কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে ২৪ অক্টোবরের পর? সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে যদি নির্বাচন দিতে হয়, তাহলে ২৪ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু সরকার সেটি করছে না। বরং সংসদ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে, তেমন একটি সংবাদ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও তা সুস্পষ্ট করেছেন।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতার কথা খোদ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হলেও, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে বলে গিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু বিএনপিকে বাদ দিয়ে সেই টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এটি উপলব্ধি করছেন না। সমঝোতার সম্ভাবনা যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীরা অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিরোধী দলের সমালোচনা করছেন।
প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল, মহাজোট সরকারের শরিকরা এবং সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ চাচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি সরকার, যার মাধ্যমে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বিষয়টির এখনও ফয়সালা হয়নি। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন। এতে করে কী মন্ত্রীরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবেন না? একজন মন্ত্রী যখন ‘মন্ত্রী’ থাকবেন, তিনি প্রটোকল পাবেন যখন তিনি নির্বাচনী এলাকায় যাবেন। তখন স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে কীভাবে? মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চাকে ব্যাহত করবে। মন্ত্রীদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার জন্যই মূলত এই সিদ্ধান্ত। তৃতীয়ত, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা হতে পারত নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কমিশনের সদস্যরা আশ্চর্যরকমভাবে এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেবে। এতে করে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর, তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন, তখন পুরো ‘প্রটোকল’ তিনি পাবেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রাখবেন। তাতে করে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে না। পঞ্চমত, মোহাম্মদ নাসিম সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ঠিক মতো কাজ না করলে’ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এতে করেও কী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেল না?
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টিও বলছে তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউই কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্রু! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরও দুই টার্ম রাখার। কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কিনা? তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতিনির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন, তা কী টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা? বনমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়া তালেবানদের নেতা! তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন বলি? মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবেÑ ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এই দুটো বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায়, তা আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন না। বিগত নির্বাচনে নাসিম সাহেব অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। এখন আবার লাইমলাইটে আসতে চান। আবারও মন্ত্রী হতে চান! প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যই এসব কথা বলা। কী যোগ্যতা আছে বনমন্ত্রীর বেগম জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করার? কে তাকে চেনে? কি তার পরিচয়? জাতীয় রাজনীতিতে তার অবদান কতটুকু?
রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপরপক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ এক সময় ছিল, তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কী শেখাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হলো কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে; কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’Ñ এই মানসিকতা পরিবর্তন করাও জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিতে যাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচন! বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও। এর ফলাফলও সবাই জানেন।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক একটি জনমত জরিপ চালিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিএনপিকে ওইসব জরিপে এগিয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য এসব জরিপ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ঈদের পর বড় ধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের ডাক দিয়েছে দলটি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের আহ্বান একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। বেগম জিয়া হঠাৎ করেই সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন চিকিৎসার(!) জন্য। মানুষ এটা নিয়ে নানা কথা বলছে। তিনি কী সিঙ্গাপুর থেকে শেষ মেসেজ (?) নিয়ে এসেছেন। ২৫ অক্টোবরের আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। পাল্টাপাল্টি জনসভাও আহ্বান করা হয়েছে ওইদিন। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে। সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। এখন কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ? একটি জাতীয় দৈনিক মন্তব্য করেছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে পারে(?)। সহযোগী অন্য একটি দৈনিক বলছে, বেগম জিয়া গ্রেফতার হতে পারেন(?)। এ ধরনের সংবাদ টেকসই গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ২৪ অক্টোবরের পরের দিনগুলো নিয়ে তাই আশঙ্কা, উদ্বেগ আর আতঙ্ক রয়েই গেল।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ১৫ অক্টোবর ২০১৩
পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতার কথা খোদ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হলেও, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে বলে গিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু বিএনপিকে বাদ দিয়ে সেই টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এটি উপলব্ধি করছেন না। সমঝোতার সম্ভাবনা যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীরা অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিরোধী দলের সমালোচনা করছেন।
প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল, মহাজোট সরকারের শরিকরা এবং সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ চাচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি সরকার, যার মাধ্যমে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বিষয়টির এখনও ফয়সালা হয়নি। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন। এতে করে কী মন্ত্রীরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবেন না? একজন মন্ত্রী যখন ‘মন্ত্রী’ থাকবেন, তিনি প্রটোকল পাবেন যখন তিনি নির্বাচনী এলাকায় যাবেন। তখন স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে কীভাবে? মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চাকে ব্যাহত করবে। মন্ত্রীদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার জন্যই মূলত এই সিদ্ধান্ত। তৃতীয়ত, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা হতে পারত নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কমিশনের সদস্যরা আশ্চর্যরকমভাবে এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেবে। এতে করে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর, তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন, তখন পুরো ‘প্রটোকল’ তিনি পাবেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রাখবেন। তাতে করে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে না। পঞ্চমত, মোহাম্মদ নাসিম সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ঠিক মতো কাজ না করলে’ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এতে করেও কী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেল না?
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টিও বলছে তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউই কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্রু! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরও দুই টার্ম রাখার। কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কিনা? তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতিনির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন, তা কী টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা? বনমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়া তালেবানদের নেতা! তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন বলি? মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবেÑ ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এই দুটো বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায়, তা আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন না। বিগত নির্বাচনে নাসিম সাহেব অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। এখন আবার লাইমলাইটে আসতে চান। আবারও মন্ত্রী হতে চান! প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যই এসব কথা বলা। কী যোগ্যতা আছে বনমন্ত্রীর বেগম জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করার? কে তাকে চেনে? কি তার পরিচয়? জাতীয় রাজনীতিতে তার অবদান কতটুকু?
রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপরপক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ এক সময় ছিল, তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কী শেখাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হলো কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে; কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’Ñ এই মানসিকতা পরিবর্তন করাও জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিতে যাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচন! বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও। এর ফলাফলও সবাই জানেন।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক একটি জনমত জরিপ চালিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিএনপিকে ওইসব জরিপে এগিয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য এসব জরিপ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ঈদের পর বড় ধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের ডাক দিয়েছে দলটি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের আহ্বান একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। বেগম জিয়া হঠাৎ করেই সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন চিকিৎসার(!) জন্য। মানুষ এটা নিয়ে নানা কথা বলছে। তিনি কী সিঙ্গাপুর থেকে শেষ মেসেজ (?) নিয়ে এসেছেন। ২৫ অক্টোবরের আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। পাল্টাপাল্টি জনসভাও আহ্বান করা হয়েছে ওইদিন। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে। সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। এখন কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ? একটি জাতীয় দৈনিক মন্তব্য করেছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে পারে(?)। সহযোগী অন্য একটি দৈনিক বলছে, বেগম জিয়া গ্রেফতার হতে পারেন(?)। এ ধরনের সংবাদ টেকসই গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ২৪ অক্টোবরের পরের দিনগুলো নিয়ে তাই আশঙ্কা, উদ্বেগ আর আতঙ্ক রয়েই গেল।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ১৫ অক্টোবর ২০১৩
পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
0 comments:
Post a Comment