রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বরফ কি গলবে আদৌ?

দুই নেত্রীর ফোনালাপের পর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার কি অবসান হতে চলছে? গত ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি তথা ১৮ দলের জনসভা ও পরপর তিন দিনের হরতালের পর স্পষ্টতই এটা পরিষ্কার, বিএনপি হার্ডলাইনে গেছে। জনসভা করতে না দেয়ার ব্যাপারে ডিএমপি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল, তা বড় ধরনের সংঘাতের জন্ম দিতে পারত। কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ১৮ দলকে জনসভা করতে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি ঘোষণা দেন তিনি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হবেন না, তাহলে সংকটের সমাধানেই তিনি শুধু এক ধাপ এগিয়ে যাবেন না, বরং সাধারণ মানুষের মাঝেও তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার এটা এখনকার বাস্তবতা। এ বাস্তবতা আমরা যত দ্রুত মেনে নিতে পারব, ততই এ জাতির মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রী এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু দল ও নীতিনির্ধারকদের অনেকেই যে ভাষায় কথা বলেন, তা সংকট নিরসনে কোনো কাজে আসবে না।
যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি কে নিতে যাচ্ছেন? সরকারের পক্ষ থেকে দুটি সম্ভাবনা দেখা হচ্ছে। এক. রাষ্ট্রপতি এই দায়িত্বটি নিতে পারেন; দুই. সংসদের স্পিকার নিতে পারেন এ দায়িত্ব। কিন্তু বিরাধী দলের কাছে এ প্রস্তাব দুটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ ইত্যাদি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। বিরোধী দলের অনেকেই তাকে পছন্দ করেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে তিনি পদত্যাগ করলেও মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনায় তিনি আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সুতরাং আপত্তি ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ নিজে রাজি নাও হতে পারেন। জীবনে যা পাওয়ার, তা তিনি পেয়েছেন। এর বেশি পাওয়ার কিছু নেই। তার নামকে তিনি বিতর্কিত কিংবা কলংকিত করতে দেবেন না। তিনি রাজি হতে পারেন শুধু একটি শর্তে- আর তা হচ্ছে বিএনপি তার নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু বিএনপি কি তা করবে? দ্বিতীয়ত, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রাজনীতিতে অভিজ্ঞ না হলেও একজন শিক্ষিত ও মার্জিত ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। কিন্তু রাজনীতি ভিন্ন জিনিস। উপরন্তু তিনি কি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না? তিনি তো মহিলা কোটা থেকে নয়, বরং সরাসরি দলের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। এরই মধ্যে তিনি তার নোয়াখালীর নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করেছেন এবং সংবর্ধনাও নিয়েছেন। তাহলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তো রয়েই গেল।
বর্তমান সংকটের গভীরতা এত বেশি যে, স্পিকারের মতো একজন নবীন রাজনীতিক (যিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছেন) এ সংকট মোকাবেলায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবেন, এটা আশা করতে পারছি না। ফলে এ দুই সম্ভাবনা সংকট মোকাবেলায় কোনো অবদান রাখতে পারবে না। তবে একটি ‘সাহাবুদ্দিন ফর্মুলা’র বিষয় সরকার ও বিরোধী দল বিবেচনায় নিতে পারে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ প্রধান করা হয়েছিল। তিনি ১৯৯১ সালে সুষ্ঠুভাবে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলেন এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তিনি আবার হাইকোর্টে ফিরে গিয়েছিলেন ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে এ ফর্মুলার আলোকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বিচারপতি হোসেন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কম। তিনি পর্দার অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানমালাতেও তাকে খুব একটা দেখা যায় না। তবে তার বিরুদ্ধে বড় আপত্তি উঠবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই। প্রধানমন্ত্রী চান না অনির্বাচিত কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হন। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে একটাই- সংসদে যারাই নির্বাচিত, তারা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা কি কখনও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারবেন? বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে তাদের তা না পারারই কথা। এখানে দলীয় আনুগত্য, সুবিধাবাদিতা এত বেশি যে কারও প্রতি আস্থা রাখাটা কঠিন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারেন সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ব্যক্তি তিনি নন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, সংসদে বেশ ক’জন পার্লামেন্টারিয়ান রয়েছেন যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদও পারেন একটি ভূমিকা নিতে। কিন্তু দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেউ কখনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। তোফায়েল আহমেদের মতো রাজনীতিক, যিনি তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন, তিনি স্পষ্ট কথা বলতে গিয়ে স্বয়ং দলীয় প্রধানের আস্থা হারিয়েছিলেন। তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া ছিল অবাক করার মতো ঘটনা। পরে তার প্রয়োজনীয়তা যখন অনুভূত হয়েছিল, তখন তিনি সেই সাহস দেখিয়েছিলেন মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়ে। সত্তর ঊর্ধ্ব বয়স তোফায়েল আহমেদের। দশম কিংবা এগারতম সংসদে একজন নির্বাচিত এমপির চেয়ে অনেক বেশি অবদান তিনি রাখতে পারবেন সংকটকালীন একটি গুরুদায়িত্ব পালন করে। কিন্তু তিনি তা করবেন না। ওই ‘রাজনীতির’ বৃত্ত তিনি ভাঙতে পারবেন না।
একজন ‘নির্বাচিত এমপি’র যে দাবি, যিনি নির্দলীয় সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেবেন, সে ব্যাপারে ‘সমাধান’ বের করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সেখানেও রয়েছে নানা সমস্যা। একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি সংসদে ‘নির্বাচিত’ হয়ে আসবেন, এটা অনেকেই মানতে চাইবেন না। তাই ফোনালাপ কোনো জট খুলবে বলে মনে হয় না। ফোনালাপ নিয়েও কথা আছে। ফোনালাপে দুই নেত্রীর বক্তব্য শোভন ছিল না, এমন অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন এক মন্ত্রীর আক্ষেপ বড্ড বেশি। তাহলে কী হতে যাচ্ছে দেশে? বিরোধীদলীয় নেত্রী কি সরাসরি ফোন করে গণভবনে যাবেন? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন উদাহরণ নেই। বেগম জিয়া ফোন করে সরাসরি গণভবনে চলে যাবেন এবং শেখ হাসিনা তাকে প্রধান গেটে শুভেচ্ছা জানাবেন- এটা শুধু কল্পনাতেই আসে! বাস্তবে এর সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদিও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, দুই নেত্রীর মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে মহাসচিব পর্যায়ে। আমি মনে করি, সেটাই সঠিক ও শোভন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব আর সংসদে দেয়া বিএনপির প্রস্তাব নিয়ে দু’পক্ষ আলোচনা করতে পারে। একটি সাবকমিটিও গঠিত হতে পারে। একজন মন্ত্রী বলেছেন, আলোচনা হবে সংবিধানের ভিত্তিতে। সেটা ঠিক আছে। শুরুটা হোক না, ক্ষতি কী তাতে? বিএনপির প্রস্তাব যে সংবিধান সম্মত, এটা বিএনপি প্রমাণ করুক। বিএনপির ওই প্রস্তাব সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এতে করে বিএনপির অভিযোগই ‘সত্য’ বলে প্রমাণিত হল যে, সংসদে তাদের প্রস্তাব গুরুত্ব পায় না। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে সংলাপ ছাড়া বিকল্প নেই। যদিও সংলাপের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। তারপরও একটি ব্যর্থতাকে নিয়ে সবই ‘ব্যর্থ’, এটা প্রমাণ করা যাবে না। সংলাপ হোক। আমার বিশ্বাস, সমাধান একটা বের হবেই। কারণ সরকার আর বিরোধী দলের এক জায়গায় মিল আছে- আর তা হচ্ছে, কেউই চাচ্ছে না অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতায় আসুক।
‘নির্বাচিত একটি সরকার তার শেষ সময় এসেই নির্বাচন দেয়’- আমরা যদি এ ধারণার ওপর আস্থাও রাখি, তাহলেও একটা কথা থেকে যায়। বর্তমান নির্বাচিত সরকার তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে বিরোধী দলের সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি, যাতে করে বিরোধী দল সরকারকে বিশ্বাস করতে পারে। বিরোধী দলকে জনসভা করতে না দেয়া, প্রকাশ্যে বিরোধী দলের জনসভায় গুলিবর্ষণ করা, নেতা ও নেত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা করা আর হয়রানি করা- এসব আর যাই হোক, এতে করে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় না। বর্তমান সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা যে, তারা এ আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই শেষ সময়ে এসে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ আদৌ কোনো ফল দেবে বলে মনে হয় না। তবুও আমরা চাই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও জাতি হানাহানিতে মত্ত থাকবে, সহিংসতা রাজনীতির ভাষা হবে- এটা কাম্য হতে পারে না। দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। শুধু ক্ষমতায় যাওয়া একজন রাজনীতিকের অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে না। অবশ্যই তিনি জনগণের সেবা করার জন্য ক্ষমতায় যাবেন। কিন্তু তা যেন হয় নিয়মতান্ত্রিক, অহিংস ও দৃষ্টান্তমূলক। বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া কিংবা আরও আগের মওলানা ভাসানী আমাদের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাসানী ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি। আজীবন প্রতিবাদী এ মওলানা আমাদের দেখিয়ে গেছেন, ক্ষমতায় না গিয়েও জনমানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।
আজ আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে নির্বাচন করলে তা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তার ব্যর্থতা, তিনি সেই আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে পারেননি। তাই এ ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে না। একজন মনমোহন সিং এ দেশে জন্মগ্রহণ করেননি। ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের এখানে বেমানান। একজন টি এন সেশন (ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার) এ দেশে নেই। ভারতের সংবিধান একজন নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাচনকালীন অথবা প্রাক-নির্বাচনকালীন যে ক্ষমতা দিয়েছে, আমাদের সংবিধান আমাদের সেই ক্ষমতা দেয়নি। আমাদের সিইসি কিংবা ইসিদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে না যে, তারা ভবিষ্যতে সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে, এ দেশে একজন সেশন তৈরি হলেন না, যিনি ক্ষমতাসীন মন্ত্রীকে জেলে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করেননি!
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি নিজে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হবেন না বলে ঘোষণা দিন। তার এই ঘোষণা তার জনপ্রিয়তাকে অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে। ক্ষমতা ধরে রেখে বিতর্ক কামানোর চেয়ে একটা আস্থার সম্পর্ক তিনি যদি গড়ে তুলতে পারেন, সেটা হবে তার জন্য বড় প্রাপ্তি। বেগম জিয়াকে ফোন করে তিনি উদার মনের পচিয় দিয়েছেন। এখন সৈয়দ আশরাফকে নির্দেশ দিয়ে সংলাপের সূচনা করলে সেটা তার জনপ্রিয়তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
দৈনিক যুগান্তর, ২ অক্টোবর, ২০১৩।
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahman09@gmail.com
- See more at: http://jugantor.com/sub-editorial/2013/11/01/38575#sthash.rSu07mxM.dpuf

0 comments:

Post a Comment