রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি

গত ১৬ নভেম্বর বিবিসির বাংলা বিভাগের একটি সংবাদ_ জাতীয় পার্টির নেতা এইচএম এরশাদ একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন! বিবিসি জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা কাজী জাফর আহমেদের সঙ্গেও কথা বলেছে। এর আগে টাঙ্গাইলের সখীপুরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের এক জনসভায় কাজী জাফরসহ বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। ধারণা করা হয়, তাদের সমন্বয়ে একটি জোট গঠিত হতে পারে!
প্রশ্ন হচ্ছে, এ জোট কিসের জন্য? এ জোট বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কি-না কিংবা নির্বাচনী রাজনীতিতে এ জোটের ভবিষ্যৎ কী? বাংলাদেশে এ মুহূর্তে দুটি রাজনৈতিক জোট রয়েছে। একটি সরকারি দল_ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট; অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল_ বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট। এ দুই জোটের রাজনীতিও মোটামুটিভাবে স্পষ্ট। নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি আঁতাত তাদের মধ্যে রয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ইত্যাদি ধারণ করছে ১৪ দলীয় জোট। অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক আদর্শ ইত্যাদি ধারণ করেছে ১৮ দলীয় জোট। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দুই জোটের মধ্যে প্রধান দল দুটি একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি। এর বাইরে ১৪ দল কিংবা ১৮ দলে যেসব দল রয়েছে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। মজার ব্যাপার, এই ১৪ দলে এখনও আছেন এইচএম এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি। তার দলে কিছুটা সাংগঠনিক ভিত্তি আছে, এটাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ দলটির কোনো সুস্পষ্ট নীতি নেই_ এরশাদ বারবার বলে আসছেন, তিনি আর ১৪ দলে নেই, এককভাবে নির্বাচন করবেন ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও তিনি এখন পর্যন্ত ১৪ দলীয় জোটেই আছেন। নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিয়েছে তার দল এবং দলের ৪ জন নেতা মন্ত্রী ও একজন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছেন। জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড দেখে এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, জাতীয় পার্টির মধ্যে দুটি ধারা আছে_ একটি ধারা যারা সরকারের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী, অন্যটি যারা সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে আঁতাতের পক্ষপাতী অথবা বিকল্প একটি জোট গড়ার পক্ষে। আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক জাতীয় পার্টির রাজনীতি আজকের নয়। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলে জাতীয় পার্টি সেই সরকারে যোগ দিয়েছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রীও হয়েছিলেন। পরে মঞ্জুকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেও মঞ্জু তা মানেননি। শেষ পর্যন্ত দলটি ভেঙে গিয়েছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০০৯ সালে, যখন আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। এবারও এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় পাঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় পার্টির এ ভূমিকা তৃতীয় একটি জোট গঠনে আদৌ সহায়ক কি-না?
জাতীয় পার্টির যে রাজনীতি তার সঙ্গে বিএনপি রাজনীতিরই 'মিল' বেশি। দুই পার্টির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্যই গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। প্রথমে জনদল (১৯৮৩) ও পরে জাতীয় পার্টি (১৯৮৬) গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী (১৯ দফা) 'অপর একটি' দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও গত ২৭ বছরে দলটি সঠিক একটি নীতি ও আদর্শের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। ব্যক্তি এরশাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও দলটি বাংলাদেশে বিকল্প একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। উত্তরবঙ্গে ব্যক্তি এরশাদের জনপ্রিয়তাই হচ্ছে দলটির মূল শক্তি। তবে বলতেই হবে, দুই প্রধান দলের বাইরে নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি। সর্বজন গ্রহণযোগ্য পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জাতীয় পার্টি ২৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (ভোটের হার ১১.৯২)। সপ্তম সংসদে (১৯৯৬) ২৯৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ৩২ (প্রাপ্ত ভোট ১৬.৩৯)। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন ১৪ (প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২৮১ আসনে, প্রাপ্ত ভোট ৭.২৫ ভাগ)। এ সময় এরশাদ কিছু ইসলামিক দল নিয়ে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি এবং ফ্রন্ট তার অস্তিত্বও বজায় রাখেনি। আর সর্বশেষ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসন ২৬ (প্রাপ্ত ভোট ৭.০৫ ভাগ)। এখন যে দল মাত্র শতকরা ৭ ভাগ ভোট পায় (যেখানে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে শতকরা ৪৮.০৬ ও ৩২.৪৫ ভাগ), সেখানে ওই দলের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের ভিত্তি কতটুকু শক্তিশালী? যদিও কাজী জাফর বলেছেন তারা 'নির্বাচনী জোট' করছেন না, বরং 'আন্দোলনের জোট' করছেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন! এখানেও প্রশ্ন আছে_ কাদের সঙ্গে জোট হচ্ছে? কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্পধারা, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি কিংবা ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম? এদের গণভিত্তি কী? কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মানুষ তাকে সম্মান করে। কিন্তু তিনিও বিতর্কের ঊধর্ে্ব নন। এ প্রজন্ম তাকে চেনে না (২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল পেয়েছিল ০.৪৭ ভাগ ভোট)। গণফোরাম? ড. কামাল হোসেন নামিদামি ব্যক্তি। কিন্তু তার কোনো গণভিত্তি নেই। তরুণ প্রজন্ম তাকে চেনে না (১৯৯৬ সালে দলের প্রাপ্ত ভোট ০.১২ ভাগ)। আর জেএসডি? আ স ম আবদুর রবের দলের প্রাপ্ত ভোট ০.২৩ ভাগ (১৯৯৬)। এরা মূলত ব্যক্তিসর্বস্ব। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্লিন ইমেজের লোক। মুন্সীগঞ্জের বাইরে তার অবস্থান কোথায়? তার ছেলে মাহী চৌধুরী বাবার ইমেজে চলেন। আর মেজর (অব.) মান্নান প্রচুর টাকার মালিক। কিন্তু টাকা দিয়ে কি সবসময় রাজনীতি হয়? এরা সবাই মূলত ব্যক্তিনির্ভর এক একটি দল, যাদের কোনো গণভিত্তি নেই। এদের দিয়ে 'মিডিয়া কাভারেজ' হতে পারে, কিন্তু কোনো তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, মূল যে শক্তি জাতীয় পার্টি আবারও ভেঙে যেতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারে জাতীয় পার্টি যোগ দিয়েছে। দলের কয়েকজন মন্ত্রী হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কাজী জাফর যতই 'তৃতীয় শক্তি'র কথা বলেন না কেন তিনি খুব বেশি লোক পাবেন বলে মনে হয় না। জাতীয় পার্টির হেভিওয়েট যারা, দেখা গেল তারাই 'মন্ত্রী' হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের কাছে তদবির করেছেন! গত ২৭ বছরে জাতীয় পার্টির যে রাজনীতি এই 'রাজনীতি' দলটিকে একটি আলাদা অবস্থানে দাঁড় করাতে পারেনি। বিএনপির বিকল্প একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এরশাদের দোদুল্যমানতা, সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থতা, সর্বোপরি দলের সিনিয়র নেতাদের আওয়ামী লীগ ঘেঁষা রাজনীতির কারণে জাতীয় পার্টির পরিচয় চূড়ান্ত বিচারে আওয়ামী লীগের 'মিত্র' হিসেবেই। জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিয়ে এটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের (তৃতীয় সংসদ) মতো একটি নির্বাচন আবারও প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি চূড়ান্ত বিচারে দুটি প্রধান দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরেই আবর্তিত হবে। তবে যে 'জোট' রাজনীতি শুরু হয়েছে তা বহমান থাকবে। কোনো একক দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হলেও দল প্রাধান্য দেবে 'জোট' রাজনীতির ওপর। অর্থাৎ আরও কিছুদিনের জন্য হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি একদিকে বাঙালি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, অন্যদিকে বাংলাদেশি ও ইসলামনির্ভর, এ দুই ধারায় বিভক্ত থাকবে। এর মাঝামাঝি কোনো তৃতীয় ধারা বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
দৈনিক সমকাল, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment