গত ৩
নভেম্বর কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে। ওই সংবাদে
বলা হয়েছে চলতি মাসেই টিকফা বা Trade and Investment Co-operation Framework
Agreement (TICFA) চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাবে।
বহুল আলোচিত এই চুক্তিটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হলেও এই চুক্তি নিয়ে সংসদে
বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। এমনকি এই চুক্তিটির ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিরও
কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকার যখন এ ধরনের একটি চুক্তি
স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়, তখন তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। সরকারের পক্ষ থেকে
বলা হয়েছে, এতে করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ
বাড়বে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো উন্নত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরও টিকফা
চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে টিকফা
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র
কিছুদিন আগে কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত
করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয়
শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের
হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না
করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে একপর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের
মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশ সরকারের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে
যে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলে হয়তো বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে।
প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি যে বিষয়
গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি
পণ্যের রপ্তানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধা চেয়ে
আসছিল। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে
বাংলাদেশি পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ শতাংশ
পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায়
৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনো তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার
ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশি পণ্যে, এর মাঝে
রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশি
রপ্তানিকারকরা ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ববাণিজ্য
সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে
তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা
উন্নত রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা
চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই, তাহলে
এই জিএসপি সুবিধা রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। আজ যদি জিএসপি
সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করি, তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলানো যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি
ভিন্ন বিষয়।
এখন যে
প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব।
টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে
আমাদের বাজার ও সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক
প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির
(প্রস্তাবিত) ৫ ও ১৯ ধারা মতে উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ
নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮ নম্বর ধারায়
ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে
কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কিভাবে আরো বিকশিত করা যায়,
সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেওয়া। ৯ নম্বর ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন
করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে বিশেষ
করে সেবা খাতে এবং এসব কম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো
প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয়
উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। চুক্তির ফলে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস,
বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলি কমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে
বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে, শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনা
মূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে
শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা
গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই
কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব
সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে 'সেবা' পেত, তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে।
সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম
বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি
ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর।
কৃষিতে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দোহা
চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে
না। টিকফা চুক্তির ১৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ শতাংশ। এখন বাংলাদেশে
কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক
উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না। কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি
পণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কম্পানিগুলো, যারা গম
ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। বলা হচ্ছে
টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রপ্তানি বৃদ্ধি
পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৩ ভাগ)
বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয় (মাত্র শতকরা ৩ শতাংশ)।
অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিকফা চুক্তিও নেই। বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে
মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্ত প্রয়োগ
হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধ শিল্প ও কম্পিউটার
ব্যবহারকারীরা। কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কম্পানিগুলোর
কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কম্পানিগুলো একসময় জিম্মি করে ফেলবে
আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা
চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা, ওষুধ কম্পানিগুলো
প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই
ওষুধ রপ্তানি হয়। তখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কম্পানিগুলোর
প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই
সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কম্পানির
লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী
ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়্যার শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা, এখন
স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে
কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয় সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার
কারণে এই ক্লোন কম্পিউটার আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন
ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ
মানুষের ক্রয় সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে 'ডিজিটাল যুগের' কথা বলছে, তা
বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন।
টিকফা
চুক্তি নিয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেই সম্ভাবনা
ক্ষীণ। সামনে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন অনেকের
মাঝেই যে প্রশ্নটি উঠবে, তা হচ্ছে মার্কিন আস্থা ফিরে পেতেই কী সরকার তড়িঘড়ি করে
টিকফা চুক্তিটি করতে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা পুনর্বিবেচনা করবে, তারও
কোনো গ্যারান্টি নেই। তাহলে কার স্বার্থে এই চুক্তিটি হতে যাচ্ছে? বিএনপির নীরবতাও
আমাদের নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিএনপির নীরবতা কি শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে 'খুশি'
করার জন্যই? কোনো চুক্তি যদি জাতীয় স্বার্থে করা হয়, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা
নয়। কিন্তু কোনো চুক্তি করে আমরা যদি উপকৃত না হই, তাহলে কেন করব আমরা এই চুক্তি?
টিকফা চুক্তি তাই অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে, সন্দেহ নেই তাতে।
0 comments:
Post a Comment