নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার কথা বলেছি আমরা সবাই। আমি আমার বক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি সংবিধানের ১১৮(৪) ও ১২৬নং অনুচ্ছেদের কথা। ১১৮(৪)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন।’ আর ১২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।’ এর অর্থ পরিষ্কার- একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে এ দায়িত্বটি পালন করতে হবে- এটাই ছিল সবার অভিমত। সংলাপে এমন অভিমত দেয়া হয়েছে যে, নির্বাচনপূর্ব তিন মাস তিনটি মন্ত্রণালয়ের (জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য) পূর্ণ কর্তৃত্ব নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। এটি হলে ওই সময় যে সরকার থাকবে, তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব খাটাতে পারবে না। আর এভাবেই নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান শক্তিশালী করতে তথা সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে।
সংলাপে আমরা প্রায় সবাই বলার চেষ্টা করেছি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, যা নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না হলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর ব্যাপারে সিইসির এর আগের বক্তব্য সংলাপে সমালোচিত হয়েছে। সিইসি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে তার করার কিছু নেই।’ এটা অনাকাক্সিক্ষত এবং ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ সৃষ্টি করার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের, এ কথাও তাকে সংলাপে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিত্যুত্তরে সিইসি অবশ্য কোনো কথা বলেননি। কোনো যুক্তিই তিনি খণ্ডন করেননি। তিনি প্রতিটি বক্তব্যের ‘নোট’ নিয়েছেন এবং কখনও কখনও এর ব্যাখ্যাও চেয়েছেন।
আমি ধারণা করেছিলাম, সংলাপ ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু তেমনটি হয়নি। সম্ভবত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা কাজ করেছিল যে, নির্বাচনের আগে ‘সহায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হবে কি হবে না, তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৬, ৫৫(২) ও ৫৬(৪) প্রয়োগ করে স্বয়ং নির্বাচন কমিশন ‘সহায়ক সরকারের’ ভূমিকা পালন করতে পারে, এমন অভিমতও দিয়েছেন কেউ কেউ। মোদ্দাকথা, সংলাপে অংশ নেয়া প্রায় সবার অভিমত হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করুক।
এ তিনটি মূল ইস্যুর বাইরে নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার না করা, প্রার্থীদের (সংসদ নির্বাচনে) সম্পদের পরিমাণ জানিয়ে দেয়া, রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা, নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার, দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি মতামতও দেয়া হয়। এর বাইরে আমার আরও অভিমত ছিল নিন্মরূপ : ১. আচরণবিধিমালায় (সেপ্টেম্বর ২০০৮) সংশোধন এবং পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য না দেয়ার বিধি অন্তর্ভুক্ত করা, ২. স্থানীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে একটি ‘পর্যবেক্ষক টিম’ গঠন করা, যারা মনিটর করবেন এবং সরাসরি ইসিকে রিপোর্ট করবেন, ৩. স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান চালু করা। প্রার্থী অনলাইনেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন, ৪. একাধিক প্রার্থী যদি সমানসংখ্যক ভোট পান, তাহলে লটারি না করে আবার ভোট গ্রহণ করা। শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পেলে মূল দুই প্রার্থীর মধ্যে আবার ভোট গ্রহণ করা, ৫. সংসদ সদস্যের যোগ্যতা গ্রাজুয়েশন নির্ধারণ করা। তবে দেখতে হবে, তা যেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, ৬. সিভিল, মিলিটারি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন সদস্যরা অবসরের ৫ বছর পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং একই সঙ্গে দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে তা অনুমোদিত হওয়া, ৭. হলফনামায় দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা এবং ভুয়া তথ্যের কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিধান সুস্পষ্ট করা (নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের বিষয়টি আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারি), ৮. দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রার্থী পদে বিধিনিষেধ আরোপ, ৯. মনোনয়ন প্রার্থীদের সবার টিআইএন নম্বর প্রদান বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি।
সংলাপের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এসব প্রস্তাবের কতটুকু ইসি গ্রহণ করবে এবং নভেম্বরে যে খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হবে তাতে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে। সিইসি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন এবং আমি তার ওপর আস্থাটি রাখতে চাই। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। সরকার এর কতটুকু গ্রহণ করবে? আর সরকার যদি ইসির সুপারিশ গ্রহণ না করে, তাহলে ইসিরইবা কী করণীয় আছে? আসল কথা এটাই। সরকার সুপারিশমালা গ্রহণ না করলে ইসি সাংবিধানিকভাবে একক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কিনা? একটা সংশয় এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে, এ সংলাপ শেষ পর্যন্ত ‘লোক দেখানো’ এবং শুধু ‘ফটোসেশনের’ মধ্য দিয়েই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থেকে যেতে পারে! আমন্ত্রিত অতিথিদের একজন, যিনি সংলাপে অংশ নেননি, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, এ ধরনের সংলাপ অর্থহীন। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই ‘ছাড়’ দেবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সুতরাং সরকার যদি উত্থাপিত অভিমতগুলো বিবেচনায় না নেয়, তাহলে সরকারকে অভিযুক্ত করা যাবে না। আমরা শুধু প্রত্যাশা করতে পারি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু হচ্ছে আগস্টে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪২। এক্ষেত্রে এদের সঙ্গে ক’দিন ধরে সংলাপ চলবে, এটাও একটা প্রশ্ন। তবে জাতি তাকিয়ে থাকবে বিএনপির দিকে। বিএনপি কী প্রস্তাব দেয়, সেটিই দেখার বিষয়। সংলাপে বিএনপি সহায়ক সরকারের কোনো প্রস্তাব দেয় কিনা, এটা নিয়ে আগ্রহ থাকবে অনেকের। তবে না দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। খালেদা জিয়া এখন লন্ডনে। দু’মাস পর তিনি ফিরবেন। বলা হচ্ছে, ফিরে এসে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সহায়ক সরকারের ফর্মুলা দেবেন। জাতি এখন তাকিয়ে থাকবে তার ফিরে আসার দিকে।
সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল। বলা যেতে পারে, এক ধরনের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শুরু করে দিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ইসিকে যেতে হবে অনেক দূর। সামনের দিনগুলো যে খুব ভালো ও স্বচ্ছ, তা বলা যাবে না। প্রথম দিনের সংলাপে সিইসিকে আমার আন্তরিক বলেই মনে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, তা তিনি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সংলাপে সুশীল সমাজের আস্থা তিনি পেয়েছেন। এটা তার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা (বিশেষ করে বিএনপির) যদি তিনি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে ইতিহাসে একজন সফল সিইসি হিসেবে তিনি জায়গা করে নিতে পারবেন। আমি তার শুভ কামনা করি।
Daily Jugantor
02.08.2017
0 comments:
Post a Comment