নিশা দেশাই বাংলাদেশে এসেছিলেন। আবার চলেও গেছেন। নিশা দেশাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি রবার্ট ব্লেকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নিশা দেশাইয়ের সফরকে কোনো কোনো মহল থেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলেও এ সফর বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে না। বাংলাদেশে আসা তার রুটিন ওয়ার্ক। দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে তিনি কাজ করবেন। পররাষ্ট্র সচিবকে, এমনকি প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেবেন। তাই তার বাংলাদেশে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে কোনো কোনো মহল তার এ সফরকে ভিন্নভাবে নিলেও নিতে পারে। মোদ্দা কথা, তার এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আসার সম্ভাবনাও কম।
যারা দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে মার্কিনি নীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যে নীতি, তা পরিচালিত হয় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিতে ভারতের অগ্রাধিকার বেশি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কখনও ভারতকে পাশ কাটিয়ে কিছু করবেন না। কিছুদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনার নয়াদিল্লি সফরের পর দেশের কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ভারতীয় অবস্থান পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ দুটি দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন! অনেকে এমন অভিমতও পোষণ করেছেন যে, দু’দেশের অবস্থান সাংঘর্ষিক! এ ধারণা ভুল। পরে মজিনার একটি বক্তব্যে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মনোভাবকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো নীতি প্রণয়ন করেনি এবং আগামীতে করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ভারতের মনোভাবের সঙ্গে সমন্বয় করেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণীত হয়েছে এবং কোনো অবস্থাতেই তা ভারতীয় স্বার্থকে ক্ষুণœ করে নয়। মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ভারত একটি ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়। কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত বা উপেক্ষা করে নয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা) চুক্তিতে রাজি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে নেবে। কিন্তু তাতে করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) দেবে, এটা আমার মনে হয় না।
মূল বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবহরের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে একটি নৌ-মহড়া হবে ভারত মহাসাগরে। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ভারত ওই মহড়ায় অংশ নিক। মালদ্বীপের সঙ্গেও একটি ‘সোফা’ চুক্তি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা জানেন, এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশ ক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। যে কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিন ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। অনেকেরই জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এরই মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তির আওতায় দৃশ্যত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করলেও মূল বিষয় একটিই- যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণে’র আড়ালে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না! বলা ভালো, প্রতিবছর একবার ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’র আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল বছরের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে। আর এবার দ্বিতীয় সংলাপ হল ঢাকায় গত ২৬ মে। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ভেতরের অনেক কথাই জানানো হয় না। বাংলাদেশ এর আগে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তাই গুজবের ডালপালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরও ছড়াবে।
গেল বছরের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় ন্যাটোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে স্ট্র্যাটেজিক মিলিটারি পার্টনারশিপ কনফারেন্স। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতিনির্ধারকরা মোট চার ভাগে ভাগ করেছে, যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন ইউরোপের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে দ্য পার্টনারশিপ ফর পিস। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া, তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে মেডিটেরিয়ান ডায়ালগ মেমবার্স। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ইসতান্বুল কোঅপারেশন ইনিশিয়েটিভ। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো ‘পার্টনার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোবে’র ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানও এ ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এখন এল সালভাদর ও কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার এডমিরাল স্টাভরিডিস সম্প্রতি বলেছেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন এবং আশা করছেন এ দেশ দুটি ‘পার্টনার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোবে’র ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকাণ্ডে শরিক হবে। ২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে।
ন্যাটোর এ ভূমিকা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিশ্বকে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হলেও ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া হয়নি বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাটো ও ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধে’র আশংকা দেখা দিয়েছিল। সেই যুদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এ দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি- রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এ অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের জন্মের আশংকাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভয় ও শংকা’ এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের। গত ৮ জুন নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এ সফরে ওবামার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশকিছু ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনিদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশংকার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য ও সেই সঙ্গে সব বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব চুক্তি’ করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আর ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভারতকে প্রয়োজন রয়েছে ওবামা প্রশাসনের। ভুলে গেলে চলবে না জাতিসংঘের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৩) যোগ দেয়া যে ক’জন সরকারপ্রধানকে ওবামা হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার মাঝে অন্যতম ছিল ভারত। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে হলে তার ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত উঠতি শক্তি। সামাজিক তো বটেই, অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। মার্কিন স্বার্থ বিঘ্নিত হবে যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সেটা কখনোই চাইবে না।
বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনও একক কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ভারতীয় মনোভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত। বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। দাতা দেশগুলোর উদ্যোগ কিংবা জাতিসংঘের মহাসচিবের ফোনের পরও সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। সরকার এককভাবে হাঁটছে। আর বিএনপি যাচ্ছে হার্ডলাইনে। সংলাপ প্রত্যাশিত হলেও সংলাপের কোনো সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সংলাপ নিয়ে পরস্পরবিরোধী মন্তব্যও লক্ষ্য করা যায়। তাই স্পষ্টতই মজিনার নয়াদিল্লি সফর নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছিল। নয়াদিল্লি সফর শেষ করে মজিনা ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনে যে তিনি বাংলাদেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের অবস্থান এক ও অভিন্ন কি-না? অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে এ দু’দেশের মনোভাব এক কি-না? এখানে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অবস্থান স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এর আগে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কিত পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবট। তিনিও বলেছিলেন ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে’র কথা। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে। তার ওই সফরের পরপরই ঢাকা সফরে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক নবনিযুক্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি কি ভারতীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক? ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা কি চান ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হোক? আমার মনে হয়, ভারতও এটা চায়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ভারতের স্বার্থেই মঙ্গল। নিশা দেশাই দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশী নেতাদের মনোভাব জানলেন। এক্ষেত্রে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র চায় ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন। নিশা দেশাইয়ের সফরের পর এতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না।
যারা দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে মার্কিনি নীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যে নীতি, তা পরিচালিত হয় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিতে ভারতের অগ্রাধিকার বেশি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কখনও ভারতকে পাশ কাটিয়ে কিছু করবেন না। কিছুদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনার নয়াদিল্লি সফরের পর দেশের কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ভারতীয় অবস্থান পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ দুটি দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন! অনেকে এমন অভিমতও পোষণ করেছেন যে, দু’দেশের অবস্থান সাংঘর্ষিক! এ ধারণা ভুল। পরে মজিনার একটি বক্তব্যে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মনোভাবকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো নীতি প্রণয়ন করেনি এবং আগামীতে করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ভারতের মনোভাবের সঙ্গে সমন্বয় করেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণীত হয়েছে এবং কোনো অবস্থাতেই তা ভারতীয় স্বার্থকে ক্ষুণœ করে নয়। মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ভারত একটি ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়। কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত বা উপেক্ষা করে নয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা) চুক্তিতে রাজি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে নেবে। কিন্তু তাতে করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) দেবে, এটা আমার মনে হয় না।
মূল বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবহরের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে একটি নৌ-মহড়া হবে ভারত মহাসাগরে। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ভারত ওই মহড়ায় অংশ নিক। মালদ্বীপের সঙ্গেও একটি ‘সোফা’ চুক্তি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা জানেন, এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশ ক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। যে কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিন ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। অনেকেরই জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এরই মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তির আওতায় দৃশ্যত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করলেও মূল বিষয় একটিই- যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণে’র আড়ালে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না! বলা ভালো, প্রতিবছর একবার ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’র আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল বছরের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে। আর এবার দ্বিতীয় সংলাপ হল ঢাকায় গত ২৬ মে। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ভেতরের অনেক কথাই জানানো হয় না। বাংলাদেশ এর আগে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তাই গুজবের ডালপালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরও ছড়াবে।
গেল বছরের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় ন্যাটোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে স্ট্র্যাটেজিক মিলিটারি পার্টনারশিপ কনফারেন্স। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতিনির্ধারকরা মোট চার ভাগে ভাগ করেছে, যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন ইউরোপের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে দ্য পার্টনারশিপ ফর পিস। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া, তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে মেডিটেরিয়ান ডায়ালগ মেমবার্স। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ইসতান্বুল কোঅপারেশন ইনিশিয়েটিভ। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো ‘পার্টনার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোবে’র ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানও এ ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এখন এল সালভাদর ও কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার এডমিরাল স্টাভরিডিস সম্প্রতি বলেছেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন এবং আশা করছেন এ দেশ দুটি ‘পার্টনার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোবে’র ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকাণ্ডে শরিক হবে। ২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে।
ন্যাটোর এ ভূমিকা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিশ্বকে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হলেও ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া হয়নি বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাটো ও ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধে’র আশংকা দেখা দিয়েছিল। সেই যুদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এ দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি- রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এ অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের জন্মের আশংকাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভয় ও শংকা’ এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের। গত ৮ জুন নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এ সফরে ওবামার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশকিছু ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনিদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশংকার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য ও সেই সঙ্গে সব বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব চুক্তি’ করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আর ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভারতকে প্রয়োজন রয়েছে ওবামা প্রশাসনের। ভুলে গেলে চলবে না জাতিসংঘের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৩) যোগ দেয়া যে ক’জন সরকারপ্রধানকে ওবামা হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার মাঝে অন্যতম ছিল ভারত। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে হলে তার ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত উঠতি শক্তি। সামাজিক তো বটেই, অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। মার্কিন স্বার্থ বিঘ্নিত হবে যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সেটা কখনোই চাইবে না।
বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনও একক কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ভারতীয় মনোভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত। বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। দাতা দেশগুলোর উদ্যোগ কিংবা জাতিসংঘের মহাসচিবের ফোনের পরও সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। সরকার এককভাবে হাঁটছে। আর বিএনপি যাচ্ছে হার্ডলাইনে। সংলাপ প্রত্যাশিত হলেও সংলাপের কোনো সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সংলাপ নিয়ে পরস্পরবিরোধী মন্তব্যও লক্ষ্য করা যায়। তাই স্পষ্টতই মজিনার নয়াদিল্লি সফর নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছিল। নয়াদিল্লি সফর শেষ করে মজিনা ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনে যে তিনি বাংলাদেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের অবস্থান এক ও অভিন্ন কি-না? অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে এ দু’দেশের মনোভাব এক কি-না? এখানে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অবস্থান স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এর আগে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কিত পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবট। তিনিও বলেছিলেন ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে’র কথা। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে। তার ওই সফরের পরপরই ঢাকা সফরে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক নবনিযুক্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি কি ভারতীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক? ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা কি চান ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হোক? আমার মনে হয়, ভারতও এটা চায়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ভারতের স্বার্থেই মঙ্গল। নিশা দেশাই দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশী নেতাদের মনোভাব জানলেন। এক্ষেত্রে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র চায় ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন। নিশা দেশাইয়ের সফরের পর এতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না।
দৈনিক যুগান্তর, ২১ নভেম্বর ২০১৩।
ড. তারেক শামসুর রেহমান :
ড. তারেক শামসুর রেহমান :
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
- See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2013/11/21/43058#sthash.hBNtQOCp.nlscp0mV.dpuf
tsrahmanbd@yahoo.com
- See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2013/11/21/43058#sthash.hBNtQOCp.nlscp0mV.dpuf
0 comments:
Post a Comment