রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিরিয়ার অর্থনীতি কি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে?

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে প্রায় ২৯ মাস ধরে। বাসারবিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা তথা প্রবাসী সরকার গঠন, বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন ও তাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ং। এটা কোনো রাখ-ঢাকের বিষয় ছিল না। কিন্তু এ যুদ্ধ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে সিরিয়া ছিল খাদ্যে ও উত্পাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ, সেই দেশ এখন খাদ্য ও পণ্য আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বেকার সমস্যা যেখানে যুদ্ধের আগে তেমন একটা ছিল না, এখন তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেখানে যুদ্ধের আগে তেল উত্পাদন হতো দৈনিক ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল, এখন হয় মাত্র ২০ হাজার ব্যারেল। শুধু তেল উত্পাদনে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলার। সিরিয়ার মুদ্রার (পাউন্ড) ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আগে ডলারে পাওয়া যেত ৪৭ পাউন্ড, এখন ২৫০ পাউন্ডে পাওয়া যায় ১ ডলার। জনসংখ্যার বড় অংশ গরিব হয়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। অথচ যুদ্ধের আগে গরিব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক শতাংশেরও কম ছিল। স্বাস্থ্যসেবা পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশের ৭৫টি হাসপাতালের মধ্যে এখন চলছে মাত্র ৩০টি। একসময় সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্যে ভতুর্কি দিত, যার পরিমাণ ছিল বছরে ৬ বিলিয়ন ইউরো; এখন তা শূন্যের কোটায়। যুদ্ধের আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা এক রকম শূন্য (ইকোনমিস্ট, ১০ এপ্রিল, ২০১৩)। ‘তাই যুদ্ধ’ না হলে, এখানে মার্কিন কনট্রাকটররা আসবেন না, তেল উত্পাদন বাড়ানো যাবে না। ‘আরেকটি ইরাক’ও তৈরি হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি সরকারকে উত্খাত করেছিল। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। ইরাক এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সেখানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। ইরাক অতিরিক্ত তেল উত্পাদন করে ‘বাধ্যতামূলকভাবে’ ‘যুদ্ধ খরচ’ মিটিয়েছিল। একই কথা প্রযোজ্য লিবিয়ার ক্ষেত্রে। লিবিয়ার তেল আর গ্যাসের ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল পশ্চিম ইউরোপ। লিবিয়া এখন ধ্বংসের মুখে। সেখানেও বেড়েছে সন্ত্রাসবাদ। এখন ধারণা করা হচ্ছে, সিরিয়াও সেই পথে যাচ্ছে। সিরিয়ায়ও ‘তেল’ রয়েছে। সে তেলের ব্যাপারেও আগ্রহ রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের। তবে সিরিয়ার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ সরকারের পতন হলে ইরানের ওপর পরোক্ষ চাপ বাড়বে। এতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে ইসরায়েল, দুর্বল হবে ইরান ও লেবানন সরকার। লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলারা সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকবে। ইসরায়েলের ভয় একদিকে যেমনি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প অন্যদিকে তেমনি হিজবুল্লাহর গেরিলারা, যারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডের ওপর দীর্ঘদিন ধরে হামলা চালিয়ে আসছে। তাই সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন সিরিয়ার দিকে। প্রেসিডেন্ট ওবামা হামলার ব্যাপারে কিছুটা পিছিয়ে এসেছেন বটে। কিন্তু রুশ-মার্কিন ফর্মুলা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সিরিয়ায় হামলার ব্যাপারে তিনি পিছপা হবেন না। এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। সুতরাং রুশ-মার্কিন সম্পর্কটাই যে সিরিয়া সংকটের সমাধান বয়ে আনবে, তা মনে করার কারণ নেই। আমি গত ক’দিন মার্কিন টিভিতে রুশ-মার্কিন সমঝোতা নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষকদের বক্তব্য শুনে আসছি। তাতে একটা বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে— আর তা হচ্ছে, এ সমঝোতার ভবিষ্যত্ নিয়ে সবাই সন্দিহান। অনেকেই বলছেন, এ সমঝোতা আদৌ কাজ করবে না। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এক. সমঝোতা অনুযায়ী সিরিয়াকে পরিপূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকরণের কাজ শেষ হবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এত দিন অপেক্ষা করবে কী না? বড় প্রশ্ন হলো, বাশার আল আসাদকে স্বীকার করে নেয়া! যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এটা করবেন কী না? দুই. এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে দেখা যায় ক্ষমতায় একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে রেখে কোনো সমঝোতার জট খোলেনি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ায় গাদ্দাফির ক্ষেত্রে কোনো জট খোলেনি। ফলে চূড়ান্ত বিচারে এদের উত্খাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের। এরা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি আর বাশারকে এক কাতারেই দেখে। কোনো পার্থক্য করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র কি বাশারকে আরো প্রায় এক বছর ক্ষমতায় রাখবে?
তিন. সমঝোতায় সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের হিসাব, অবস্থান, মজুদ, অস্ত্রের ধরন, গবেষণা ইত্যাদির কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। নভেম্বরের মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার কথা। এখন যদি সিরিয়া সরকার জাতিসংঘের সশস্ত্র পরিদর্শকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তখন কী হবে? চার. রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই জানিয়েছেন সিরিয়াকে পুরোপুরিভাবে রাসায়নিক অস্ত্রমুক্ত করার কাজটি অত সহজ নয়। কেননা ধারণা করা হয় সিরিয়ায় মোট ৪০টি রাসায়নিক কারখানা অথবা এলাকা রয়েছে, যেখানে এসব অস্ত্র উত্পাদন করা হয় অথবা তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন গ্যাস (সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) সিরিয়া সংরক্ষণ করেছে। এসব গ্যাস ধ্বংস করা কঠিন। একজন গবেষক লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২৮ বছর ধরেই তাদের কাছে রক্ষিত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এখানে সিরিয়া নিয়ে যে বড় সমস্যা হবে তা হচ্ছে, এসব অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট প্লান্টে বা স্থানে ধ্বংস করতে হবে। সিরিয়ায় তা করা যাবে না। সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো দেশে এগুলো ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ১৩টি প্লান্টের মধ্যে ৯টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউরোপে পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যেকোনো পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলবে। স্থানীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনও পরিবহন ব্যবস্থার বিপক্ষে। সুতরাং একটা সমস্যা থেকেই গেল। এক্ষেত্রে রাশিয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রাশিয়ার সমর্থন এবং রুশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েন ইত্যাদি কারণে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসে আগামীতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। পাঁচ. সিরিয়ায় অস্ত্র পরিদর্শক হিসেবে কারা কারা থাকবেন, সেটা নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি সংস্থা রয়েছে— Organization for the prohibition of chemical weapons (OPCW)। এ সংস্থাটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকানরা। এক্ষেত্রে পরিদর্শক টিমে যদি আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি থাকে, তা সিরিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছয়. এ সমঝোতার ব্যাপারে সিরীয় বিদ্রোহীরা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। বাশার সরকার বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সে দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন বিদ্রোহীরা যদি তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তাতে করে এ পরিদর্শন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। ভেঙে যেতে পারে সমঝোতা। সাত. এ সমঝোতার পেছনে মূল অ্যাক্টর দুই শক্তি— যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। অথচ সিরিয়া সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের কোনো অংশগ্রহণ নেই এখানে। ফলে অনেকটা ‘চাপিয়ে দেয়া’র মতো হয়ে গেল বিষয়টা। আন্তর্জাতিক যেকোনো ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে যদি বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা এ সমঝোতার ওপর প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে American Exceptionalism হিসেবে আখ্যায়িত করে তার অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আলাদা ভাবে। তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য, যারা রক্ষণশীলবাদ, একসময় মার্কসিস্টরা এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে চিহ্নিত করত, এখন পুতিনের বক্তব্যে তা ফিরে এসেছে। এর ব্যাখ্যা একটাই— বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাতুব্বরি’ করা রাশিয়ানরা সহ্য করবে না!
রুশ-মার্কিন সমঝোতার মধ্য দিয়ে ‘কূটনীতি’ জয়যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে, তারা সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই সিরিয়ার ওপর ‘চাপ’ এখন আরো বাড়বে। তাই সিরিয়া নিয়ে শেষ কথাটা বলার সময় এখনো আসেনি।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র
দৈনিক বণিক বার্তা, ২ অক্টোবর ২০১৩।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahman09@gmail.com - See more at: http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2013/10/02/17870#sthash.E6646Ius.VEdtYsmG.dpuf

0 comments:

Post a Comment