প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে সর্বদলীয় সরকারের যে প্রস্তাব করেছেন, খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে তার প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যেখানে একটি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব করেছেন, সেখানে খালেদা জিয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করেছেন। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে রয়েছে বিগত ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পাঁচজন করে সদস্য দিয়ে মোট ১০ জনের সমন¦য়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এতে পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে আওয়ামী লীগ, আর পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে বিএনপি। সর্বোপরি এই সরকারের প্রধান যিনি হবেন, তার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। স্পষ্টই খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের ঠিক উল্টো। খালেদা জিয়া যে সরকারের প্রস্তাব করেছেন, তা সংবিধানে নেই। এটা করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যেহেতু সংসদের কার্যক্রম এখনও চলছে, সেহেতু তত্ত্বগতভাবে সংবিধান সংশোধন সম্ভব।
কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে সরকার ও সরকারি দল মনে করে না। তাহলে সঙ্কট কি অনিবার্য? সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব নয়? আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সঙ্কটের গভীরতা আরও বাড়ল। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবেরও কোনো জট খোলেনি। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা-এরশাদ বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠক নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। যেখানে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নির্বাচনে বিএনপি না এলে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে যাবে; সেখানে এরশাদ স্বয়ং জানিয়ে দিলেন, সব দল নির্বাচনে না গেলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না। জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে না, একথা এরশাদের মুখ থেকে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে, তিনি সত্যি সত্যিই মহাজোট ছাড়বেন কিনা?
এখন স্পষ্টতই জাতি বিভক্ত হয়ে আছে। শুধু বিভক্ত নয়, বরং একটি বড় ধরনের সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বাস্তবতা। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে, ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। দেশের এক চরম সঙ্কটকালে প্রধানমন্ত্রী এ ভাষণ দিলেন। কিন্তু এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে দেশের চলমান সঙ্কটের সমাধান হবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা, মূল যে সমস্যাটিকে কেন্দ্র কের বর্তমান সঙ্কটের জন্ম, অর্থাৎ একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের যে দাবি, সে দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এতটুকুও ছাড় দেননি। বিকল্প হিসেবে তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠনের একটি প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব নিয়েও আছে নানা কথা। কেননা, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের কোনো কথা সংবিধানে নেই। প্রধানমন্ত্রী কোন ধারাবলে এই সরকার গঠন করবেন? এটা যদি তিনি করেন, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে পারে। সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার পরস্পর সাংঘর্ষিক। একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই যদি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠত না। এটা প্রধানমন্ত্রীর অধিকার। এখন নির্বাচনের তিন মাস আগে শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার, যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ নেই, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। উপরন্তু সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, সে ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই সরকারের প্রধান হবেন। এক্ষেত্রে একজন দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি যদি সরকার প্রধান থাকেন, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কিনাÑ এ ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় বলতে কোন কোন দলের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তার নেতৃত্বে একটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। ওই মহাজোটে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বেশ কিছু ছোট দল রয়েছে। মন্ত্রিসভায় ওয়ার্কার্স পার্টির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এক্ষেত্রে বিএনপির দু’জন থেকে তিনজন মন্ত্রী দিয়ে তো মন্ত্রিসভায় ব্যালেন্স হবে না। এখন সর্বদলীয় সরকারের নামে মহাজোট সরকারের প্রতিনিধিত্বই থেকে যাবে। তাতে জট খুলবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বদলীয় সরকারে কী জামায়াত থাকবে? জামায়াতের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ধারণা করছি, জামায়াত সেখানে থাকবে না। কেননা সরকারের ‘বন্ধুরা’ বিশেষ করে বাম সংগঠনগুলো এটা চাইবে না। যুদ্ধাপরাধী মামলায় জামায়াতের নেতারা অভিযুক্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত। তাদের ব্যাপারে আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জামায়াতকে বাদ দিলে (?) কী সর্বদলীয় চরিত্র পাবে ওই মন্ত্রিসভা?
প্রধানমন্ত্রী কবে নির্বাচন হবে, তার একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ২৫ অক্টোবরের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে চান। সংবিধানে এভাবেই লেখা আছে। এটা সংবিধানসম্মত। তবে মনে রাখতে হবে, একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে যদি সমঝোতায় উপনীত হওয়া না যায়, তাহলে ৯০ দিনের মাঝে নির্বাচন করা যাবে বটে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ তাতে না থাকলে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আসলে মূল প্রশ্ন যা তা হচ্ছে, বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নেয়া। এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। সংসদে বিএনপির কম আসন রয়েছেÑ এটা সত্য কথা। কিন্তু এই কম আসন দিয়ে বিএনপিকে বিচার করা হলে বিএনপির প্রতি অবিচার করা হবে। বিগত নির্বাচনেও বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। চারদলীয় জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার শতকরা প্রায় ৩৮ ভাগ। এখন বিএনপি বলছে, সর্বদলীয় সরকারে তারা যোগ দেবে না। বরং তারা নির্বাচন প্রতিহত করার কথা বলছে। তাহলে ক্ষমতাসীন মহাজোটকে এককভাবে নির্বাচন করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অনেক সময় সংবিধানের বাইরে গিয়েও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ঐক্য গড়ে তুলতে হয়। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। আমাদের কাছে পাকিস্তান, নেপাল কিংবা গ্রিস ও বুলগেরিয়ার ইতিহাসও আছে। আর মালদ্বীপের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদও বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে, এ মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ দশমিক ৩ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির ঘরে। আর জামায়াতকে নিয়ে এই হার ৫৩ দশমিক ২০ ভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের হার ৩৬ দশমিক ৫০। বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপে এই জনমত জরিপ নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন জনমত জরিপই জানিয়ে দিয়েছিল, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফলে তাই জনমত জরিপের প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে এই জনমত জরিপ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থেই এই জনমতে সাধারণ মানুষের মতামত কতটুকু প্রতিফলিত হয়, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এ জনমত জরিপ কিছুটা হলেও একটা আবেদন তুলবে। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এ জনমত জরিপ দিয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিকে বোঝা যাবে না।
পরিস্থিতি যা, তাতে করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে বাধ্য। নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠনের সম্ভাবনা আদৌ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির নেতারা বলছেন, কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এই যে পরস্পরবিরোধী মনোভাব, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে আদৌ সাহায্য করবে? একজন সাধারণ মানুষকে এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলে তিনিও না বলবেন। আমরা বারবার বলেছি, আস্থার সম্পর্ক স্থাপন না করলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। দেশ আজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কি আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন? প্রধানমন্ত্রীর আগের ভাষণে নতুন কিছু ছিল না। সেই পুরনো কথা। উন্নয়নের কথা। বিরোধী দলের তথাকথিত অপতৎপরতার কথা! প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যেও জট খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। যারা সরকারে থাকেন, তারা অভিভাবক। উদ্যোগ তাদেরই নিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগই ছিল প্রধান। কিন্তু চলমান সঙ্কটের সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে সঙ্কটের গভীরতা আরও বাড়ছে। খালেদা জিয়া চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে দুই মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে আগ্রহ দেখায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের দূতের বাংলাদেশ সফরের সময় বিরোধী দলকে একটি চিঠি লেখার কথা ছিল সরকারের। সেই চিঠি আর লেখা হয়নি। তবে এখন লেখা হয়েছে ও হচ্ছে বলে জানা গেছে। আলাপ হয়েছে ফোনে ফোনেও।
রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিক্স’ বা বাস্তববাদী যে নীতির কথা আমরা বলি, তা এখন আর দৃশ্যমান নয়। জাতির সামনে কোনো অভিভাবকের দেখাও মিলছে না, যিনি জাতিকে পথ দেখাবেন। সরকার নির্বাচন করতেই পারে। কিন্তু ওই নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। চাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব। চাই সমঝোতা। চাই সংলাপ। খালেদা জিয়া এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন তার কথা। মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। লাগাতার হরতাল আর অবরোধের কথা বলা হচ্ছে। কোন পথে এখন বাংলাদেশ?
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ২৫ অক্টোবর ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও কলাম লেখক
tsrahimoubd@yahoo.com - See more at: http://alokitobangladesh.com/editorial/2013/10/26/30254#sthash.lgrTAFge.6oURipUr.dpuf
কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে সরকার ও সরকারি দল মনে করে না। তাহলে সঙ্কট কি অনিবার্য? সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব নয়? আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সঙ্কটের গভীরতা আরও বাড়ল। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবেরও কোনো জট খোলেনি। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা-এরশাদ বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠক নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। যেখানে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নির্বাচনে বিএনপি না এলে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে যাবে; সেখানে এরশাদ স্বয়ং জানিয়ে দিলেন, সব দল নির্বাচনে না গেলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না। জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে না, একথা এরশাদের মুখ থেকে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে, তিনি সত্যি সত্যিই মহাজোট ছাড়বেন কিনা?
এখন স্পষ্টতই জাতি বিভক্ত হয়ে আছে। শুধু বিভক্ত নয়, বরং একটি বড় ধরনের সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বাস্তবতা। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে, ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। দেশের এক চরম সঙ্কটকালে প্রধানমন্ত্রী এ ভাষণ দিলেন। কিন্তু এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে দেশের চলমান সঙ্কটের সমাধান হবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা, মূল যে সমস্যাটিকে কেন্দ্র কের বর্তমান সঙ্কটের জন্ম, অর্থাৎ একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের যে দাবি, সে দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এতটুকুও ছাড় দেননি। বিকল্প হিসেবে তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠনের একটি প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব নিয়েও আছে নানা কথা। কেননা, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের কোনো কথা সংবিধানে নেই। প্রধানমন্ত্রী কোন ধারাবলে এই সরকার গঠন করবেন? এটা যদি তিনি করেন, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে পারে। সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার পরস্পর সাংঘর্ষিক। একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই যদি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠত না। এটা প্রধানমন্ত্রীর অধিকার। এখন নির্বাচনের তিন মাস আগে শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার, যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ নেই, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। উপরন্তু সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, সে ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই সরকারের প্রধান হবেন। এক্ষেত্রে একজন দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি যদি সরকার প্রধান থাকেন, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কিনাÑ এ ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় বলতে কোন কোন দলের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তার নেতৃত্বে একটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। ওই মহাজোটে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বেশ কিছু ছোট দল রয়েছে। মন্ত্রিসভায় ওয়ার্কার্স পার্টির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এক্ষেত্রে বিএনপির দু’জন থেকে তিনজন মন্ত্রী দিয়ে তো মন্ত্রিসভায় ব্যালেন্স হবে না। এখন সর্বদলীয় সরকারের নামে মহাজোট সরকারের প্রতিনিধিত্বই থেকে যাবে। তাতে জট খুলবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বদলীয় সরকারে কী জামায়াত থাকবে? জামায়াতের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ধারণা করছি, জামায়াত সেখানে থাকবে না। কেননা সরকারের ‘বন্ধুরা’ বিশেষ করে বাম সংগঠনগুলো এটা চাইবে না। যুদ্ধাপরাধী মামলায় জামায়াতের নেতারা অভিযুক্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত। তাদের ব্যাপারে আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জামায়াতকে বাদ দিলে (?) কী সর্বদলীয় চরিত্র পাবে ওই মন্ত্রিসভা?
প্রধানমন্ত্রী কবে নির্বাচন হবে, তার একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ২৫ অক্টোবরের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে চান। সংবিধানে এভাবেই লেখা আছে। এটা সংবিধানসম্মত। তবে মনে রাখতে হবে, একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে যদি সমঝোতায় উপনীত হওয়া না যায়, তাহলে ৯০ দিনের মাঝে নির্বাচন করা যাবে বটে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ তাতে না থাকলে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আসলে মূল প্রশ্ন যা তা হচ্ছে, বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নেয়া। এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। সংসদে বিএনপির কম আসন রয়েছেÑ এটা সত্য কথা। কিন্তু এই কম আসন দিয়ে বিএনপিকে বিচার করা হলে বিএনপির প্রতি অবিচার করা হবে। বিগত নির্বাচনেও বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। চারদলীয় জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার শতকরা প্রায় ৩৮ ভাগ। এখন বিএনপি বলছে, সর্বদলীয় সরকারে তারা যোগ দেবে না। বরং তারা নির্বাচন প্রতিহত করার কথা বলছে। তাহলে ক্ষমতাসীন মহাজোটকে এককভাবে নির্বাচন করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অনেক সময় সংবিধানের বাইরে গিয়েও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ঐক্য গড়ে তুলতে হয়। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। আমাদের কাছে পাকিস্তান, নেপাল কিংবা গ্রিস ও বুলগেরিয়ার ইতিহাসও আছে। আর মালদ্বীপের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদও বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে, এ মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ দশমিক ৩ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির ঘরে। আর জামায়াতকে নিয়ে এই হার ৫৩ দশমিক ২০ ভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের হার ৩৬ দশমিক ৫০। বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপে এই জনমত জরিপ নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন জনমত জরিপই জানিয়ে দিয়েছিল, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফলে তাই জনমত জরিপের প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে এই জনমত জরিপ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থেই এই জনমতে সাধারণ মানুষের মতামত কতটুকু প্রতিফলিত হয়, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এ জনমত জরিপ কিছুটা হলেও একটা আবেদন তুলবে। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এ জনমত জরিপ দিয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিকে বোঝা যাবে না।
পরিস্থিতি যা, তাতে করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে বাধ্য। নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠনের সম্ভাবনা আদৌ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির নেতারা বলছেন, কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এই যে পরস্পরবিরোধী মনোভাব, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে আদৌ সাহায্য করবে? একজন সাধারণ মানুষকে এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলে তিনিও না বলবেন। আমরা বারবার বলেছি, আস্থার সম্পর্ক স্থাপন না করলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। দেশ আজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কি আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন? প্রধানমন্ত্রীর আগের ভাষণে নতুন কিছু ছিল না। সেই পুরনো কথা। উন্নয়নের কথা। বিরোধী দলের তথাকথিত অপতৎপরতার কথা! প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যেও জট খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। যারা সরকারে থাকেন, তারা অভিভাবক। উদ্যোগ তাদেরই নিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগই ছিল প্রধান। কিন্তু চলমান সঙ্কটের সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে সঙ্কটের গভীরতা আরও বাড়ছে। খালেদা জিয়া চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে দুই মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে আগ্রহ দেখায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের দূতের বাংলাদেশ সফরের সময় বিরোধী দলকে একটি চিঠি লেখার কথা ছিল সরকারের। সেই চিঠি আর লেখা হয়নি। তবে এখন লেখা হয়েছে ও হচ্ছে বলে জানা গেছে। আলাপ হয়েছে ফোনে ফোনেও।
রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিক্স’ বা বাস্তববাদী যে নীতির কথা আমরা বলি, তা এখন আর দৃশ্যমান নয়। জাতির সামনে কোনো অভিভাবকের দেখাও মিলছে না, যিনি জাতিকে পথ দেখাবেন। সরকার নির্বাচন করতেই পারে। কিন্তু ওই নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। চাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব। চাই সমঝোতা। চাই সংলাপ। খালেদা জিয়া এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন তার কথা। মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। লাগাতার হরতাল আর অবরোধের কথা বলা হচ্ছে। কোন পথে এখন বাংলাদেশ?
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ২৫ অক্টোবর ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও কলাম লেখক
tsrahimoubd@yahoo.com - See more at: http://alokitobangladesh.com/editorial/2013/10/26/30254#sthash.lgrTAFge.6oURipUr.dpuf
0 comments:
Post a Comment