রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে মার্কিন সমাজ

বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। জিডিপির পরিমাণ হচ্ছে ১৫ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন এক হাজার মিলিয়নের সমান)। কিন্তু এখানেও দারিদ্র্য আছে। আছে বেকারত্ব। অবাক করার একটি বিষয়, গত ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র Meclatchy-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজনের মধ্যে একজন নাগরিক 'ফুড স্টাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতিবছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই ফুড স্টাম্পের পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে সেখানে এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির ৭ শতাংশ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে এই হার ১৩ শতাংশ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় আট হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ গুণ বেশি। একমাত্র ইরাকে চার থেকে ৯ লাখ মানুষ মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র Global war on terror শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র তিন-তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও এই তিনটি দেশে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্থিতিশীলতাও ফিরে আসেনি। এখন সিরিয়ায় চতুর্থ আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা আপাতত স্তিমিত হলেও ভবিষ্যতে আদৌ 'যুদ্ধ' হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক নাগরিকরাই দারিদ্র্যের শিকার। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও শান্তিবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং একসময় যুক্তরাষ্ট্রের গরিব মানুষ, বিশেষ করে আফ্রো-আমেরিকানদের জন্য লড়েছিলেন। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। লুথার কিংয়ের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে অসমতা ও দারিদ্র্য কমেনি। আফ্রো-আমেরিকানরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। নিউ ইয়র্কের হেরলেম আর ব্রোঞ্জ উপশহরে গেলে দেখা যায় আফ্রো-আমেরিকানরা কী অমানবিক জীবন যাপন করছেন।
মার্টিন লুথার কিং জীবদ্দশায় বৈষম্য কমিয়ে আনার সংগ্রাম করে জীবন দিলেও মার্কিন সমাজে বৈষম্য আদৌ কমেনি। ১৯৬৩ সালের আগস্টের বিখ্যাত March on Washington-এর পর ৫০ বছর পার হয়েছে (২৬ আগস্ট), কিছু বৈষম্য পুরোপুরি দূর হয়েছে- এটা বলা যাবে না। তবে নিঃসন্দেহে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। ১৯৬০ সালে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরা যেখানে ছিল ১১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ১৭ দশমিক ০৫ মিলিয়ন। এখন ২৫১ মিলিয়ন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ৪৫ মিলিয়ন। তারা সবচেয়ে বড় এথনিক গ্রুপ নয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে ল্যাতিনো অথবা হিসপানিক, ৫৪ মিলিয়ন। শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১৯৬৭ সালে স্কুল ত্যাগকারী কৃষ্ণাঙ্গদের হার যেখানে ছিল ২৯ শতাংশ, ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৭ শতাংশে। অথচ একই সময় শ্বেতাঙ্গদের স্কুল ত্যাগের হার ছিল ১৫ শতাংশ (১৯৬৭)। আর এখন ৫ শতাংশ। ১৯৬০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণকারীর হার ছিল ৪ শতাংশ (শ্বেতাঙ্গ ৮ শতাংশ), ২০১২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের হার বেড়েছে ২১ শতাংশে, আর শ্বেতাঙ্গদের এ হার ৩৫ শতাংশ। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতার হার বেশি। পরিসংখ্যান বলে, কারাগারে অবস্থানকারী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর হার ৩৭ শতাংশ, এর মধ্যে ৪২ শতাংশ আবার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। কিশোর অপরাধীর হার (কৃষ্ণাঙ্গ) ৩২ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কিছুটা কমেছে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪১ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে এই হার ২১ শতাংশ। অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে মেইনে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বেকারের হার বেশি, ২১ শতাংশ, আর দারিদ্র্যের হারও বেশি, ৪৬ শতাংশ। মিসিসিপি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্রতম রাষ্ট্র। আর এখানে ৫৭ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। নিউ ইয়র্কে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ সংখ্যা ২০৪০৩২ জন। আয়ের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় যেখানে বছরে ২১ হাজার ডলার, সেখানে শ্বেতাঙ্গদের আয় ২৭ হাজার ডলার। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যেখানে ৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ বেকার, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এই হার ১৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান শুধু পুরুষদের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩ শতাংশ। আর ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ বেকারত্বের হার মাত্র ৯ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মাত্র ৭ শতাংশ ব্যবসা রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে (২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী)। যদিও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা তিন গুণ বেশি। তবে নিজস্ব বাড়ি নেই অনেক কৃষ্ণাঙ্গ-আমেরিকানের। এক অমানবিক জীবনযাপন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের। নিউ ইয়র্ক শহরে যত বেশি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হোমলেস (যার বাড়ি নেই) কিংবা বাধ্য হয়ে সাবওয়েতে ভিক্ষাবৃত্তি(!) করে, অন্য কোনো শহরে আমি তা দেখিনি। গত তিন মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে ঘুরেছি। নিউ ইয়র্ক, অস্টিন, ডালাস, ওয়াশিংটন- আমার কাছে দরিদ্র বেশি চোখে পড়েছে নিউ ইয়র্কে। এই অসমতার বিরুদ্ধে এই নিউ ইয়র্ক শহরেই জন্ম হয়েছিল 'অকুপাই মুভমেন্ট'-এর। সেটা ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের কথা। ম্যানহাটনের জুকোট্টি পার্ক দখল করে নিয়েছিল তরুণরা। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমি সেই জুকোট্টি পার্কে গিয়েছি। পার্কটি তেমনি আছে। কোনো পরিবর্তন আসেনি। যারা হাউজিং ব্যবসায় ধস নামিয়েছিল, যাদের জন্য শত শত স্থানীয় ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্রিমিনালদেরই উৎসাহিত করা হলো। আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতির দেশে রাষ্ট্র গরিব মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াবে না- এটা সত্যিই দুঃখজনক। নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ৯ নভেম্বর ২০১৩

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment