রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গণতন্ত্র বিনির্মাণ : তিনটি দেশের অভিজ্ঞতা

গণতন্ত্র বিনির্মাণ নিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো যে কত বড় সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের সে কথাটা আবার স্মরণ করিয়ে দিল। বিশেষ করে সুদান, থাইল্যান্ড ও কিরঘিজস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রমাণ করে গণতন্ত্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়া অত সহজ নয়। যদিও এই তিনটি দেশের অতীত অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক নয়। এদের মধ্যে ভিন্নতা আছে। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায় আর তা হচ্ছে তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শুধু নির্বাচন যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিনির্মাণ করতে পারে না, এটা আবারও প্রমাণিত হলো। তবুও ক্ষমতাসীনরা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য নির্বাচন দেয়। কিন্তু ওই নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার আর সুযোগ থাকে না। সুদান এ রকম একটি দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ ২৪ বছর পর সেখানে একসঙ্গে প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন শুরু হয়েছে গত ১২ এপ্রিল। কিন্তু জালিয়াতি, আর নির্বাচন বয়কট সেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থান আর গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের দেশ সুদান। আশির দশক থেকেই দক্ষিণাঞ্চল আলাদা একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে।

এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলেও, সেই সমঝোতা কাজ করছে না। সেখানে নির্বাচনের কোনো সংস্কৃতি নেই। ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন জেনারেল জাফর আল নূমেরী। ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৬৫ সালের ৬ এপ্রিল আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয় ১৯৮৬ সালে এবং একটি নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সুদান আরও একবার প্রত্যক্ষ করল সামরিক অভ্যুত্থান। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ওমর হাসান আল বসির। সেই থেকে তিনি ক্ষমতায়। প্রায় ২১ বছর। এই ২১ বছর সেখানে কোনো নির্বাচন হয়নি। সেখানে নেই কোনো পার্লামেন্ট। জেনারেল বসির এককভাবেই ক্ষমতা চালান। তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ২১ বছর পর তিনি নির্বাচন দিলেন। ১৯৮৬ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো মানুষকে বলা হলো নির্বাচনের কথা। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হলো না। প্রধান বিরোধীরা ইতোমধ্যেই নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় দল উম্মা পার্টি ও দক্ষিণের এসপিএলএম নির্বাচনে অংশ নেয়নি। উপরন্তু ভোটার লিস্ট নিয়ে সমস্যা ছিল। অনেকের নামই ভোটার লিস্টে আসেনি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সেখানে গিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনিও জানালেন তার অসন্তোষের কথা। তারপরও যেখানে নির্বাচনের সংস্কৃতি নেই সেখানে একটি নির্বাচন হয়েছে। জেনারেল বসির নিজে বিজয়ী হবেন ও তার সমর্থিত দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। এই যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়াকে আমরা গণতন্ত্র না বললেও, আফ্রিকার গণতন্ত্রের এটা একটা রূপ। অন্তত নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য আফ্রিকার শাসকরা এ ধরনের ‘গণতন্ত্রের’ আয়োজন করেন।

মধ্য এশিয়ার দেশ কিরঘিজস্তানের গণতন্ত্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন ধরনের। কিরঘিজস্তান ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত একটি রিপাবলিক। ১৯৩৬ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরঘিজস্তান স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অসকার আকায়েভ, যিনি এক সময় কমিউনিস্ট হিসেবে এবং সোভিয়েত সমর্থন নিয়ে দেশটি শাসন করে আসছিলেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই তার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ পরিত্যাগ করেন। তিনি হয়ে যান ‘গণতন্ত্রী’। কিন্তু ২০০৫ সালের গণঅভ্যুত্থানে (টিউলিপ রেভ্যুলুশন) তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ক্ষমতায় আসেন কুরমানবেক বাকিয়েভ। ২০০৮ সালে তথাকথিত একটি নির্বাচনও দেন তিনি। কিন্তু দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্রে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। গেল সপ্তাহে যে সহিংস অভ্যুত্থান হয়, তাতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ক্ষমতায় আসেন তারই এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজা আটুনভায়েভা। কিন্তু তাতে করে কী কিরগিজিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? রোজা আটুনভায়েভা কুরমানবেক বাকিয়েভের মতো ক্ষমতা পরিচালনা করবেন কীনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন।

কিরঘিজস্তানের রাজনীতির সঙ্গে থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক রাজনীতির বেশ মিল রয়েছে। কিরঘিজস্তানের ২০০৫ সালের আদলে থাইল্যান্ডে জন্ম হয়েছে ‘রেড শার্ট’ আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা লাল শার্ট পরে প্রধানমন্ত্রী আভিজিত্ ভেজ্জাভিজের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন দখল করে নিলে এমপি ও মন্ত্রীদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়। ব্যাংককে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা তা মানবেন না। স্পষ্টতই সরকারের ভবিষ্যত্ একটি প্রশ্নের মধ্যে আটকে আছে। আজকে থাইল্যান্ডের যে পরিস্থিতি তার একটি প্রেক্ষাপট আছে। ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী যখন থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকারকে উত্খাত করে, তারপর থেকেই পরিস্থিতি কখনই স্বাভাবিক হয়নি। যদিও সেখানে থাকসিনের দল ‘থাই বক থাই’ পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল থাকসিনের সমর্থকরাই অন্য নামে (পিপলস্ পার্টি) সংগঠিত হয়ে নির্বাচনে ভালো ফলাফল করেছে। নির্বাচনের পর থাকসিন সমর্থক সামাক সুন্দরাভেজ অন্য পাঁচটি দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলেও বিরোধীদলের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হননি। টিভিতে একটি রান্নার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া ও সংবিধান আদালত তাকে অযোগ্য ঘোষণা করলে দল সোমচাই ওয়াংসাওয়াতকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করে।এবার সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আনে। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলনেতা (ডেমোক্রেটিক পার্টি) অভিজিত্ ভেজ্জাভিজা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে একটি সরকার গঠন করেন। তারপর থেকেই থাকসিনের সমর্থকরা বারেবারে অভিজিত্ ভেজ্জাভিজা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। ‘লাল শার্ট’ আন্দোলনের পেছনে থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থন ও মদত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আন্দোলনকারীরা নয়া নির্বাচন চাচ্ছেন। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলেও মনে হয় না।

সুদান, কিরঘিজস্তান আর থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়া এক নয়, ভিন্ন ভিন্ন। সুদানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো ঐতিহ্য নেই। কিন্তু থাইল্যান্ড ও কিরঘিজস্তানের কিছুটা হলেও আছে। কিরঘিজস্তান ও থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা বলে জনগণের শক্তিই আসল। জনগণের এই ‘শক্তির’ বাইরে গিয়ে কেউ কোনোদিন টিকতে পারেনি। ইতিহাসের শিক্ষা এটাই। এখন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অভিজিত ভেজ্জাভিজ কিংবা কিরঘিজস্তানের রোজা আটুনভায়েভা যদি কিছু শেখেন, তাহলেই মঙ্গল এবং এই দেশ দু’টিতে আরও রক্তপাত এড়ানো যাবে। আর সুদানে যদি আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তন সাধিত হতে পারে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে সেনাশাসন থাকায়, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সেখানে বিকশিত হতে পারেনি। উন্নয়নশীল বিশ্বের এই তিনটি দেশের অভিজ্ঞতা বলে উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্র বিনির্মাণের যে সমস্যা, সেই সমস্যা থেকে দেশগুলো এখনও বের হয়ে আসতে পারেনি।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ আমার দেশ, ১৯/০৪/১০]

0 comments:

Post a Comment