বিএনপি তথা ১৮ দলের টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল এবং দুই নেত্রীর মধ্যকার সংলাপের বিষয়বস্তু মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক প্রশ্ন এখন উঁকি-ঝুঁকি মারছে। প্রবাসে এ প্রশ্নগুলো অনেকেই আমাকে করেছেন। প্রশ্ন এক. দুই নেত্রী যেভাবে ফোনালাপে নিজেদের মাঝে বিতর্ক করেছেন এরপর কী তারা আবার একে অপরকে ফোন করবেন? প্রশ্ন দুই, প্রধানমন্ত্রী বিএনপি ও জামায়াতকে বাদ দিয়েই একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনকল্পে ‘সংলাপ’ করছেন। এতে করে কি এমন একটা ধারণার জন্ম হচ্ছে না যে, সরকার এই দুটি দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচনে যাচ্ছে? প্রশ্ন তিন, বিএনপি ও ১৮ দল টানা হরতালের পর টানা বিক্ষোভ ও অবরোধের কথা বলছে। সরকার কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করতে পারবে? প্রশ্ন চার, নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়াদিল্লির গুরুত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজিনা নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে সাউথ সার্কের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানা না গেলেও এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে নয়াদিল্লি একটা ধারণা রাখে। এ ধারণাটা তাহলে কী? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন এখন জনমানসে উত্থাপিত হয়েছে এবং কেউই স্পষ্ট করে এটা বলতে পারছেন না কী হতে যাচ্ছে দেশে। সমস্যার জট খোলার একটি সম্ভাবনার জন্ম হলেও দুই নেত্রীর ফোনালাপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় মানুষ হতাশাগ্রস্ত। আগামীতে দুই মহাসচিব পর্যায়ে কোনো সংলাপ হবে, এটাও আমরা আশা করতে পারছি না। রাজনীতিতে যে সহনশীলতা তা নেই। দুই নেত্রীর ফোনালাপে তা আবার প্রমাণিত হলো। প্রধানমন্ত্রী হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আরো আগে যদি ফোনটা আসত, তাহলে ভালো হতো। আরো একটি বিষয় ফোনালাপের বিষয় ফাঁস হলো কীভাবে? কীভাবে একাত্তর টিভির হাতে এই ক্যাসেট গেল? কারা দিল? এতে করে কি আস্থার একটা জায়গা নষ্ট হয়ে গেল না? আমরা বারবার বলি সমঝোতার কথা। কিন্তু কথোপকথন যদি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে আস্থার সম্পর্কটা থাকে কোথায়? আমরা আরো একটি বিষয়ে উদ্বিগ্ন এবং তা হচ্ছে আগামী নির্বাচনকে নিয়ে কয়েকটি দূতাবাসের তৎপরতা।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই বিষয়ে অনেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। গেল সপ্তাহের পর বাংলাদেশে আগামীতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ‘অতিআগ্রহ’ এবং নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য তার তিন দিনের নয়াদিল্লি সফর এবং ওই সফরে মজিনা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবসহ সাউথ সার্কের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় এসেছে। এমন কথাও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে যে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে ভারত একটি ইঙ্গিত দিয়েছে! মজিনার ভারত সফর কিংবা বাংলাদেশে একটি নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতীয় মনোভাব এলো এমন এক সময়, যখন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের মাঝে বহুল প্রতীক্ষিত ফোনালাপ সম্পন্ন হয়েছে এবং জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে একটি সংলাপের জন্য। এই সংলাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকলেও এ ব্যাপারে জট কতটুকু খুলবে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। ইতোমধ্যে ৬০ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে ১৮ দল। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে আবার ঘণ্টার হরতাল। নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আছে অনেকের। দাতাগোষ্ঠী, এমনকি জাতিসংঘ বারবার বলে আসছে ‘সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। এখন কি দিল্লি-ওয়াশিংটনের ফর্মুলায় (?) বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে! সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে উপস্থিতি কিংবা টানা ৬০ ঘণ্টার স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের পর নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এটাকে এখন আর উপেক্ষা করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের প্রতি দেশের মানুষ তথা বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর আস্থা নেই। এখন সংলাপের মাধ্যমেই এর সমাধান বের করতে হবে। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সাউথ সার্কের এই মনোভাবের স্পিরিট স্পষ্ট নয়। এখন বিকল্প ভাবতে হবে। রাষ্ট্রপতি বিকল্প চিন্তায় আসতে পারেন। তবে তিনি রাজি হবেন এক শর্তে আর তা হচ্ছে বিএনপি তার নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু বিএনপি কী তা করবে? বিকল্প প্রস্তাব স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি রাজনীতিতে অভিজ্ঞ না হলেও একজন শিক্ষিত ও মার্জিত ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু রাজনীতি ভিন্ন বিষয়। উপরন্তু তিনি কি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না? যতদূর শোনা যায়, তিনি তো মহিলা ‘কোটা’ থেকে নয়; বরং সরাসরি দলের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। ইতোমধ্যে তিনি তার নোয়াখালীর নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করেছেন এবং সংবর্ধনাও নিয়েছেন। তাহলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ তো রয়েই গেল! বর্তমান সংকটের গভীরতা এত বেশি যে, স্পিকারের মতো একজন নবীন রাজনীতিবিদ (যিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছেন) এই সংকট মোকাবিলায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবেন, এটা আশা করতে পারছি না। তবে একটি সাহাবুদ্দীন ফর্মুলার বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দল বিবেচনায় নিতে পারে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ প্রধান করা হয়েছিল। তিনি সুষ্ঠুভাবে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলেন এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তিনি আবার হাইকোর্টে ফিরে গিয়েছিলেন ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে এই ফর্মুলার আলোকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বিচারপতি হোসেন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কম। তিনি পর্দার অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানমালাতেও তাকে খুব একটা দেখা যায় না। তবে তার বিরুদ্ধে বড় আপত্তি উঠবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই। প্রধানমন্ত্রী চান না অনির্বাচিত কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে একটাই সংসদে যারাই নির্বাচিত, তারা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা কী কখনো দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারবেন?
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে তাদের তা না পারারই কথা। এখানে দলীয় আনুগত্য, সুবিধাবাদিতা এত বেশি যে, কারো প্রতি আস্থা রাখাটা কঠিন। সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে দু’দুটি সংসদ নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হলেও আওয়ামী লীগ তাদের সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ফলে কোনো প্রধান বিচারপতি কোনো দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবেন না। জাতীয় সংসদে বেশ ক’জন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান রয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই দেশের সংকটকালীন এগিয়ে আসেননি; বরং তারা সবাই দলীয় আনুগত্যের বেড়াজালে আটকা পড়েছেন। জাতি যখন তাদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে, তারা তখন থাকেন নির্লিপ্ত। তারা তাকিয়ে থাকেন নেতা-নেত্রীর দিকে। তাদের ক্ষমতার উৎস ওই নেতানেত্রী। জাতীয় স্বার্থ তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য নয়। তাই সমাধানের জট খোলার সম্ভাবনা কম। কেউ কারো অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে ‘বর্তমান কাঠামোয়’ ১৮ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম। তাই জাতীয় পার্টির দিকে চোখ থাকবে অনেকের। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এরশাদের নয়াদিল্লি সফর করার কথা। তাহলে যে ‘ছক’ রচিত হয়েছে, তাতে কী এরশাদ পা দিতে যাচ্ছেন? তিনি কি শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছেন? ব্যক্তি এরশাদ একাধিকবার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তার এমন কথায় কী আস্থা রাখা যায়? ইতিহাসে এরশাদের রাজনৈতিক ভূমিকা উজ্জ্বল নয়। সামরিক শাসক থেকে তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এসেছেন। উত্তরবঙ্গের তিনি অবিসংবাদিত নেতা। অতীতে তিনি যত অপবাদই মাথায় নিয়ে থাকেন না কেন, বারবার সংসদে নির্বাচিত হয়ে এসে প্রমাণ করেছেন তার এলাকার জনগণ তার ওপর আস্থা রেখেছেন। এখন জীবনের শেষ সময় এসে তিনি দাঁড়িয়েছেন। এটাই বোধকরি তার শেষ সংসদ নির্বাচন। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি নিজেকে আরো একবার বিতর্কিত করেন কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। রাজনীতির কোনো হিসাবই যেন আর মিলছে না। দুই নেত্রীর ফোনালাপ আমাদের হতাশার মাঝে ঠেলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ যেখানে চায় একটু স্বস্তি, চায় একটি সমঝোতা, সেখানে সংসদে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাহলে আস্থাটা থাকে কোথায়? সরকার নির্বাচনে যাবে। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে রেখে একটি সরকারও সম্ভবত গঠিত হতে যাচ্ছে! মূল ধারার রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, এমন কিছু দলকে নিয়ে যদি সরকার গঠিত হয়, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এটি করবে বটে, কিন্তু তাতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। এতে করে হানাহানি আরো বাড়বে। সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাবে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। সমস্যা যা ছিল, তাই থেকে যাবে।
দীর্ঘ ৬০ ঘণ্টার হরতাল আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। এই নভেম্বরে আরো যদি টানা হরতাল ও অবরোধ হয়, তাহলে অর্থনীতি একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই সমঝোতা দরকার। উভয় পক্ষই নমনীয় হবে, আরো বেশি করে আন্তরিক হবে এমন প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় সবার।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই বিষয়ে অনেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। গেল সপ্তাহের পর বাংলাদেশে আগামীতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ‘অতিআগ্রহ’ এবং নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য তার তিন দিনের নয়াদিল্লি সফর এবং ওই সফরে মজিনা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবসহ সাউথ সার্কের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় এসেছে। এমন কথাও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে যে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে ভারত একটি ইঙ্গিত দিয়েছে! মজিনার ভারত সফর কিংবা বাংলাদেশে একটি নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতীয় মনোভাব এলো এমন এক সময়, যখন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের মাঝে বহুল প্রতীক্ষিত ফোনালাপ সম্পন্ন হয়েছে এবং জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে একটি সংলাপের জন্য। এই সংলাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকলেও এ ব্যাপারে জট কতটুকু খুলবে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। ইতোমধ্যে ৬০ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে ১৮ দল। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে আবার ঘণ্টার হরতাল। নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আছে অনেকের। দাতাগোষ্ঠী, এমনকি জাতিসংঘ বারবার বলে আসছে ‘সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। এখন কি দিল্লি-ওয়াশিংটনের ফর্মুলায় (?) বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে! সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে উপস্থিতি কিংবা টানা ৬০ ঘণ্টার স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের পর নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এটাকে এখন আর উপেক্ষা করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের প্রতি দেশের মানুষ তথা বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর আস্থা নেই। এখন সংলাপের মাধ্যমেই এর সমাধান বের করতে হবে। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সাউথ সার্কের এই মনোভাবের স্পিরিট স্পষ্ট নয়। এখন বিকল্প ভাবতে হবে। রাষ্ট্রপতি বিকল্প চিন্তায় আসতে পারেন। তবে তিনি রাজি হবেন এক শর্তে আর তা হচ্ছে বিএনপি তার নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু বিএনপি কী তা করবে? বিকল্প প্রস্তাব স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি রাজনীতিতে অভিজ্ঞ না হলেও একজন শিক্ষিত ও মার্জিত ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু রাজনীতি ভিন্ন বিষয়। উপরন্তু তিনি কি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না? যতদূর শোনা যায়, তিনি তো মহিলা ‘কোটা’ থেকে নয়; বরং সরাসরি দলের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। ইতোমধ্যে তিনি তার নোয়াখালীর নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করেছেন এবং সংবর্ধনাও নিয়েছেন। তাহলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ তো রয়েই গেল! বর্তমান সংকটের গভীরতা এত বেশি যে, স্পিকারের মতো একজন নবীন রাজনীতিবিদ (যিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছেন) এই সংকট মোকাবিলায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবেন, এটা আশা করতে পারছি না। তবে একটি সাহাবুদ্দীন ফর্মুলার বিষয়টি সরকার ও বিরোধী দল বিবেচনায় নিতে পারে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ প্রধান করা হয়েছিল। তিনি সুষ্ঠুভাবে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলেন এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তিনি আবার হাইকোর্টে ফিরে গিয়েছিলেন ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে এই ফর্মুলার আলোকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বিচারপতি হোসেন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কম। তিনি পর্দার অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানমালাতেও তাকে খুব একটা দেখা যায় না। তবে তার বিরুদ্ধে বড় আপত্তি উঠবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই। প্রধানমন্ত্রী চান না অনির্বাচিত কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে একটাই সংসদে যারাই নির্বাচিত, তারা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা কী কখনো দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারবেন?
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে তাদের তা না পারারই কথা। এখানে দলীয় আনুগত্য, সুবিধাবাদিতা এত বেশি যে, কারো প্রতি আস্থা রাখাটা কঠিন। সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে দু’দুটি সংসদ নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হলেও আওয়ামী লীগ তাদের সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ফলে কোনো প্রধান বিচারপতি কোনো দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবেন না। জাতীয় সংসদে বেশ ক’জন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান রয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই দেশের সংকটকালীন এগিয়ে আসেননি; বরং তারা সবাই দলীয় আনুগত্যের বেড়াজালে আটকা পড়েছেন। জাতি যখন তাদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে, তারা তখন থাকেন নির্লিপ্ত। তারা তাকিয়ে থাকেন নেতা-নেত্রীর দিকে। তাদের ক্ষমতার উৎস ওই নেতানেত্রী। জাতীয় স্বার্থ তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য নয়। তাই সমাধানের জট খোলার সম্ভাবনা কম। কেউ কারো অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে ‘বর্তমান কাঠামোয়’ ১৮ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম। তাই জাতীয় পার্টির দিকে চোখ থাকবে অনেকের। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এরশাদের নয়াদিল্লি সফর করার কথা। তাহলে যে ‘ছক’ রচিত হয়েছে, তাতে কী এরশাদ পা দিতে যাচ্ছেন? তিনি কি শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছেন? ব্যক্তি এরশাদ একাধিকবার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তার এমন কথায় কী আস্থা রাখা যায়? ইতিহাসে এরশাদের রাজনৈতিক ভূমিকা উজ্জ্বল নয়। সামরিক শাসক থেকে তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এসেছেন। উত্তরবঙ্গের তিনি অবিসংবাদিত নেতা। অতীতে তিনি যত অপবাদই মাথায় নিয়ে থাকেন না কেন, বারবার সংসদে নির্বাচিত হয়ে এসে প্রমাণ করেছেন তার এলাকার জনগণ তার ওপর আস্থা রেখেছেন। এখন জীবনের শেষ সময় এসে তিনি দাঁড়িয়েছেন। এটাই বোধকরি তার শেষ সংসদ নির্বাচন। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি নিজেকে আরো একবার বিতর্কিত করেন কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। রাজনীতির কোনো হিসাবই যেন আর মিলছে না। দুই নেত্রীর ফোনালাপ আমাদের হতাশার মাঝে ঠেলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ যেখানে চায় একটু স্বস্তি, চায় একটি সমঝোতা, সেখানে সংসদে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাহলে আস্থাটা থাকে কোথায়? সরকার নির্বাচনে যাবে। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে রেখে একটি সরকারও সম্ভবত গঠিত হতে যাচ্ছে! মূল ধারার রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, এমন কিছু দলকে নিয়ে যদি সরকার গঠিত হয়, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এটি করবে বটে, কিন্তু তাতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। এতে করে হানাহানি আরো বাড়বে। সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাবে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। সমস্যা যা ছিল, তাই থেকে যাবে।
দীর্ঘ ৬০ ঘণ্টার হরতাল আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। এই নভেম্বরে আরো যদি টানা হরতাল ও অবরোধ হয়, তাহলে অর্থনীতি একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই সমঝোতা দরকার। উভয় পক্ষই নমনীয় হবে, আরো বেশি করে আন্তরিক হবে এমন প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় সবার।
মানবকন্ঠ, ৫ নভেম্বর ২০১৩
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://manobkantha.com/2013/11/05/145581.html#sthash.o35cIuxl.XjBcd5oS.dpuf
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://manobkantha.com/2013/11/05/145581.html#sthash.o35cIuxl.XjBcd5oS.dpuf
0 comments:
Post a Comment