রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সর্বদলীয় সরকার, তৃতীয় জোট আর নিশার ঢাকা সফর

চলতি সপ্তাহে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। সোমবার বহুল আলোচিত একটি ‘সর্বদলীয় সরকার’ শপথ নিয়েছে। মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেও রোববারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি নেতা এইচএম এরশাদ ‘তেঁতুল তত্ত্ব’-এর প্রবক্তা মাওলানা শফীর আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর তৃতীয় একটি ফ্রন্ট গঠন করার কথা বলেছেন। আর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই ঢাকা ঘুরে গেছেন। সব কিছুই আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘিরে। রাজনীতিতে উত্তেজনা আছে। সংকট আছে। কিন্তু বড় প্রশ্ন যা, তা হচ্ছে সর্বদলীয় সরকার, একটি তৃতীয় ফ্রন্ট কিংবা নিশা দেশাইর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক সংকট, এর আদৌ কোনো সমাধান হবে কিনা? বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কিনা? আমার বিবেচনায় এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
একটি তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার হয়েছে, কিন্তু তাতে প্রধান বিরোধী দল নেই। যারা যোগ দিলেন, তারা তো সবাই মহাজোটেরই শরিক। তবে পার্থক্য একটাই যারা মহাজোটে ‘মন্ত্রী’ হতে পারেননি, এখন তারা মন্ত্রী হয়েছেন। তিন মাসের মন্ত্রী। কিন্তু সর্বদলীয় হলো কোথায়? আর এ সরকার সাংবিধানিকভাবে বৈধ কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কেননা সংবিধানের কোথাও ‘সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার বলে কিছু নেই। সংবিধানের ২য় পরিচ্ছেদে ৫৫ থেকে ৫৮ ধারা মন্ত্রিসভা গঠনসংক্রান্ত। এখানে কারা মন্ত্রী হবেন, এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি এ ধরনের সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।
দুই. মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়ে যা ঘটেছিল তাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, ‘মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা বৈধ ও সংবিধানসম্মত’ (মানবকণ্ঠ, ১৪ নভেম্বর)। আইনমন্ত্রী বললেন, সাংবিধানিকভাবে পদত্যাগ জমা দেয়া ঠিক হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বললেন, তার দফতরে পদত্যাগপত্র আসেইনি। অন্য মন্ত্রীদের কথা বাদই দিলাম। সুরঞ্জিত বাবু কিছুটা আইনকানুন বোঝেন বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি যখন বলেন, এটা বৈধ ও সংবিধানসম্মত, তারপরও তিনি ওই বৈঠকে যোগ দেন কীভাবে? বাংলাদেশের অনেকেই এখন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। মনগড়া সব সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দেন। আমি শুধু সংবিধানে কী লেখা আছে, সেটাই উল্লেখ করতে পারি। ৫৮ ১(ক) তে উল্লেখ আছে ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ সংবিধানের সর্বশেষ সংস্করণে এভাবেই লেখা আছে। তাহলে কী হয়েছিল ওই দিন? আমরা সবাই টিভিতে দেখলাম (পরদিন পত্রপত্রিকায় ছাপাও হলো), মন্ত্রীরা সব পদত্যাগ করলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে এক গাদা পদত্যাগপত্র। ৫ জন প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে কদমবুচি করেছেন-সে খবরও আছে। তারা পদত্যাগ করেছেন এবং সংবিধানের ৫৮ ১(ক) ধারা অনুযায়ী মন্ত্রীদের পদ ‘শূন্য’ হয়েছে। তাহলে রোববার (১৭ নভেম্বর) তারা মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন কীভাবে? সংবিধান বাদই দিলাম। নৈতিকতা বলে তো একটা কথা আছে। কেউ পদত্যাগ করে তো ‘মন্ত্রী’ হিসেবে মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে যোগ দিতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রধানমন্ত্রীকে কী উপদেশ দিয়েছিলেন, আমি জানি না। কিন্তু ‘উপদেশটি’ যে সঠিক ছিল না, তা বলতে পারি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবার ‘সচিবি মেজাজে’ সাংবাদিকদের বললেন, তারা কোনো ‘উকিল নোটিশের’ গুরুত্ব দেন না। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মন্ত্রীদের তাদের স্বপদে থাকা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। তিনি বড় আমলা। তার মাঝে অহংকার থাকারই কথা। এসব দলবাজ আমলারা যে ক্ষমতাসীন দলকে কত ক্ষতি করতে পারে, এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। বেগম জিয়ার এক অতি ক্ষমতাধর আমলার খবর সবাই জানেন। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায়। গবেষণা করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব আমলাকে বড় বেশি তোয়াক্কা করে চলেন। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কথায় আমি কষ্ট পেয়েছি। যখন রিটের কথা ওঠে, তখন বিষয়টি আইনের। তিনি আইনি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন অথবা উত্তরটা এড়িয়ে যেতে পারতেন। আমাদের আমলাদের নিয়ে সমস্যা এখানেই। এদিকে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব আমাদের জানালেন (বিবিসি বাংলা, প্রভাতি, ১৮ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতিকে দেননি। তাহলে কেমন হয়ে গেল না ব্যাপারটা? নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই কি পুরনো মন্ত্রিসভা বাতিল হয়ে গেল? সংবিধানে কিন্তু এরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী এখানেও ‘চমক’ দেখালেন।
তিন. শেষ পর্যন্ত আসল কথাটি বলে ফেলেছেন এইচএম এরশাদ। হাটহাজারীতে ‘বড় হুজুর’ মাওলানা শফীর সঙ্গে দেখা করে তিনি জানিয়ে দিলেন তিনি নির্বাচন করছেন এবং তৃতীয় একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন! তিনি আর মহাজোটে নেই, এ কথাটা জানাতেও ভোলেননি তিনি। এর মধ্যে দিয়েই কি সেই সত্যটাই প্রমাণিত হলো যে, এরশাদই হতে যাচ্ছেন দশম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা? অতীতে এরশাদ তো বারে বারে একটা কথাই বলে আসছেন-বিএনপি না এলে তিনি নির্বাচন করবেন না এবং সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না! তিনি ‘জাতীয় বেইমান’ হিসেবে পরিচিত হতে চান না, এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। তিনি যে নিজেকে বারে বারে হাস্যস্পদ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, এ কথাটা সম্ভবত তিনি মাঝে মধ্যে ভুলে যান। বিকল্প একটি জোট হতেই পারে। কিন্তু তিনি আবারো প্রমাণ করলেন আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয়ের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক জাতীয় পার্টির রাজনীতি আজকের নয়। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলে, জাতীয় পার্টি সেই সরকারে যোগ দিয়েছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রীও হয়েছিলেন। পরে মঞ্জুকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেও মঞ্জু তা মানেননি। শেষ পর্যন্ত দলটি ভেঙে গিয়েছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। এবারো এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় পাঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা তৃতীয় একটি জোট গঠনে আদৌ সহায়ক কি?
জাতীয় পার্টির যে রাজনীতি এর সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিরই ‘মিল’ বেশি। দুই পার্টির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্যই গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। প্রথমে জনদল (১৯৮৩) ও পরে জাতীয় পার্টি (১৯৮৬) গঠনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী (১৯ দফা) ‘অপর একটি’ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও গত ২৭ বছরে দলটি সঠিক একটি নীতি ও আদর্শের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। ব্যক্তি এরশাদকে কেন্দ্র করে দলটি আবর্তিত হলেও, দলটি বাংলাদেশে বিকল্প একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। উত্তরবঙ্গে ব্যক্তি এরশাদের জনপ্রিয়তাই হচ্ছে দলটির মূল শক্তি। তবে বলতেই হবে দুই প্রধান দলের বাইরে নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি। সর্বজন গ্রহণযোগ্য পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জাতীয় পার্টি ২৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (ভোটের হার ১১.৯২)। সপ্তম সংসদে (১৯৯৬) ২৯৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ৩২ (প্রাপ্ত ভোট ১৬.৩৯)। ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন ১৪ (প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২৮১ আসনে, প্রাপ্ত ভোট ৭.২৫ ভাগ)। এই সময় এরশাদ কিছু ইসলামিক দল নিয়ে ইসলামি জাতীয় ঐকফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি এবং ফ্রন্ট তার অস্তিত্বও বজায় রাখেনি। আর সর্বশেষ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসন ২৬, আর প্রাপ্ত ভোট ৭.০৫ ভাগ। এখন যে দল মাত্র শতকরা ৭ ভাগ ভোট পায় (যেখানে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে শতকরা ৪৮.০৬ ও ৩২.৪৫ ভাগ), সেখানে ওই দলের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের ভিত্তি কতটুকু শক্তিশালী? যদিও কাজী জাফর বলেছেন, তারা ‘নির্বাচনী জোট’ করছেন না, বরং ‘আন্দোলনের জোট’ করছেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন! এখানেও প্রশ্ন আছে। কাদের সঙ্গে জোট হচ্ছে? কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, কিংবা ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম? এদের গণভিত্তি কী? কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মানুষ তাকে সম্মান করে। কিন্তু তিনিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। এই প্রজন্ম তাকে চেনে না (২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল পেয়েছিল ০.৪৭ ভাগ ভোট)। গণফোরাম? ড. কামাল হোসেন নামিদামি ব্যক্তি। কিন্তু তার কোনো গণভিত্তি নেই। তরুণ প্রজন্ম তাকে চেনে না (১৯৯৬ সালে দলের প্রাপ্ত ভোট ০.১২ ভাগ)। আর জেএসডি? আ স ম আবদুর রবের দলের প্রাপ্ত ভোট ০.২৩ ভাগ (১৯৯৬)। এরা মূলত ব্যক্তিসর্বস্ব। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্লিন ইমেজের মানুষ। মুন্সীগঞ্জের বাইরে তার অবস্থান কোথায়? তার ছেলে মাহি বি চৌধুরী বাবার ইমেজে চলেন। আর মেজর (অব.) মান্নান প্রচুর টাকার মালিক। কিন্তু টাকা দিয়ে কি সব সময় রাজনীতি হয়? এরা সবাই মূলত ব্যক্তিনির্ভর এক একটি দল, যাদের কোনো গণভিত্তি নেই। এদের দিয়ে ‘মিডিয়া কভারেজ’ হতে পারে, কিন্তু কোনো তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
চার. নিশা দেশাই বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিশা দেশাই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে এবং ড. ইউনূসের সঙ্গেও। আমার বিবেচনায় এটাই গুরুত্বপূর্ণ বেশি, যা পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। যারা দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনি নীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যে নীতি তা পরিচালিত হয় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। মনে রাখতে হবে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিতে ভারতের অগ্রাধিকার বেশি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কখনো ভারতকে পাশ কাটিয়ে কিছু করবে না। কিছুদিন আগে মজিনার নয়াদিল্লি সফরের পর বাংলাদেশি কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ভারতীয় অবস্থান পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ দুটি দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন! অনেকে এমন অভিমতও পোষণ করেছেন যে, দু’দেশের অবস্থান সাংঘর্ষিক। এই ধারণা ভুল। পরে মজিনার একটি বক্তব্যে সেটা আরো স্পষ্ট হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মনোভাবকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো নীতি প্রণয়ন করেনি এবং আগামীতে করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ‘বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে’ যে নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের, এই দাবি নিশাও করেছেন। তবে এই দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র আদৌ কোনো ‘চাপ’ প্রয়োগ করবে না। এ ক্ষেত্রে এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে এক ধরনের ‘লেজিটেমেসি’ খুঁজতে চেষ্টা করবে সরকার। ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরনের একটি বক্তব্যও এখানে স্মরণ করা দরকার। শ্রী শরণ গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে।’ তিনি এও বলেছেন, দু’দেশের মাঝে (অর্থাৎ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) নিয়মিত আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে এ আলোচনা চালানো হচ্ছে বলেও তিনি অভিমত পোষণ করেছিলেন (মানবকণ্ঠ)।
পাঠক, লক্ষ্য করুন ভারতীয় হাইকমিশনার গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘিœত হোক, তা দেশ দুটি কখনোই চাইবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই ভারত কখনোই চাইবে না বাংলাদেশ অস্থিতিশীল থাকুক। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও অনেকটা তেমনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চায় না বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা বাড়–ক। নিশা দেশাই এলেন। দেখলেন। মতবিনিময় করলেন। কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-ব্যবস্থা তিনি নিশ্চিত করতে পারলেন কিনা, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। পাঁচ. এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। আমাদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের অগ্রযাত্রাকে অনেক পেছনে ঠেলে দিতে পারে। বাইরের কোনো শক্তি আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করুক, আমরা তা চাই না। কিন্তু সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পঙ্কজ শরণের বক্তব্যেই তা প্রমাণিত হলো। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এরশাদের তৃতীয় জোট গঠনের ঘোষণাও সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেবে বলে মনে হয় না। এতে সাময়িক একটা সমাধান পাওয়া যাবে। কিন্তু অস্থিতিশীলতা, অস্থিরতা, বিরোধ থেকে যাবেই। একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সমঝোতা দরকার। এটা আওয়ামী লীগের জন্যও মঙ্গল।
দৈনিক মানব কন্ঠ, ১৮ নভেম্বর২০১৩
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীনগর, বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক - See more at: http://manobkantha.com/2013/11/20/147559.html#sthash.dceldNje.QtU7buN8.dpuf

0 comments:

Post a Comment