রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মোদির বিজয় বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে কতটুকু প্রভাব ফেলবে



ভারতে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তথা এনডিএ জোটের ‘বিশাল’ বিজয় যে প্রশ্নটিকে এখন সামনে নিয়ে এসেছে। তা হচ্ছে এতে করে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। আগামী ২৯ মে মোদি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকলই তার দ্বিতীয় টার্মে তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা মোদির পররাষ্ট্র নীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’। অর্থাৎ তার বৈদেশিক নীতিতে তিনি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন প্রথম। তার প্রথম টার্মে ‘সার্ক যাত্রা’র অংশ হিসেবে বাংলাদেশসহ প্রতিটি সার্কভুক্ত দেশ প্রথমেই স্বাক্ষর করেছিল। তবে এটাও সত্য সন্ত্রাসবাদী কর্মকাÐকে মদদ দেওয়ার অভিযোগে ইসলামাবাদে সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ভারত সম্মেলনে (২০১৬) যোগ দিতে আপত্তি করলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশও যোগ দিতে আপত্তি জানায়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘জোন অব রিভিলেইজ ইন্টারেস্ট’ নামে একটি তত্ত¡ রয়েছে। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী প্রিমাকভ এই তত্তে¡র প্রবক্তা। এই তত্তে¡ একটি বড় দেশের পাশে একটি ছোট দেশ যদি থাকে, তাহলে ওই ছোট দেশটির ওপর (এ ক্ষেত্রে বেলারুশের ওপর রাশিয়ার) বড় দেশের এক ধরনের প্রভাব স্বীকৃত। বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন যেখানে অগ্রাধিকার বেশি সেখানে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে ভারতের সহযোগিতা আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে প্রথমে। তাই সঙ্গত কারণে মোদির দ্বিতীয়বার শপথ গ্রহণের পরপরই আমাদের দৃষ্টি থাকবে ভারতের নীতি নির্ধারকদের দিকে।
নয়া ভারত সরকার কোন দৃষ্টিতে এখন বাংলাদেশকে দেখে, এটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। অতীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন বাংলাদেশ-ভারতকে দিয়েছে বেশি। কিন্তু প্রাপ্তির খাতাটা পরিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ আমাদের অনেক দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান হয়নি। কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে তার মুখ থেকে কিছুটা অসন্তুষ্টি বের হয়েছিল। এটা সত্য, মোদির প্রথম শাসনামলে স্থল সীমান্ত চুক্তিটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছিল। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে যার আদৌ কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আসামের তথাকথিত নাগরিকত্ব তালিকা (এনআরসি), যে তালিকায় আসামে বসবাসকারী কিছু মুসলমানকে (৪০ লাখ) বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে এদের বাংলাদেশে জোর করে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মোদি নিজে পশ্চিমবঙ্গের এনআরসি করতে চান। বাংলাদেশ-ভারত উষ্ণ সম্পর্কের থেকে এই প্রক্রিয়া বড় ধরনের অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব লক্ষ করা যায়। যখন অমিত শাহ বলেন, তারা পশ্চিমবঙ্গেও এই তালিকা করবেন। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তারা থাকতে দেবেন। আসামে তারা এই তালিকা করলেও পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে তারা এই তালিকা করতে পারেনি। মমতা প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গে এই তালিকা করতে দেবেন না। অনেকেই জানেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফলাফল করেছে। ত্রিপুরাসহ বেশ কয়টি রাজ্যে বিজেপি সরকারও গঠন করেছে। এখন তাদের টার্গেট ২০২১ সালে পশ্চিম বাংলা। মমতাকে হটিয়ে তারা সেখানে সরকার গঠন করতে চায়। সুতরাং তারা যে নাগরিকত্ব তালিকাকে ইস্যু করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া। যতদূর জানা যায় মমতার আপত্তির কারণেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি করতে পারেনি। তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি ইস্যু। মমতা তখন প্রকাশ্যেই বলছেন পশ্চিম বাংলার উত্তরবঙ্গের মানুষদের পানি না দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে পানি দিতে পারবেন না। আথচ তার নিয়োগকৃত কল্যাণ রুদ্র কমিশনের অভিমত হচ্ছেÑ উত্তরবঙ্গকে পর্যাপ্ত পানি দিয়েও বাংলাদেশের প্রাপ্ত পানি দেওয়া সম্ভব। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। আন্তর্জাতিক নদীর পানির ব্যবহার সংক্রান্ত যেমন আইন রয়েছে (১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালা, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালা, ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের জলপ্রবাহ কনভেনশন, কিংবা জীববৈচিত্র্য কনভেনশন) প্রতিটি আইনে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। এখন মমতা ব্যার্নাজি যদি উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেন। সেটা হবে আন্তর্জাতিক পানি সংক্রান্ত আইনের বরখেলাপ। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে। ফারাক্কা চুক্তি নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। ১৯৯৬ সালে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশের পাবার কথা বাংলাদেশ তাও পাচ্ছে না বলে অভিযোগে উঠেছে।
১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ ১৯৭৭ থেকে ৫০ বছর পর। এই ৫০ বছরে জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। মোটামুটি হিসাবে পানির প্রয়োজনও বাড়বে তিনগুণ। কিন্তু ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে যে পানি পেয়েছি, ২০২৭ সাল পর্যন্ত পেতে থাকব আরও কম। সুতরাং বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করে এখন থেকেই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। গঙ্গার এই পানি সংকট মোকাবিলায় ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে ১১টি রাজ্যে গঙ্গার অববাহিকা বিস্তৃত সেখানে গঙ্গা বা উপনদীর ওপর জলাধার নির্মাণ ও সেচের প্রয়োজনে নদী থেকে পানি টেনে নেওয়া এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে নদীর কোনো অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে না যায়। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, ভ‚-গর্ভের পানি স্তর থেকে নদীর দিকে অক্ষুণœ রাখার জন্য নদীপাড় থেকে ৫০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত গভীর ও অগভীর নলক‚পের সাহায্যে সেচের পানি তোলা নিষিদ্ধ করা দরকার। সেই সঙ্গে গঙ্গা চুক্তির পুনঃমূল্যায়নের কথাও বলেছেন তিনি।
বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায়। বাংলাদেশ-ভারতে রফতানি করে কম, আমদানি করে বেশি বাংলাদেশ-ভারতের অন্যতম বাজারে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্য রেশিও ১ঃ৭.৯। অর্থাৎ ৭.৯ ভাগ বেশি আমদানি করে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ভারসাম্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে ভারতের সরকারি নীতি। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও কিছু অশুল্ক বাধার কারণে দু’দেশের কাক্সিক্ষত বাণিজ্য বাড়ছে না। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে বন্দর, পণ্য পরীক্ষা ও বকেয়াসহ প্রতিবন্ধকতার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট এবং চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার নিয়েও কথা আছে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আয় মিলিয়ে বন্দরভিত্তিক কার্যক্রমে বার্ষিক মোট ৩৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরিত হচ্ছে। এখন চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে প্রবাহের শতকরা ১০ ভাগও যদি ভারতের ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যসামগ্রী পরিবহন করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে বছরে প্রায় ৩-৪ হাজার কোটি টাকা (ফি বাবদ) ট্যারিফ চার্জ, মাশুল বাবদ নিশ্চিত আয় হবার কথা। এটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। নরেন্দ্র মোদির বৈদেশিক নীতির একটি অন্যতম দিক ছিল তার নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি। অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিকে তিনি তার অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির আলোকেই রচিত হয়েছে। তার শাসনামলে বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি রচিত হয়েছে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের পানি সংকট ও জ্বালানি সংকট সমাধানে বড় ভ‚মিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে। একই সঙ্গে নেপাল ও ভুটানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোটানো সম্ভব। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটেরও সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ভারতকে আরও উদার হতে হবে। ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হলে তা ভারতের ওপর দিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারত না চাইলে আমরা তা পাব না। আশার কথা মোদি সরকার এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন। মোদি সরকার একদিকে বিবিআইএন উপ-অঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাতবোন রাজ্যের সম্পর্ককে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পাশে রেখে, অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে বিমসটেক জোটকে (বাংলাদেশ ভারত মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, নেপাল ও ভুটান) শক্তিশালী করতে চায় ভারত। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) মহাপরিকল্পনায় যোগ দিয়েছে। ভারত
যোগ দেয়নি। এতে করে ভারতের নীতি নির্ধারকরা বিষয়টিকে যে ভালো চোখে দেখবেন তা মনে হয় না।
নরেন্দ্র মোদির বিজয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের অনেকে মনে করেন, মোদির দ্বিতীয় টার্মে দ্বিপক্ষীয় সমস্যার অনেক সমাধান হবে। তবে নির্বাচনের আগে বিজেপি তার ইশতেহারে যেমন প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল, তা যদি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। বিশেষ করে মোদি সরকার যদি এনআরসি পশ্চিম বাংলায় শুরু করে, যদি বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির তৈরি করে, যদি মুসলিম পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনতে চায় তাহলে মুসলিম উগ্রপন্থিরা ভারত ও বাংলাদেশে এটাকে পুঁজি করতে পারে। বাংলাদেশে তারা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। ইতোমধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এই অঞ্চলে তাদের জঙ্গি তৎপরতা বাড়াতে চায়। তারা এসব মুসলমানবিরোধী কর্মকাÐকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে পারে। মোদি সরকার বিষয়টি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে। মোদির এই বিজয় একটা শঙ্কা যে তৈরি করল, তা অস্বীকার করা যাবে না।
Daily Somoer Alo
27.05.2019

0 comments:

Post a Comment