গত প্রায় দুমাস ডোকলাম নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। সেখানে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। চীন ও ভুটানের মাঝখানে ৮৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই মালভূমিটি ভুটানের হলেও, চীন এর মালিকানা দাবি করছে। সেখানে চীন এখন একটি সড়ক নির্মাণ করছে। আর তাতেই আপত্তি ভারতের। ভারত এই সড়ক নির্মাণকে তার নিরাপত্তার প্রতি একধরনের হুমকি হিসেবে দেখছে। যদিও ডোকলাম নিয়ে চীন ও ভুটানের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সেখানে ভারতের জড়িত হবার কথা নয়। কিন্তু ভারত ও ভুটানের মধ্যকার ৭০ বছরের পুরনো মৈত্রী চুক্তি অনুযায়ী ভারত ‘আমন্ত্রিত’ হয়ে ডোকলামে সৈন্য পাঠিয়েছে। সংকট বাড়লে ভুটান ভারতকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার ‘অনুরোধ’ জানালেও, ভারত তাতে কর্ণপাত করেনি। বরং ডোকলাম মালভূমির ৩৫ কিলেমিটার দূরে অবস্থিত ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি গ্রাম থেকে সেখানে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়েছে। সেখানে এখন ভারতীয় বাহিনী ছাউনি ফেলেছে। কৌশলগতভাবে ডোকলাম ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে শিলিগুড়ি করিডোর। ভারতের ভয়টা এখানেই। চীন যদি শিলিগুড়ি করিডোরে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তাহলে ভারতের সাতবোন রাজ্যের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই ডোকলাম নিজের এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখানে সেনা মোতায়েন করেছে। ফলে ডোকলামের কর্তৃত্ব নিয়ে যদি চীন-ভারত যুদ্ধ বাঁধে, তাতে ‘সুবিধা’ নেবে তৃতীয় পক্ষ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকেই জানেন চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তার সামরিক তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ষ্ঠ ফ্লিন্টের যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করা হবে। পূর্ব চীন সাগরে বেশ কটি বিতর্কিত দ্বীপ রয়েছে, যে দ্বীপগুলোর মালিকানা নিয়ে চীনের সাথে জাপান ও ফিলিপাইনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এখন এ অঞ্চলে মার্কিন নৌ সেনা মোতায়েনের অর্থ হচ্ছে চীনের উপর পরোক্ষভাবে ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। একই সাথে ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীন এ অঞ্চল ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে (বন্দর স্থাপনা, রিফুয়েলিং স্টেশন ইত্যাদি), এটাও ভাল চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ খর্ব করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগর (ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের তেলের রিজার্ভের ৬০ ভাগ, আর গ্যাস রিজার্ভের তিন ভাগের এক ভাগ) আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে চীনের প্রয়োজন রয়েছে রাশিয়ার সমর্থনের। ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ অনুযায়ী এ অঞ্চলে মস্কো, তেহরান, বেইজিং ও কলম্বের মধ্যে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছিল, সে ‘ঐক্য’-কে দৃঢ় করতেই শি জিন পিং গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৬) ভারত সফর করেছিলেন। এর আগে তিনি মস্কো যান। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে শি জিন পিং যে বক্তব্য রাখেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের প্রভাব বিস্তারের বিরদ্ধে শি জিন পিং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। চীনা রাষ্ট্রপ্রধান গেল বছরের মাঝামাঝি ব্রাজিলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকাও ব্রিকস এর অন্যতম শক্তি। ব্রিকস বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট।
২০৫০ সাল নাগাদ ব্রিকস দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২৮.৪ ট্রিলিয়ন ডলার (যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে ৩৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে)। একই সময় ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক ৩৪০ বিলিয়ন ডলার (২০১২) ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়নে। সুতরাং চীন ও ভারত কেউই ঝুঁকি নেবে না উভয় দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হোক। চীন ও ভারত, উভয়েরই উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বাণিজ্য নির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থায় এক কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে উভয় দেশই সোচ্চার। প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে সম্পর্কে উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে এটা সত্য। কিন্তু ইতিহাস বলে দেশ দুটি এক সময় বন্ধু ছিল। মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি- চিনি ভাই ভাই’ সেøাগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন যে ‘পঞ্চশীলা নীতি’ নীতি গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে এই পঞ্চশীলা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এই পঞ্চলীলার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহেরু-চৌএন লাই ইমেজ আবার ফিরে এসেছিল ‘মোদি-শি জিন পিং বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। এটি এখন কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির সেপ্টেম্বরে বেইজিং সফর (২০১৭) দুদেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।
এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি ভারতকে একটি বিশ্ব শক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এই প্রভাব কাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা মোদি কতটুকু পারেন? তবে এটা তো সত্য মোদির নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তার চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি প্রথম চীন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। তার বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা। এখন ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত ‘দ্বন্দ্ব’ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে মোদি তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে তিনি বেশি দূর যেতে পারবেন না। তিনি ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করবেন। প্রতিবছর ১২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ সেখানে ‘জব মার্কেটে’ প্রবেশ করছে। এদের জন্য কাজ দরকার। চীনের মতোই ভারতকে একটি ‘পণ্যের উৎপাদনশীল’ দেশে পরিণত করতে চান মোদি। চীনের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়লে, সেনাবাহিনী চাইবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ভার বাড়ানোর। ভারত তার নৌ ও বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণ করছে। নৌবাহিনীতে মোট ২৮টি সাবমেরিন সংযোজনের (বর্তমানে আছে ১৫টি) উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
বিমানবাহিনীতে নতুন বিমান আসছে। ভারত এখন নিজেই তৈরি করবে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান। লকহিড়ের সাথে চুক্তিও হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আগামীতে আরও বাড়বে। সীমান্ত সমস্যা, বিশেষ করে ডোকলাম সমস্যার সমাধান যদি না হয়, তাহলে এই উত্তেজনা অন্য অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হবে। খুব সংগত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাতে আক্রান্ত হবে, যা এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো ভাল খবর নয়। আগামী মাসে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিকস এর র্শীষ সম্মেলন। নরেন্দ্র মোদির সেখানে যাবার কথা এবং মোদি শি জিন পিং এর মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনাও বেশি। কিন্তু দুপক্ষ যদি নমনীয় না হয় এবং সেখানে যদি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় না থাকে, তাহলে আগামীতে ব্রিকস ভেঙে যাবার ঝুঁকিতে থাকবে। তাই এ মুহূর্তে ডোকলাম থেকে সকল পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার জরুরি। দুঃখজনক হচ্ছে দুমাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কোনো পক্ষই নমনীয় হচ্ছে না। এরই মাঝে লাদাখে ভারত ও চীনা সেনাবাহিনীর মধ্যে হাতাহাতির খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। তবে ভারত যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না। এর অনেকগুলো কারণ আছে।
প্রথমত, যুদ্ধ বেঁধে গেলে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দের জন্য জোর দাবি করবে। মোদি সরকার সেটা দিতে বাধ্য হবে। ফলে মোদির বহুল আলোচিত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ শুরু হলে চীন ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। চীনের গণমাধ্যম ইতোমধ্যে বলেছে প্রয়োজনে চীন সিকিম স্বাধীন করে দেবে। অরুণাচল নিয়ে চীন তার দাবি পরিত্যাগ করেনি। এক্ষেত্রে চীন অরুণাচলের অংশ বিশেষ দখল করে নিতে পারে। তৃতীয়ত, ডোকলাম থেকে ভারত যদি তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে না নেয়, তাহলে চীন কাশ্মীরে সেনা মোতায়েন করতে পারে। চীন এটা করতে পারে (?) পাকিস্তানের আমন্ত্রণ রক্ষা করে, যেমনি ভারত করেছে ভুটানের আমন্ত্রণ রক্ষা করে। চতুর্থত, যুদ্ধ বেঁধে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোতে তার সামরিক প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে। অন্যদিকে চীন চাইবে এই দেশগুলো যাতে চীনের প্রতিপক্ষ হয়ে না ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে চীনের উপর নির্ভরশীল। তারা চীনবিরোধী কোনো অবস্থান নাও নিতে পারে। পঞ্চমত, যেকোনো যুদ্ধে চীন ভারতীয় পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে পারে। ভারতে চীনের রপ্তানি, আমদানির তুলনায় পাঁচগুণ বেশি।
উপরন্তু দক্ষিণ চীন সাগর ভারতের অন্যতম বাণিজ্য পথ। চীন এ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরভুক্ত দেশগুলোর মাঝে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। কেননা দেশ দুটি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা ছিল চীনের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এক্ষেত্রে ভারতের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে ডোকলাম নিয়ে আদৌ চীন-ভারত যুদ্ধ হবে না। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকবে। তবে এতে করে সমস্যার সমাধান হবে না। ভারতকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে চীনও তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে পারে। সমস্যার সমাধান সেখানেই নিহিত।
Daily Amader Orthonity
23.08.2017
0 comments:
Post a Comment