রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিশ্ব নেতৃত্বের যোগ্যতা হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ওয়াশিংটনে শেষ পর্যন্ত শাটডাউন পরিস্থিতির অবস্থান ঘটলেও ১৬ দিনের এই সংকট বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঋণসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত পাস হওয়ায় ফেডারেল কর্মচারীরা কাজে ফিরে আসবেন বটে; কিন্তু আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে আবার সংকট দেখা দিতে পারে। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বড় দেশ, বড় অর্থনীতি। জিডিপির পরিমাণ ১৫.৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই কিনা ফেডারেল সরকারের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছিল না। ৮ লাখ সরকারি কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছিল। ভবিষ্যতে এদের কতজন কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারবেন কিংবা ফিরে এলেও পুরনো বেতন পাবেন কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে Special supplemental Nutrition Program for women, infants and children. এর আওতায় মা ও শিশুরা ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য পেতেন, তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফেডারেল সরকারের হাতে কোনো টাকা ছিল না। তারা কোনো বিলই পরিশোধ করতে পারছিল না। শাটডাউনের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল অচলাবস্থা। নতুন অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ এবং সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার (ওবামা কেয়ার) নিয়ে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরোধের জের ধরে ওই সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। ওবামার সঙ্গে রিপাবলিকানদের আলোচনাও ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যে অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ কীভাবে পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তবে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফেডারেল সরকারের হাতে টাকা ছিল না। অথচ এর চেয়ে বেশি টাকা আছে ৯টি বড় বড় কোম্পানির। যেখানে ফেডারেল সরকারের রাজস্ব বিভাগের পরিচালনা ব্যয় ৩২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি ফেডারেল সরকারের চেয়ে বেশি। যেমন জেনারেল ইলেকট্রিক ৮৮.৮৬ বিলিয়ন ডলার, মাইক্রোসফট ৭৭.০২ বিলিয়ন, গুগল ৫৪.৪৩ বিলিয়ন, সিসকো ৫০.৬১ বিলিয়ন, অ্যাপেল ৪২.৬১ বিলিয়ন, ওরাকল ৩৯.১০ বিলিয়ন, ফোর্ড ৩৬.৩১ বিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায়, ফেডারেল সরকারের আর্থিক ভিত্তি কত দুর্বল।

ফেডারেল সরকারের শাটডাউনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে 'ইমেজ' সংকটের মুখে পড়েছে, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান প্রগ্রেস ৭টি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছে। তারা বলছে, এর ফলে মেইন স্টেটের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার শীতকালে ঘরবাড়ি গরম রাখার যে সরকারি সাহায্য পেত, তা পাবে না। বেকার ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। শিশুদের জন্য আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। 'ফুড স্টাম্প' কর্মসূচিও আর থাকবে না। বিশেষায়িত সেবা (অটিজম, পঙ্গুদের জন্য) ও স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে যাবে। সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। শুধু তাই নয়, এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। বিখ্যাত ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে রিচার্ড এন হাস এ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ লিখেছেন গত ১১ অক্টোবর (The real threat to USA's National Security) । আসলে বড় অর্থনীতির দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী নয়। ঋণ গ্রহণ করে (চীন থেকে) সরকার চালাতে হয়। মানুষের মাঝে যে বৈষম্য তা-ও কমাতে পারেনি সরকার।

মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাড়ছিল দেশটির দরিদ্রতা। এই অসমতাই তরুণ সমাজকে ২০১১ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জুকোটি পার্ক বেছে নেওয়ার কারণও একটি_ জুকোটি পার্কের পাশেই ওয়ালস্ট্রিট, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক একচেঞ্জ। আর তাই ওই স্টক একচেঞ্জকে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। ওয়ালস্ট্রিটের আশপাশের ভবনে রয়েছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠনের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখানে অবস্থিত। মার্কিন সমাজে অসমতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে দেশের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করতেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক ইমানুয়েল সাজের মতে, ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। অধ্যাপক ডেভিড গ্রে অপর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রে গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। তার মতে, শীর্ষে থাকা এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিসের মতে, শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করতেন মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ। এই যে অসমতা ও সম্পদ কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া ও সম্পদের সমতা রক্ষা করার জন্যই জন্ম হয়েছিল 'অকুপাই মুভমেন্টে'র। সেটা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার_ একটা প্রতিবাদ। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। ষাটের দশকে ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে তরুণ সমাজও এভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজেও যে অসমতা ও দরিদ্রতা রয়েছে তা ছিল অকল্পনীয়। খোদ নিউইয়র্ক শহরেও অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই। চাকরি নেই। ফুড স্ট্যাম্পে তাদের দিন চলে। এই নিউইয়র্ক শহরে ম্যানহাটন এলাকায় আমি অনেক যুদ্ধাহত আমেরিকানকে দেখেছি ভিক্ষা করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র (ইরাক ও আফগানিস্তানে) যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে একজন যুদ্ধাহত নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রটি! অনেকের কাছেই এই বৈষম্য বিশ্বাস করা কঠিন! তাই হঠাৎ করেই 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটে'র জন্ম হয়নি। ধীরে ধীরে তরুণ সমাজের ক্ষোভ বাড়ছিল আর তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল নিউইয়র্কে ২০১১ সালে। কিন্তু তা কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে মার্কিন সমাজে? আমরা যখন 'ওয়াশিংটনে শাটডাউন পরিস্থিতি' নিয়ে আলোচনা করছি, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি পরিষদে 'ফুড স্টাম্পে' অর্থ বরাদ্দ ৪০ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়েছে। এই 'ফুড স্টাম্প' কর্মসূচি হচ্ছে ফেডারেল সরকারের একটি অনুদান, যার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের গরিব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করা হয়। এই ফুড স্টাম্পের বিনিময়ে নিম্ন আয়ের মানুষরা খাদ্য কিনে থাকেন ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তায়। এখন রিপাবলিকানরা এটা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছর ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ এই সহায়তা পাবে না। শুধু তাই নয়, এই কর্মসূচির আওতায় কয়েক লাখ শিশু দুপুরে স্কুলে কোনো 'ফ্রি লাঞ্চ' পাবে না। এর ফলে মানুষে মানুষে অসমতা ও দরিদ্রতা আরও বাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ের অসমতার আরেকটি চিত্র তুলে ধরেছে 'সেন্টার ফর আমেরিকান প্রসেস' নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা দেখিয়েছে (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩), যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৫টি শিশুর মাঝে একটি শিশু দরিদ্র। তাদের মতে, ২০১২ সালে ১৪ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ (৪৯ মিলিয়ন) ক্ষুধার জন্য লড়াই করেছিল। আফ্রো-আমেরিকানদের এই সংখ্যা ২৫ ভাগ, হিসপানিক ২৩ ভাগ। ফুড স্টাম্পের কারণে (The Supplement Nutrition Assistance Program) ২০১১ সালে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন শিশু দরিদ্রতার চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেনও দরিদ্রতা দূর করতে পেরেছে।

এখনও শাটডাউন পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান হয়নি। আপাতত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করে সরকার চালাতে পারবে। কিন্তু তারপর? শাটডাউনের অবসান ঘটলেও মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
দৈনিক সমকাল, ২৬ অক্টোবর, ২০১৩।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট

অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়্র

tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment