রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক লক্ষ্য




‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক লক্ষ্য

গত ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোয় চীন ও ভারত পাঁচটি বিষয়ে একমত হয়েছে। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেন। সেখানে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় এ দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ঐকমত্যে উপনীত হন। যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে তাঁরা একমত হয়েছেন তা হচ্ছে, সীমান্তে সম্মুখসারির সেনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সব চুক্তি ও প্রটোকল মেনে চলা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করা এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা। দুই দেশের পক্ষ থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দুই দেশের বর্তমান সীমান্ত পরিস্থিতি কোনো দেশেরই কাম্য নয়। উভয় পক্ষের উচিত সেনাদের দ্রুত নিষ্ক্রিয় করে সীমান্তে উত্তেজনা কমানো।’ 

যেকোনো বিবেচনায় চীন-ভারত সমঝোতা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বলা ভালো, গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারত সংঘর্ষ এবং ওই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর হঠাৎ করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে একটা যুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই অঞ্চলে উত্তেজনা কমেছে, এটা বলা যাবে না। বরং চীন ওই এলাকায় রাস্তা তৈরি করছে, সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে—এমন অভিযোগও উঠেছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ভারত পাঁচটি রাফায়েল যুদ্ধবিমান ফ্রান্স থেকে উড়িয়ে এনেছিল এবং তা হরিয়ানা রাজ্যের আমবালা বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন করেছিল। এর পরও এ অঞ্চলে উত্তেজনা কমেছে, তা বলা যাবে না। গেল সপ্তাহে হিমালয়ের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ৪৫ বছর পর প্রথমবারের মতো গোলাগুলি হয়েছে। দুই দেশই প্যাংগং লেক এলাকায় অতিরিক্ত সেনা, ট্যাংকসহ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে। এ ধরনের এক পরিস্থিতিতে দুই দেশ যখন এক ধরনের সমঝোতায় উপনীত হয়, তখন এ অঞ্চল তথা বিশ্বের জন্য একটি ভালো সংবাদ। 

সারা বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে আক্রান্ত এবং বড় দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতাটা যখন জরুরি, তখন চীন ও ভারত সব ভুলে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠায় যদি নিয়োজিত হয়, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। সমঝোতাটা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। অতীত ইতিহাস বলে, ১৯৪৯ সালে চীন সমাজতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে জন্মের পর ছয় বছরের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে থাকা নন-কমিউনিস্ট দেশ ও সরকারপ্রধান হিসেবে যিনি তখন বেইজিং সফরে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু। বিখ্যাত এবং আলোচিত-সমালোচিত মাও জে দংয়ের সঙ্গে নেহরুর ছবি এখনো অনেকের চোখে ভাসে। আজ থেকে ৬৬ বছর আগে ভারত ও চীন এভাবেই একটা বন্ধুত্বের সূচনা করেছিল। অনেকের ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ স্লোগানের কথা এখনো মনে আছে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রটি সম্পর্কে ওই সময় পশ্চিমা সমাজে এক ধরনের ভীতি ছিল এবং ১৯৪৮ সালের চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বে বড় ধরনের একটি ‘আতঙ্ক’ সৃষ্টি করেছিল(?), আর গণতান্ত্রিক ভারত, যে দেশটি পুঁজিবাদী বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বাইরে থেকে তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায়, পরস্পরবিরোধী এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কিভাবে সম্পর্ক হবে, এর ভিত্তি কী হবে—এটা নিয়ে শত প্রশ্ন ছিল। অনেক আপত্তি ছিল। সব আপত্তি উপেক্ষা করে নেহরু ছুটে গিয়েছিলেন চীনে। আর ওই সফরেই এই দুই নেতা, মাও জে দং ও নেহরু জন্ম দিয়েছিলেন ‘পঞ্চশীলা’ নীতির।

এর আগে জুন মাসেই (১৯৫৪) দিল্লি সফর করে গিয়েছিলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। তখনই ‘পঞ্চশীলা’র প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল চীনের তরফ থেকে, যা নেহরুর বেইজিং সফরে স্থায়ী ভিত্তি পেয়েছিল। এই ‘পঞ্চশীলা’ নীতিকে কেন্দ্র করেই ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বাং দুংয়ে সূচনা হয়েছিল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের। কিন্তু এই হিন্দি-চীনি ভাই ভাই সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬২ সালে ভারত ও চীন বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৬২ সালের পর ২০১৭ সালে হিমালয় অঞ্চলভুক্ত দোকলামেও একটি যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তখন যুদ্ধ হয়নি বটে, তবে দীর্ঘদিন উত্তেজনা বজায় ছিল। এরপর এলো ২০২০ সালের ১৫ জুনের গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের খবর। এর পরও চীন ও ভারত এক ধরনের বন্ধুত্ব নিয়ে এগিয়ে গেছে। মোদির জমানায় দুই দেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, চীনা রাষ্ট্রপ্রধান শি চিনপিং তাঁর প্রথম ভারত সফরে প্রথম অবতরণ করেছিলেন গুজরাটে।

বিশ্বরাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে তাতে এশিয়া হবে মূল কেন্দ্রবিন্দু। একে বলা হচ্ছে ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’। সম্প্রতি চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘উহান স্পিরিট’কে অন্যতম অগ্রগতি হিসেবে ধরা হয়। ২০১৮ সালের ২৭-২৮ এপ্রিল মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে চীনের প্রসিডেন্ট শি চিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ভারতের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, একটি ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ গঠনে চীন-ভারত সমঝোতা বড় ভূমিকা রাখবে। এখন মস্কো সমঝোতা এ লক্ষ্যে কাজ করুক—এটাই সবার প্রত্যাশা।

Kalerkontho

20.9.2020

0 comments:

Post a Comment