রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে
রুণ শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। আমি জানি, এ ধরনের প্রস্তাবে উপাচার্যরা কিংবা ইউজিসির চেয়ারম্যানও রাজি হবেন না। কেননা তাদের দরকার 'ভোটার', ভালো শিক্ষক তাদের দরকার নেই।

ভদ্রলোক উত্তরবঙ্গে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শিক্ষকতা করছেন রাজশাহীতে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান। আত্মীয়করণের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা অতীতের সব রেকর্ডকে ম্লান করে দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য থাকার সুবাদে বেশ ক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্ত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। অতীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিয়োগের ঘটনায় উপ-উপাচার্যকে তিনি তার ক্ষমতাবলে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। ওই উপ-উপাচার্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের স্ত্রীকে একটি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। নিয়োগ কমিটিতে তিনিই সভাপতিত্ব করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করেছেন ভিসি নিজে। যিনি নিজের ভাই, মেয়েসহ আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন। এখানে অনেক কিছু করার আছে। যোগ্য শিক্ষক তথা যোগ্য কর্মচারীও দরকার। শুরুতেই যদি অনিয়মের জালে আটকে যায় তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কীভাবে? রাষ্ট্রপতি তো বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে আসছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে হয়তো আত্মীয়করণ একটু বেশিই হয়েছে। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে যদি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলোর ওপর নজর বোলানো যায়, তাহলে দেখা যাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ হচ্ছে। এটি হয়েছে এ কারণে যে, 'শিক্ষক রাজনীতিবিদদেরই' ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার অনার্স নেই, কোনো উচ্চতর গবেষণা নেই তিনি ভিসি হয়েছেন। এ সংখ্যা নেহাত কম নয়। ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩১ জন উপাচার্য। একজন করে উপ-উপাচার্য ও একজন করে ট্রেজারার রয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে দু'জন উপ-উপাচার্য রয়েছেন। যদিও দু'জন উপ-উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদগুলোতে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কেউ দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেউবা আবার বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য। দু'একজন উপাচার্য ছাড়া বাকিদের নামও কেউ কোনোদিন শোনেননি। শিক্ষক সমাজের কাছেও তারা 'ভালো শিক্ষক বা ভালো গবেষক' হিসেবেও পরিচিত নন। তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলছি, এদের অনেকেরই নিজস্ব কোনো টেক্সট বই নেই। এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা গবেষণার চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দলীয় আনুগত্যকে। আমি অনেক উপাচার্যকে চিনি, যারা চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন অন্যত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়। সঙ্গত কারণেই তারা যখন উপাচার্য হন, তখন অনিয়মের আশ্রয় নেন বেশি। গত সপ্তাহে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ অনিয়মের খবর ছাপা হয়েছে। প্রথমটি ঢাকা, দ্বিতীয়টি খুলনা এবং তৃতীয়টি রাজশাহী।

আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একজন শিক্ষক নেতার মন্তব্যও ছাপা হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন, গত দু'বছরে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৬০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের কারণে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়েছে। এর কোনো প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। আমরা বারবার লক্ষ্য করছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হচ্ছে। সর্বশেষ অনিয়মে যুক্ত হয়েছে ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ। অভিযোগ উঠেছে, যিনি মাস্টার্সে প্রথম হয়েছেন, তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে শিক্ষকদের একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক) এ ধরনের অভিযোগ এবং মামলার খবর পত্রিকায় ছাপা হয়। ফলে উপাচার্যের চেয়ে উপ-উপাচার্যের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বেশি। কেননা তিনি ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করেন। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মাস্টার্সে যখন প্রথম শ্রেণী পান, বিদেশের জার্নালে একটি প্রকাশনা থাকে, এটিই তো তার শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা। তিনি শিক্ষক হবেন না কেন? বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যখন বিতর্কের সৃষ্টি হয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। কিছুদিন আগে একটি সংবাদ পাঠ করেছিলাম (মানবজমিন, ২ আগস্ট, ২০১০)। তাতে বলা হয়েছিল, এশিয়ার শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান, গবেষণা তথা শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে (কনসেজো সুপেরিয়র ডি ইনভেসটিসিওন সিয়েন্টিফিকাস্থ-এর মতে) তাতে বুয়েটের অবস্থান ২৩, ব্র্যাকের ৫৬ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬। ১২ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে (বিশ্বব্যাপী) তাতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাহাঙ্গীরনগর) অবস্থান ৮ হাজার ৭৮৯ নম্বরে। রাজশাহীর অবস্থান ৭ হাজার ১৯৬ নম্বরে। আর ঢাকার ৫ হাজার ৫৩১ (বুয়েট ২ হাজার ৯১৯) নম্বরে। অথচ ২০০৯ সালে ঢাকার অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৯২২ নম্বরে। বুয়েট তার পড়াশোনার মান বৃদ্ধি করতে পেরেছে। ৩ হাজার ৮০১ নম্বর থেকে ২ হাজার ৯১৬-তে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান পড়ে যাওয়ার কারণ একটাই। কেননা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

এক সময় আমরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। বিদেশি প্রকাশনা নিয়েও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিতর্কিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। সেখানে বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে (আমার দেশ, ২৩ জানুয়ারি) জানা যায়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯টি বিভাগের বিজ্ঞাপিত ১০৬টি পদের বিপরীতে এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমান ভিসি বিগত জোট তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যুক্তি তুলেছিলেন অতিরিক্ত শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগের। এ নিয়ে তিনি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ইউজিসি যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল আমি তার সদস্য ছিলাম। এখন স্বয়ং তার বিরুদ্ধেই অতিরিক্ত শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ উঠল। এর তদন্ত এখন কে করবে? খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আরও মজার। উপাচার্য নিজে নিজেকে বাংলা বিভাগের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। ডিন এ ব্যাপারে আপত্তি তুললে তিনি ডিনকেও সরিয়ে দেন। শিক্ষক সমিতি সেখানে আন্দোলনে গেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকেই আমার এ কথা বলা।

আমি জানি একই ঘটনা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে। যার খুব কমই ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এসব সংবাদ আমাকে পীড়া দেয়। আমি উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তাহলে সমাধান কোন পথে? আমার সুপারিশ নিম্নরূপ :

১. শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে মঞ্জুরি কমিশন। তিন ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে (মৌখিক, লিখিত ও উপস্থাপনা)।
২. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চাহিদা জানাবে। চাহিদাকে সামনে রেখে মঞ্জুরি কমিশন ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী বোর্ড গঠন করবে।
৩. কোনো প্রার্থী নিজের পাস করা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আবেদন করতে পারবে না (যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা আছে)। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে তাকে তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে।
৪. পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে দেওয়া যাবে না। তাকে নূ্যনতম ১ থেকে ২ বছর গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করতে হবে এবং মাঝে মধ্যে ক্লাস নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
৫. তরুণ শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। আমি জানি, এ ধরনের প্রস্তাবে উপাচার্যরা কিংবা ইউজিসির চেয়ারম্যানও রাজি হবেন না। কেননা তাদের দরকার 'ভোটার', ভালো শিক্ষক তাদের দরকার নেই। আর রাজি হবেন না বলেই অনিয়মের খবর বারবার দেখতে থাকব আমরা।

অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment