রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ফোনে আড়ি পাতা ওয়াশিংটন স্টাইল

অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি কর্তৃক বিশ্বের ৩৫টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে আড়ি পাতার ঘটনায় বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই গোয়েন্দা সংস্থা যাদের ফোনে আড়ি পেতেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফঁসোয়া ওলন্দ, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ডিলমা রউসেফ প্রমুখ। আড়ি পাতার ঘটনাটি ফাঁস করে দেয় লন্ডনের গার্ডিয়ান। এ নিয়ে গত ২৪ অক্টোবর ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলনে কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কেল ও হল্যান্ডে আড়ি পাতার ঘটনায় যথেষ্ট বিব্রত হয়েছেন এবং এর ব্যাখ্যা দাবি করেছেন। ব্রাসেলস সম্মেলনে প্রায় প্রত্যেক ইউরোপীয় সরকারপ্রধান যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কের অবনতির একটি ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইন্টার আমেরিকান কমিশন অব হিউম্যান রাইটস বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বসছে। এটি অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের একটি সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্র এর সদস্য। এ ধরনের আড়ি পাতার ঘটনা আমেরিকান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটসের নীতির পরিপন্থী। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বে যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ১৬ দিনের শাটডাউনের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। দুই সপ্তাহ সরকার বেতন দিতে পারেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরোধের জের ধরে এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। ওবামার সঙ্গে রিপাবলিকানদের আলোচনাও ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যে অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ সাময়িকভাবে পাওয়া গেছে, এটা সত্য; তবে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফেডারেল সরকারের হাতে টাকা ছিল না। অথচ এর চেয়ে বেশি টাকা আছে ৯টি বড় কম্পানির। যেখানে ফেডারেল সরকারের রাজস্ব বিভাগের পরিচালনা ব্যয় ৩২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে কয়েকটি কম্পানির আর্থিক ভিত্তি ফেডারেল সরকারের চেয়ে বেশি। যেমন জেনারেল ইলেকট্রিক ৮৮ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার, মাইক্রোসফট ৭৭ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন, গুগল ৫৪ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন, সিমকো ৫০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন, অ্যাপল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন, ওরাকল ৩৯ দশমিক ১০ বিলিয়ন, ফোর্ড ৩৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায় ফেডারেল সরকারের আর্থিক ভিত্তি কত দুর্বল।

ফেডারেল সরকারের শাটডাউনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে 'ইমেজ' সংকটের মুখে পড়েছিল, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান প্রগ্রেস সাতটি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছে। তারা বলছে, এর ফলে মেইন স্টেটের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার শীতকালে ঘরবাড়ি গরম রাখার যে সরকারি সাহায্য পেত, তা পাবে না। বেকার ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। শিশুদের জন্য আর্থিক সাহায্যও বন্ধ হয়ে যাবে।

মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে এক শ্রেণীর মানুষের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাড়ছিল দেশটির দারিদ্র্য। এই অসমতাই তরুণ সমাজকে ২০১১ সালে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জুকোটি পার্ক বেছে নেওয়ার কারণও একটি- জুকোটি পার্কের পাশেই ওয়াল স্ট্রিট, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ। আর তাই ওই স্টক এক্সচেঞ্জকে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। ওয়াল স্ট্রিটের আশপাশের ভবনে রয়েছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখানে অবস্থিত। মার্কিন সমাজে অসমতা কিভাবে তৈরি হয়েছে, তার একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে দেশের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ শতাংশ অর্থ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করত মোট সম্পদের ২৩.৫ শতাংশ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক ইমানুয়েল সাজের মতে, ১০ শতাংশ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯.৭ শতাংশ গ্রহণ করে। অধ্যাপক ডেভিড গ্রে অন্য এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। তাঁর মতে, শীর্ষে থাকা এক শতাংশ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ শতাংশের মালিক। আর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিগের মতে, শীর্ষে থাকা ওই ১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করত মাত্র ১২ শতাংশ সম্পদ। এই যে অসমতা ও সম্পদ কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া ও সম্পদের সমতা রক্ষা করার জন্যই জন্ম হয়েছিল 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'-এর। সেটা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, একটা প্রতিবাদ। যুগে যুগে তরুণসমাজ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। ষাটের দশকে ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে তরুণসমাজ এভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজেও যে অসমতা ও দারিদ্র্য রয়েছে, তা ছিল অকল্পনীয়। খোদ নিউ ইয়র্ক শহরেও অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই। চাকরি নেই। ফুড স্টাম্পে তাদের দিন চলে। এই নিউ ইয়র্ক শহরে ম্যানহাটন এলাকায় আমি অনেক যুদ্ধাহত আমেরিকানকে দেখেছি ভিক্ষা করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র (ইরাক ও আফগানিস্তানে) যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে একজন যুদ্ধাহত নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রটি। অনেকের কাছেই এই বৈষম্য বিশ্বাস করা কঠিন। তাই হঠাৎ করেই 'অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট'-এর জন্ম হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্বলতার পাশাপাশি এখন যুক্ত হলো আড়ি পাতার বিষয়টি। প্রেসিডেন্ট ওবামা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এই আড়ি পাতার বিষয়টি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তত দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। গেল সেপ্টেম্বরে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট মিস ডিলমা রউসেফের ওয়াশিংটন সফর করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি ওই সফর বাতিল করেছেন। প্রেসিডেন্ট ডিলমা এরই মধ্যে দাবি করেছেন নতুন একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করার, যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। এই আড়ি পাতার ঘটনা যেকোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। এখন আড়ি পাতার ঘটনায় প্রমাণিত হলো, যুক্তরাষ্ট্র এই মিত্রদেরও বিশ্বাস করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র আসলেই নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা একটি প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
কালের কন্ঠ,2013/11/02/
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2013/11/02/17277#sthash.whumI3Vw.dpuf

0 comments:

Post a Comment