রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দোষারোপের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন


প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এভাবে : স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে সুষ্ঠুভাবে কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবারই নির্বাচনের সময় কোনও না-কোনও অঘটন ঘটেছে। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করেছে (সমকাল, ১৫ নভেম্বর)। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমরা ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন করি এবং বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে দেশকে পিছিয়ে দেয় (ওই)। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর বাগেরহাটে এক নির্বাচনি জনসভায় তিনি বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী দল। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সোজা-সাপটা। তিনি রেখে-ঢেকে কথা বলেন না, যা বলেন তা স্পষ্ট করেই বলেন। সাম্প্রতিক সময়ের তার প্রতিটি বক্তব্যে বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা আছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক কিংবা তার বক্তব্যের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, আমি সেই বিতর্কে যাব না। কিন্তু আমার কাছে যা প্রাধান্য তা হচ্ছে আমরা যখন এ মুহূর্তে একটি সমাধান আশা করছি, তখন দোষারোপের এই রাজনীতি সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনও সাহায্য করবে কি না! এদিকে বেগম জিয়াও জানিয়ে দিয়েছেন, নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে তিনি কোনও আপস করবেন না। এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার। সংকটের গভীরতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না।
এদিকে সরকার জোরেশোরেই নির্বাচনিপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মাঝে একধরনের
নির্বাচনি উত্সব বিরাজ করছে। সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই অনেকের নাম-ধাম ছাপা হচ্ছে, যারা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। অথচ এর বাইরে অন্য কোনও দলের কোনও নির্বাচনি তত্পরতা নেই। সরকার কোনও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এটা আমি বলব না। তবে সংবিধান তার পক্ষে। বর্তমান সংবিধান যে অবস্থায় আছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থান খুব ভালো, এটা আমি বলব না। বাজার উত্তপ্ত। পেঁয়াজের মূল্য কমেনি। চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষক প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না এ ধরনের অভিযোগ আছে। এটি দেখার ও মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এতে সরকারের কৃতিত্ব নেই। এর কৃতিত্ব প্রবাসী বাংলাদেশিদের। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের তাণ্ডব এসব ঘটনা সরকারের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটল তার ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই দিন না কেন, বিদেশে এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে কোনও দুর্নীতি হয়নি এ ধরনের বক্তব্য কী সত্যের অপলাপ নয়? যদি আদৌ কিছু না হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাংক কেন কঠোর হল, কেন তদন্ত করল, কেনই বা কানাডায় মামলা হল? আমরা তা অস্বীকার করতেই পারি। বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। প্রধানমন্ত্রী তার এক ভাষণে হলমার্ক-ডেসটিনির অনিয়মের কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করে, যারাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। একজন ব্যাংক উপমহাব্যবস্থাপকের পক্ষে হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রভাবশালী যারাই নেপথ্যে থেকে এ কাজটি করেছেন, তাদের শাস্তি হোক। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বিদেশের গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বলেন। কিন্তু ইউরোপের কোনও গণতান্ত্রিক সমাজে কী এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারেন? ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রীকে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় ফাইন দিতে হয়েছিল। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর (তিনবার প্রধানমন্ত্রী) হেলমুট কোহল ঘুষগ্রহণ করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় দলের কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে কি এ ধরনের ঘটনা চিন্তা করতে পারি? প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, মাগুরার উপনির্বাচনের কথা বলেন। এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভোলায় উপনির্বাচনে কী হয়েছিল, তার সাক্ষী সংবাদপত্রগুলো। আসলে এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন, যা আমরা পারছি না। প্রধানমন্ত্রী অতীতে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে দু-একজনের যোগসাজশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওই ব্যক্তিরা যদি সত্যি-সত্যিই জড়িত থাকেন, তাহলে সরকার তাদের গ্রেপ্তার করছে না কেন? একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই রিপোর্টে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের কি আইনের আওতায় আনা হয়েছিল? আর যদি আইনের আওতায় আনা না হয়, তাহলে আমরা বিদেশের গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দিতে পারব না। বিদেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবেই নির্বাচন হবে এটা বাংলাদেশে আমরা চিন্তা করতে পারি না। কেননা বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার সঙ্গে কি আমরা বিদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনও মিল খুঁজে পাব? আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা পৃথিবীর কোনও সংবিধানে এভাবে দেওয়া হয়নি। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা মুখ্য। আমি জানি না প্রধানমন্ত্রী এটা স্বীকার করলেন কি না যে, বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। সমঝোতা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সমঝোতা একটি কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত হয়েছে। আর দশম নির্বাচন ঘিরে যদি কোনও সমঝোতা না হয়, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই আরেকটি ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রত্যক্ষ করব! সরকার এককভাবেই নির্বাচন করবে, যা সংকটকে আরও গভীরতর করবে।

সংসদে কিংবা বিভিন্ন জনসভায় বিরোধী দলনেতা যে বক্তব্য রাখেন, সে ব্যাপারেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেগম জিয়া সংবিধানে নির্দলীয় সরকার বিধান সংযোজন করা, সংলাপ আহ্বান করা, ড. ইউনূসকে অসম্মানিত করা, জাতীয় নেতাদের সম্মান দেওয়া, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। বাজেট নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, উচ্চ সুদের হার, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহে ঘাটতি, চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগ-পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে হেফাজতে ইসলামের প্রসঙ্গও টেনেছেন। তুলনামূলক বিচারে বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনা যতটা আক্রমণাত্মক থাকেন, বেগম জিয়া অতটা আক্রমণাত্মক নন। কিন্তু আমরা যারা আমজনতা, আমাদের কাছে সংসদ নেত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কোনও সমাধান বা দিক নির্দেশনার পথ আমরা খুঁজে পাইনি। আগামীতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব সমস্যার সম্মুখীন আমরা হব, তার সমাধান কীভাবে হবে, তার কোনও দিকনির্দেশনা নেই। সরকার যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে, বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সেই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। অর্থমন্ত্রীর মুখের কথায় প্রবৃদ্ধির টার্গেট অর্জিত হবে না। এর জন্য দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা, শিল্পোত্পাদন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যার কোনও একটিও এ মুহূর্তে নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশিদের এক ধরনের
হস্তক্ষেপ বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমাদের যে অর্জন, সেই অর্জন নষ্ট হতে চলেছে শুধু একটি সমঝোতার অভাবে। সরকারি দল ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের কাছে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে। কারা-কারা প্রার্থী হতে চাচ্ছেন, তার একটি তালিকাও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ভাবখানা এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে একবার হলেও সংসদে যেতে চাই। সরকারি দল বাদে অন্য কোনও দলের কোনও তত্পরতা নেই। জাতীয় পার্টি অবশ্য নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে। দলটি মনোনয়ন ফরমও বিক্রি করছে। কিন্তু এ নিয়ে দলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে।

এটা এখন স্পষ্ট
বিদেশি দাতারা যা-ই বলুক, নিশা দেশাই ঢাকায় এসে যে কথাই বলে যান না কেন, একটি নির্বাচন হবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে। আর বিএনপি তথা ১৮ দল যত কথাই বলুক, তারা ওই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। নির্বাচন হবে। ১৮ দল নির্বাচন বয়কট করবে। সরকারকে ‘সহযোগিতা’ করার জন্য দল বা লোকের অভাব হবে না। আমরা ১৯৮৬ সালের পুনরাবৃত্তিই দেখতে পাব আরেকবার। কিন্তু তারপর কী? দেশ কী এভাবেই চলবে? সমঝোতার জন্য কোনও সংলাপ বা আলোচনা কি হবে না?

ইতিমধ্যে একটি নির্বাচনকালীন সরকার যাত্রা করেছে। তবে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হচ্ছে, এ নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে আলোচনা হবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। ওই আলোচনায় বিএনপি যোগ দেবে এবং একটি নির্বাচনকালীন সরকারের আওতায় বাংলাদেশে একাদশতম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর আগে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান কাঠামোয়। প্রধানমন্ত্রী আবারও ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর ওই সরকার ক্ষমতায় থাকবে ন্যূনতম দুই বছর।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের এক ধরনের স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম এবং নবম সংসদ নির্বাচন বিতর্কমুক্ত ছিল। বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। এখন আমরা আবার সেই পুরনো বৃত্তে ফিরে গেলাম। একপক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা, ব্যক্তি প্রতিহিংসা, ক্ষমতা ধরে রাখার নানা অপকৌশল, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সহিংসতার আশ্রয়, বাংলাদেশের রাজনীতির এই যে চিত্র, এই চিত্র বদলে দিতে না পারলে এ জাতির ভবিষ্যত্ অন্ধকার। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটির একটি সম্ভাবনা আছে। এখন এ দেশের রাজনীতিবিদদেরই সে সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমরা চাই আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের স্থিতিশীলতা উপহার দেবেন। এ জাতি তো বারবার তাদের দিকেই তাকিয়েছে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনটা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন দোষারোপের রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া। তা হলেই দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

0 comments:

Post a Comment