মধ্যে এমন অভিযোগও উঠেছে যে, তদন্ত কাজে বেশকিছু ব্যক্তিকে বাদ (?) দেয়া হয়েছে। এমনকি হত্যাকারীদের কেউ কেউ ভারতে পালিয়ে গেছে—এমন অভিযোগও উঠেছে। আমরা জানি না অভিযোগগুলো আদৌ সত্য কি-না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যখন এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, তখন তাকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
পিলখানা ট্রাজেডি আমাদের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। ৫৮ জন অফিসারকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হলো, যা কিনা আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধেও প্রত্যক্ষ করিনি। বিচার নিয়ে আমরা কোনো বিতর্ক চাই না। আমরা চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আমরা ঐশীদের চোখে আর কান্না দেখতে চাই না। একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই ঐশীদের নীরব কান্না বন্ধ করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
বাবার কবরের পাশে বসে বাবাকে স্মরণ করার যে ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তা দেখে আমি লিখেছিলাম। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে ঐশী আরও একটু বড় হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্ন আমি দুই বছর আগে করেছিলাম, সেই প্রশ্ন আজও আমাকে করতে হচ্ছে—যারা ঐশীর বাবা কাজী আশরাফকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করল, তাদের শাস্তি কি হবে? গত ২৭ ফেব্রুয়ারি টিভিতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী শহীদ পরিবারদের মাঝে ‘চেক’ বিতরণ করছেন। নিশ্চয়ই ওই অনুষ্ঠানে ঐশী মা-সহ উপস্থিত ছিল। ‘চেক’ও নিশ্চয়ই একটা পেয়েছে। কিন্তু তাতে করে কি ঐশীকে তার বাবার আদর কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে?
বিডিআর হত্যাকাণ্ড এভাবে কত ঐশীকে তাদের বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করেছে তার হিসাব এই সমাজ কি রাখে? কতজনের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিনটি আমরা পালন করলাম। বনানীর সেনা কবর স্থান ওইদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল। কিন্তু রামি, সামি, রাইয়ান, জাহিন, লামিয়ারা কেমন আছে, কেমন করে তাদের দিন যাচ্ছে, কোনো সংবাদপত্রই আমাদের জানাল না সে কথা। রামি ও সামির বাবা ছিলেন মেজর মিজানুর রহমান। রামি ও সামিদের মা মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে আর করেননি মেজর মিজান। রামি ও সামিদের কাছে তিনি ছিলেন একাধারে বাবা এবং মা। এখন বাবা ও মাবিহীন রামি ও সামিদের জীবন কেমন কাটছে? বড় ভাই রামির বয়স এখন আমার হিসেব মতে ১২। এই ১২ বছরে একটি শিশু কি পারে তার ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে? একটু কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা এটাই। ১২ বছরের শিশুই আজ শহীদ মিজানের পরিবারের জ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকার।
আমি আজ দুই বছর পর কার কথা লিখব? দুই বছর আগে শহীদ মেজর মমিনুল ইসলামের স্ত্রী সোনিয়া প্রশ্ন রেখেছিলেন তার ছোট্ট শিশুটির ভবিষ্যত্ নিয়ে, যে শিশুটি কোনোদিন আর বাবার আদর পাবে না। আমি জানি না ওই ছোট্ট ‘বাবু’র কী নাম রেখেছিলেন সোনিয়া। জানতে ইচ্ছে করে, ‘ওই বাবু’টি কেমন আছে! ওর নিশ্চয়ই এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। একদিন বড় হয়ে ও জানবে, ওর বাবাকে কারা হত্যা করেছিল। হত্যাকারীরা যদি শাস্তি পায়, তাহলে সান্ত্বনা একটাই—হত্যাকারীদের এই সমাজ ‘শাস্তি’ দিয়েছে। আমি জানি, ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতি বছরই ওই দিনটি পালিত হবে। প্রতি বছরই প্রধানমন্ত্রী শহীদ পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবেন। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া ‘চেক’ বিতরণ করবেন। নিঃসন্দেহে ওই ‘চেক’ শহীদ পরিবারের জন্য একটি বড় পাওয়া। এই সমাজে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রয়োজন শহীদ পরিবার, বিশেষ করে শহীদদের স্ত্রীদের একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া। সম্ভবত অনেকেই এরই মধ্যে চাকরি পেয়েছেন। যারা পাননি তাদের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু নয়। আরও একটি কথা। শহীদদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা হোক। এটি হতে পারে শহীদদের সন্তানদের ‘ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্’-এ পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিয়ে। এর বাইরে দেশের ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শহীদদের সন্তানদের জন্য একটি ‘বিশেষ কোটা’ ব্যবস্থা চালু করতে পারে, যেখানে শহীদদের সন্তানরা বিনা বেতনে তাদের উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারবে। এমনিতেই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নানা কোটা’ রয়েছে। এসব ‘কোটায়’ সমাজের অবহেলিত শ্রেণী যেমনি ভর্তি হচ্ছে, ঠিক তেমনি ভর্তি হচ্ছে সুবিধাভোগী শ্রেণীরাও। তাহলে আমরা কেন শহীদদের সন্তানদের এই সুযোগটি দেব না? ঐশীদের বাবারা এই দেশটির জন্যই তাদের জীবন উত্সর্গ করেছেন। এ জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা অকৃতজ্ঞ নই।
কিছুটা হলেও আমরা দায়ভারমুক্ত হতে চাই। আমার মনে আছে, রিহ্যাবের অনেক সদস্য সেদিন প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা শহীদ পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেবেন। তার কী হলো? এদের অনেক ঘোষণার কথা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। আমরা তা ভুলে যাইনি। ভুলে যায়নি শহীদ পরিবাররাও। এটা কোনো স্টান্টবাজি ছিল না, এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় রিহ্যাবের সদস্যরা এই কাজটি করেননি—এটাই আমি ধরে নেব। বিডিআরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শহীদ অফিসারদের পাশাপাশি বেশ ক’জন সৈনিকের মৃত্যুর খবরও পত্র-পত্রিকায় তখন ছাপা হয়েছিল। তারাও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। তারাও কারও বাবা কিংবা সন্তান। এটা সত্য, তাদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় খুব কম লেখাই ছাপা হয়েছে। তবে তারাও ‘রক্তাক্ত’ ২৫ ফেব্রুয়ারির শিকার। তুলনামূলক বিচারে তাদের সংখ্যা কম—যে কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের সংবাদপত্রের পাতায় স্থান হয়নি। ধারণা করছি, তারাও ঘাতকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করায় টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। তারাও যেন শহীদের মর্যাদা পান এবং সব ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ সুবিধা পান, এটাই কামনা করব। তাদের সন্তানদের দিকেও যেন আমরা তাকাই।
বিডিআরের নাম এরই মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিডিআর বিদ্রোহের বিচার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এবং কোনো কোনো সেক্টরের বিচার সম্পন্নও হয়েছে। মাত্র একশ’ টাকা জরিমানা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাত বছরের শাস্তিও পেয়েছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে হত্যা ও লুণ্ঠনের মামলায় তদন্তের সময় আরও ২০ দিন, অর্থাত্ ২৩ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ তদন্ত শেষ না করায় আদালত উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এই বিচার কার্যক্রম চলছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও লুণ্ঠনের অপরাধে মোট আসামি ৮২৪ জন। এর মাঝে ২৩ জন বেসামরিক ব্যক্তিও রয়েছেন।
বিচারের কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে হতাশা আসতে বাধ্য। শহীদ পরিবারের মাঝেও হতাশা এসেছে। তারা বার বার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছেন। এরই মধ্যে এমন অভিযোগও উঠেছে যে, তদন্ত কাজে বেশকিছু ব্যক্তিকে বাদ (?) দেয়া হয়েছে। এমনকি হত্যাকারীদের কেউ কেউ ভারতে পালিয়ে গেছে—এমন অভিযোগও উঠেছে। আমরা জানি না অভিযোগগুলো আদৌ সত্য কি-না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যখন এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, তখন তাকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
পিলখানা ট্রাজেডি আমাদের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। ৫৮ জন অফিসারকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হলো, যা কিনা আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধেও প্রত্যক্ষ করিনি। বিচার নিয়ে আমরা কোনো বিতর্ক চাই না। আমরা চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আমরা ঐশীদের চোখে আর কান্না দেখতে চাই না। একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই ঐশীদের নীরব কান্না বন্ধ করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment