রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মোদির বিজয় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে


ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির বিশাল বিজয় তাকে জওয়াহেরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর পর তৃতীয় ভারতীয় নেতায় পরিণত করেছে, যিনি পর পর দুবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো যে ‘গেরুয়া ঝড়’ তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন, সেই ‘ঝড়’কে তিনি এখন ‘মহাঝড়ে’ পরিণত করে ভারতের রাষ্ট্র কাঠামোকে একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিলেন। ভারতের সনাতন রাজনীতির যে চিত্রÑ একটি বহুত্ববাদী সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সেই চিত্রকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়ে মোদি এখন ভারতকে একটি অলিখিত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-তে পরিণত করতে যাচ্ছেন! মোদি-অমিত শাহ জুটির সাফল্য এখানে যে, তারা ভারতের সাধারণ মানুষের ‘মাইন্ড সেট-আপ’কে বদলে দিয়েছেন। রামমন্দির নির্মাণ করা, তথাকথিত নাগরিকপঞ্জির নাম করে আসাম ও পশ্চিমবাংলা থেকে মুসলমানদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা, কিংবা মুসলিম পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (ক) ধারায় (কাশ্মীরকে বিশেষ স্ট্যাটাস দেওয়া) পরিবর্তনের প্রস্তাব, ভারতের সনাতন রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে মিল খায় না। গেরুয়া ঝড় এখন ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে ভারতকে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এখন ধীরে ধীরে পরিণত হতে যাচ্ছে একটি হিন্দুধর্ম নির্ভর রাষ্ট্রে। ট্রাম্পের মতোই এক ধরনের পপুলিজম (ঢ়ড়ঢ়ঁষরংস) এর জন্ম দিয়েছেন মোদি, যেখানে ধর্মকে তিনি ব্যবহার করেছেন।
১৯৮৫ সালে যে মানসিকতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি আরএসএস-এ যোগ দিয়েছিলেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা ও গোদরা দাঙ্গার জন্য (৭৯০ জন মুসলমানকে ট্রেনে পুড়িয়ে মারা, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে) যিনি অভিযুক্ত ছিলেন, সেই মানসিকতা থেকে তিনি আজও বের হয়ে আসতে পারেননি। বরং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে তিনি পাকাপোক্ত করেছেন। সাধারণ মানুষের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সেই বিষবাষ্প। নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদি তার কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে যোগ করেছেন। ধর্ম আর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মিশ্রণে তিনি নতুন এক রাজনীতির সূচনা করেছেন, যা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছে। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য মোদির ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কাছে রাহুল গান্ধীর পারিবারিক ঐতিহ্য ধুলোয় মিশে গেছে। রাহুল গান্ধী কোনো অবস্থাতেই মোদির বিকল্প ছিলেন না। উপরন্তু মোদি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত, অর্থাৎ নির্বাচনের আগে ১ দশমিক ৫ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন এবং ১৮২টি নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। একই সঙ্গে অমিত শাহ ভ্রমণ করেছেন ১ দশমিক ৫৮ লাখ কিলোমিটার, আর ভাষণ দিয়েছেন ১৬১টি নির্বাচনী জনসভায়। মোদি-অমিত শাহ জুটির কাছে রাহুল-প্রিয়াংকা জুটি ছিলেন অনুকূল। রাহুল-প্রিয়াংকার বাইরে অন্য কোনো সিনিয়র কংগ্রেস নেতাকেও এভাবে গ্রামে গ্রামে যেতে দেখা যায়নি। এমনকি, আমেথিতে রাহুল গান্ধীর পরাজয় পারিবারিক রাজনীতির প্রত্যাখ্যান কি না, তা এই মুহূর্তে হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু এটা রাহুল গান্ধীর জন্য যে একটা ‘শিক্ষা’, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কংগ্রেসের হাল ধরার জন্য একজন বিকল্প নেতা যে প্রয়োজন এই প্রশ্নটি আবারও সামনে চলে এলো।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান মমতা ব্যানার্জির জন্যও একটি ‘শিক্ষা’। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার পরবর্তী নির্বাচন। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল (তৃণমূল ২২, বিজেপি ১৮, কংগ্রেস ২) মমতা ব্যানার্জিকে যে বড় দুশ্চিন্তায় ফেলে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এটা বলতেই হয় যে নির্বাচনী প্রচারণায় মমতা ব্যানার্জির আচরণ সংগত ছিল না। তিনি যে ভাষায় দিনের পর দিন মোদিকে আক্রমণ করেছেন, যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা শোভন ছিল না। প্রত্যুত্তরে মোদির আচরণ ছিল ভদ্রোচিত, তিনি কোনো অভদ্র আচরণ করেননি। অশোভন বক্তব্যও দেননি। সাধারণ মানুষ এটা গ্রহণ করেছে বলে আমার ধারণা। এক্ষেত্রে বামদের ভোটও এবার বিজেপি পেয়েছে। বামরা তৃণমূলে কংগ্রেসের পরিবর্তে বিজেপিকেই বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে। মমতা ব্যানার্জির এটা একটা ব্যর্থতা তিনি বিজেপিকে ঠেকাতে বামদের সঙ্গে কোনো সখ্য গড়ে তুলতে পারেননি। প্রচ- অহংকারী মমতা তৃণমূল কংগ্রেসে দ্বিতীয় কোনো নেতৃত্বও তৈরি করেননি। তৃণমূলের স্ট্র্যাটেজিতেও ভুল ছিল। পুরুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তৃণমূল নেতাদের ‘কাটমানি’ নেওয়া, তফসিলি জাতি-উপজাতি ও মতুয়াদের ভোট না পাওয়া, দলীয় কোন্দল পরাজয়ের অন্যতম কারণ হলেও, লোকসভা ভোটের ফলাফল প্রমাণ করল বিজেপি এখন আর পশ্চিমবঙ্গের কোনো প্রান্তিক শক্তি নয়, বরং শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জার হিসেবে বিজেপি প্রবলভাবে উঠে এসেছে।
অন্যদিকে, লোকসভা নির্বাচন প্রমাণ করল ভারতে বাম রাজনীতি একরকম পরিত্যক্ত। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় বরং কেরালাতেও বাম রাজনীতির আবেদন তেমন একটা আর নেই। অর্থাৎ একসময় যে বামফ্রন্টকে ভারতে বিকল্প শক্তি হিসেবে চিন্তা করা হতো, সেই বাম রাজনীতির সমর্থকরা এখন গেরুয়া শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে! পশ্চিমবঙ্গে যেখানে বিজেপির ভোট বেড়েছে এবং ভোটপ্রাপ্তির হার দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ২৩ ভাগে, সেখানে বামদের ভোট নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৫২ ভাগে। এর আগের লোকসভা ভোটে বামফ্রন্ট যখন ২৫ ভাগ ভোট পেয়েছিল তখন  বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ১০ দশমিক ১৬ ভাগ। অনেকেই মনে করছেন বামদের যে ১৫ ভাগ ভোট ক্ষয় হয়েছে তার সবটাই ঘরে তুলেছে বিজেপি (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ মে)। পাঠকদের আরও কিছু তথ্য দেই। ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে বামফ্রন্ট সর্বোচ্চ আসন পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে, ১৯৮০ সালে ৩১টি আসনে জিতে । ২০০৪ সালেও ছিল ২৯ আসন। এরপরই তা কমতে থাকে। ২০১৪ সালে ছিল মাত্র ২টি আসন, আর ২০১৯ সালে একটি আসনেও পেল না বামরা। উগ্র দক্ষিণপন্থি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে বাম রাজনীতির এই পরাজয় নিশ্চয় বাম নেতাদের জন্য চিন্তার খোরাক জোগাবে যে, কেন তারা পরাজিত হলেন। মমতাকে ঠেকানোর জন্য বিজেপিকে ভোট দেওয়া বামদের এই স্ট্র্যাটেজি সঠিক কি না, এই হিসাব এখন তাদের কষতে হবে।
ভারতে আঞ্চলিক দলগুলোর আবেদনও কমে গেছে। লোকসভার পাশাপাশি ৪টি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু দেশজ পার্টি (চন্দ্রবাবু নাইডু) ক্ষমতা হারিয়েছে। ওয়াইএসআর কংগ্রেস সেখানে ১৫০টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। অরুণাচলে ৩২ আসন পেয়ে বিজেপি এখন সেখানে সরকার গঠন করবে। সিকিমে বিজেপি মিত্র এসকেএসএম পার্টি (১৭ আসন) সেখানে সরকার গঠন করবে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ওড়িশাতে। সেখানে বিজু জনতা দল এখনো ক্ষমতা ধরে রেখেছে। আসন পেয়েছে ১১৩টি। বিজেপির আসন এখানে ২২, আর কংগ্রেসের ৯।
মোদি বিজয়ী হয়েছেন বটে। কিন্তু তার সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ।  প্রথমত, গত বছর ভারতে বেকারত্বের হার ৬ দমমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। তা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি এপ্রিল মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন বেকারত্ব সামাল দিতে হলে প্রতি মাসে ১২ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান করতে হবে। মোদির জন্য এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে শ্লথগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে তা সাড়ে ৬ শতাংশের নিচে। ঋণের পরিমাণ কয়েক বছরে বহুগুণ বেড়েছে। যার ফলে চাপের মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। আর এই ব্যাংকগুলোর ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে অন্য প্রকল্পে টাকা আটকে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন কৃষি থেকে আয় এক চতুর্থাংশ কমছে। এটাও মোদির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মোদিকে অভিবাদন বাণী পাঠালেও দুই দেশের সম্পর্ক এখন তলানিতে। পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গিরা ভারতের মাটিতে হামলা চালাচ্ছে। ২০১৬ সালে উরিতে, ২০০১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনে হামলা, ২০০৮ সালে মুম্বাই হোটেলে হামলার প্রতিটিতেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে বলে ভারত অভিযোগ করে আসছে এবং সর্বশেষ বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলা দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। পাকিস্তানে সার্ক সম্মেলন আয়োজনে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ফলে মোদির জন্য এটাও একটা চ্যালেঞ্জÑ তিনি কীভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন। চতুর্থত, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মোদির আরেকটি এজেন্ডা। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা ভারতের পছন্দ নয়। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনছে। এটা ভারতের চিন্তার কারণ। মোদির আমলে পুরনো ‘কটনরুট’কে পুনরুজ্জীবিত করতে চায় ভারত। এটা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর বিকল্প। ভারত-চীন সম্পর্কটা তাই আলোচনায় থাকবে। পঞ্চমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ আরও জোরদার হয়েছে। ভারতের জোটনিরপেক্ষতা এখন প্রশ্নের মুখে। মার্কিনি চাপে ভারত ইরান থেকে সস্তায় জ্বালানি তেল আনতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগামী ৫ বছর কোন পর্যায়ে যায়, সেটাও মোদির অন্যতম একটি এজেন্ডা।
বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বেশ কিছু সামস্যা রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে এসব সমস্যার সমাধানে মোদি আন্তরিক হবেন। কট্টর হিন্দুত্ববাদ মোদিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তিনি যদি একটি বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এবং তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ^নেতায় পরিণত হবেন।
Desh Rupantor
26.05.2019

0 comments:

Post a Comment