রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপিতে কি খালেদা যুগের অবসান হতে যাচ্ছে

https://en.prothomalo.com/contents/cache/images/600x315x1/uploads/media/2018/09/09/e2759657bf4f5134effb4b3b40ec6e71-c4f6d34e5b5fbac7b7e8000353b401a7-5a8d0890af378.jpg?jadewits_media_id=172106


অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বিএনপির ৫ জন সংসদ সদস্যের সংসদ অধিবেশনে যোগদান, কৌশলগত কারণে ফখরুল সাহেবের সংসদে যোগ না দেওয়া ও বগুড়া-৬ আসন শূন্য ঘোষণা এবং বেগম জিয়ার হয় জামিন নতুবা প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা চলমান রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। বিএনপির সাংসদদের সংসদ অধিবেশনে যোগদান খোদ ২০ দলীয় জোটে নানা মাত্রার বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তও সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু এটা ছাড়া বিএনপির কোনো গত্যন্তর ছিল না। এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বেগম জিয়ার মুক্তি। তিনি প্যারোলে মুক্তি পাবেন, নাকি জামিনে, তা স্পষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বেগম জিয়া যদি প্যারোলে মুক্তি পেতে চান, তাহলে তাকে আবেদন করতে হবে। কিন্তু তিনি কি তা করবেন? জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়ার শাস্তি হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মীয় উসকানি ও মানহানির দুটি মামলা চলমান। আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্তি পাবেন, সে সম্ভাবনা কম। বেগম জিয়া অসুস্থ। অন্যের সাহায্য নিয়েই তাকে চলাফেরা করতে হয়। তিনি এখন বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য যদি তিনি বিদেশে যেতে চান, তাহলে আইনের বিধান মতে তাকে আবেদন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেদন করলেই তিনি প্যারোলে মুক্তি পাবেন, তেমনটি নয়। এর সঙ্গেও একটি ‘রাজনীতি’ আছে। অর্থাৎ তার ‘মুক্তির’ বিষয়টির সঙ্গে ‘রাজনীতির’ বিষয়টি জড়িত। তাহলে সেই ‘রাজনীতি’টি কী? বাজারে গুজব রয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ৬ জন নির্বাচিত হয়েছেন, তারা যদি সংসদে যোগ দেন তাহলে বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করবে সরকার। তারা এরই মধ্যে যোগ দিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে তাই নানা প্রশ্ন জনমানসে। যদিও বিএনপির নেতৃবৃন্দ মনে করছেন প্যারোলে নয়, জামিন তার প্রাপ্য। গত ৭ এপ্রিল বিএনপির নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণঅনশন করেছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও গণঅনশনে অংশ নিয়েছেন। গণঅনশনে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেছেনÑ বেগম জিয়াকে তারা ‘আন্দোলনের’ মাধ্যমে মুক্ত করে ছাড়বেন!
অনেকগুলো প্রশ্ন এখন আছে। বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন কি-না, তা নির্ভর করছে, একান্তভাবেই তার ওপর। জিয়া পরিবার প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে, এমন কথাও চাউর হয়েছে। বেগম জিয়ার বয়স হয়েছে। স্বাস্থ্য আর আগের মতো নেই। ছোট ছেলের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও পরিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনীতি, বিশেষ করে বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতা, বেগম জিয়াকে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এটা বোধ করি বেগম জিয়া নিজেও উপলব্ধি করেন যে, আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি হয়তো আর জামিন পাবেন না! এ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া তার জন্য মঙ্গল এই উপলব্ধি বোধ তার মাঝে আসতে পারে। তিনি বিদেশে বসে দলের নেতৃত্ব দেওয়া ও আন্দোলন সংগঠিত করা এটাও তিনি চিন্তা করতে পারেন। আগে সুস্থতা নিশ্চিত করা, পরে রাজনীতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বেগম জিয়ার নেতৃত্ব আর আজকের বেগম জিয়া এর সঙ্গে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তখন বয়স কম ছিল। দুটি বড় দলÑ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যৌথ আন্দোলন করেছিল। আর আজ বেগম জিয়া একা, সঙ্গে কোনো বড় দল নেই, উপরন্তু মাঝখানে চলে গেছে ২৯ বছর। বয়স বেড়েছে। হতাশা বেড়েছে। ব্যক্তি জীবনে বিপর্যয় এসেছে বারে বারে। এটা ঠিক, বেগম জিয়া এখনো অবিসংবাদিত নেত্রী। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প বেগম জিয়াই। কামাল হোসেন নন।

বিএনপির একটি অংশ এবং ঐক্যফ্রন্টও চাইবে বেগম জিয়া জেলে থাকুন! তাতে করে আন্দোলন করা সহজ। বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তিতে আন্দোলনে আর কোনো ‘ইস্যু’ থাকে না! তাই তো গণঅনশনে আমরা ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বক্তব্য দেখেছিÑ তারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে চান! এটা যে শুধুমাত্র একটি ‘সেøাগান’ তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। বেগম জিয়া এক বছরের ওপরে জেলে আছেন। বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। কর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও, বিএনপির নেতৃবৃন্দকে আন্দোলনে দেখা যায় না। তারা বয়োবৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আন্দোলনে তারা ব্যর্থ। তাই আন্দোলন নয় বরং আইনি প্রক্রিয়াতেই বেগম জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। তাতেও তারা সফল হয়নি। এই যখন পরিস্থিতি তখন বিএনপির নির্বাচিত ৫ জন সংসদ সদস্য সংসদে যোগ দিয়েছেন। এর আগে সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান এরই মধ্যে সংসদে যোগ দিয়েছেন। এখন বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের অনুসরণ করলেন।

তারেক রহমান এককভাবে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপির সাবেক নেতা ও এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ অত্যন্ত কড়া ভাষায় এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ছাড়া বিএনপির কাছে কোনো বিকল্প ছিল না। প্রায় বার বছর বিএনপি ক্ষমতার বইরে। দশম জাতীয় সংসদ (২০১৪-২০১৫) নির্বাচন বিএনপি বয়কট করায় সংসদীয় রাজনীতি থেকে বিএনপি ছিটকে পড়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি অংশ নিলেও আসন পেয়েছে মাত্র ৬টি। কিন্তু দলের চেয়ারপারসন বেগম জিয়া একদিকে জেলে, অন্যদিকে কর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা। সংসদে কথা বলার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিএনপি যদি সংসদে কথা বলার সুযোগটি বেছে নেয়, আমি তাতে অবাক হব না। কেননা সংসদীয় রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা একটিইÑ আর তা হচ্ছে সংসদ! বিএনপি রাজপথে ‘আন্দোলন’ করে সরকারকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করতে পারেনি। তাই তাদের সংসদ অধিবেশনে যোগদানকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। তবে প্রশ্ন যে নেই, তা নয়। প্রশ্ন আছে। এবং ২০ দলের শরিকরা সে প্রশ্নটিই তুলেছেন। অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত দল যখন ‘ধরে’ রাখতে পারে না, তখন দল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে একটা ভিন্ন ‘মেসেজ’ পৌঁছে যায়। যেমন বলা যেতে পারেÑ গণফোরামের কথা। গণফোরামের দুজন সংসদ সদস্য, যারা আগেই সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন, দল তখন তাদের বহিষ্কার করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে মোকাব্বির খানকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করে  ড. কামাল হোসেন তাকে তার অফিসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়নি। এমনকি ড. কামাল হোসেন পরে ‘বহিষ্কৃত’ মোকাব্বির খানকে পাশে বসিয়ে গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল পর্যন্ত করলেন। এর মধ্য দিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা থাকল কি? একটা দলের জন্য শৃঙ্খলা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বিএনপি ও গণফোরামের ক্ষেত্রে সেই দলীয় শৃঙ্খলা থাকল না। উপরন্তু সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা আছে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো ব্যক্তি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না! এখন ৭ জন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেন এবং দল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নিতে পারল না! দল এখানে ‘মুখ্য’ হলো না, মুখ্য হয়ে গেল ‘ব্যক্তি’। যদিও বলা হয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের নির্দেশেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। তাহলে প্রশ্নটি আসেÑ তারেক রহমান একাই কি দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ? দলের স্থায়ী পরিষদের কি কোনো ভূমিকা নেই? এসব প্রশ্ন বারবার আলোচিত হতে থাকবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে এদের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সংসদীয় রাজনীতিতে সংসদ বয়কট কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সংসদীয় রাজনীতির জন্য একটা কোনো ভালো খবরও নয়। অতীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগও সংসদ বয়কটের রাজনীতি করেছিল। ওই সংসদ বয়কটের রাজনীতি আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু নির্বাচন বয়কটের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। সাধারণ মানুষ এটা সমর্থনও করেনি। ওই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও শেষ দিন পর্যন্ত সংসদ টিকে ছিল। আমরা ভারতে কংগ্রেসের উদাহরণ দিতে পারি। যে কংগ্রেস ছিল ভারতের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত ‘শক্তি’, ১৬তম লোকসভা নির্বাচনে (২০১৪) দলটির কী হাল হয়েছিল, আমরা নিশ্চয়ই তা স্মরণ করতে পারি। ৫৪৩টি আসনের মাঝে দলটি পেয়েছিল মাত্র ৪৪টি আসন। যে দলটি (কংগ্রেস) প্রথম লোকসভায় (১৯৫২) পেয়েছিল ৩৬৪টি আসন, দ্বিতীয় লোকসভায় ৩৭১ আসন, ১৯৭১ সালে ৩৫২ আসন, ১৯৮০ সালে ৩৫৩ আসন, ১৯৮৪ সালে ৪১৫ আসন, সেই দলটিও ৪৪ আসন পেয়েছিল। ফলে দলের বিপর্যয় হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে সংসদ বর্জন সংসদীয় রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না। নিশ্চয়ই বিএনপি এটা থেকে শিখবে ও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য আমরা ভোটের সংস্কৃতিকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছি (রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা, প্রকাশ্যে ভোটকেন্দ্র দখল ও সিল মারা, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা) এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। গণতন্ত্রের স্বার্থেই তা মঙ্গলজনক
ঐক্যফ্রন্টের ৭ জন সংসদ সদস্যের সংসদে যোগদান বর্তমান সংসদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দিল। সংসদ এখন পরিপূর্ণ। সকল দলের অংশগ্রহণ যেভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, এখন সবার সংসদে যোগদান সংসদকে আরও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করল। সংসদকেন্দ্রিক রাজনীতি এতে করে আরও শক্তিশালী হলো। তবে বিএনপি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই সংসদের মেয়াদ। তখন বেগম জিয়ার বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৮০’র কাছাকাছি। এর অর্থ প্রথাগত রাজনীতি থেকে তার আপাতত বিদায়! এখন বগুড়া-৬ আসন থেকে জিয়া পরিবারের পরের প্রজন্ম নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসেন কি না, কিংবা দলে বেগম জিয়ার ‘শূন্যস্থান’ পূরণ করেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Desh Rupantor
06.05.2019

0 comments:

Post a Comment