প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনি এলাকার জন্য মনোনয়নপত্র ক্রয়
করেছেন। গোপালগঞ্জ-৩ তার নির্বাচনি এলাকা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে
রেখে আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে। আর এই প্রক্রিয়ার অংশ
হিসেবেই তিনি মনোনয়নপত্র ক্রয় করলেন। এর অর্থ হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ
নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে, তা হচ্ছে ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে? অর্থাত্
প্রধান রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে যে-নির্বাচনি ইতিহাস এ দেশে রয়েছে, তারই কি
পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে? ১৯৮৬, ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর কী এ
দেশের মানুষ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি নির্বাচন দেখতে চাচ্ছে, যেখানে
মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দলের কোনও অংশগ্রহণ থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা যখন তার নিজ এলাকার জন্য মনোনয়নপত্র ক্রয় করলেন, তখন বেগম জিয়া ওই
নির্বাচন ‘বন্ধ’ করার হুমকি দিয়েছেন। ৮৪ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল পালিত হচ্ছে।
আর ৩ জন শীর্ষস্থানীয় বিএনপিনেতা এখন কারাগারে। মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার
আর ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। সেই সঙ্গে আছেন আরও দুজন— বেগম জিয়ার
উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বেগম জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস। এই
গ্রেফতারের অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে সব ছাপিয়ে যে বিষয়টি প্রাধান্য
পাবে, তা হচ্ছে এই গ্রেফতার ‘মৃত্যু’ ঘটিয়েছে সব ধরনের সমঝোতার। একটি
সম্ভাব্য ‘সংলাপ’ এখন হিমাগারে। সংলাপের সম্ভাবনা এখন আর নেই। ‘রাজনীতি’
এখন নির্ধারিত হবে রাজপথে!
ইতিহাস প্রমাণ করেছে, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে যে ‘নির্বাচন’, সেই ‘নির্বাচনের’ কোনও গ্রহণযোগ্যতা থাকে না এবং ওই সংসদও স্থায়ী হয় না। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ তার ক্ষমতা দখলকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (তৃতীয়) আয়োজন করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু নেয়নি বিএনপি। ১৯৮৮ সালে আরেকটি নির্বাচন (চতুর্থ) হয়েছিল। তাতে অংশ নেয়নি প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এরশাদ একটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। তাকে চলে যেতে হয়েছিল। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালে (ষষ্ঠ) সংসদ নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু ওই সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। এখন একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বটে, কিন্তু এই সংসদের পরিণতিও হবে ঠিক আগের ৩টির মতো! ইতিহাস এভাবেই লিখিত হয়।
এটি এক রকম নিশ্চিত যে, বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি সর্বদলীয় সরকার হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এই নভেম্বরেই সেই সরকার গঠিত হবে। কিন্তু এই সর্বদলীয় সরকার কি রাজনৈতিক সমস্যার কোনও সমাধান দিতে পারবে? কিংবা বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে সরকার কিংবা নির্বাচন, তার কি কোনও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে? অনেক প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা এখন জনমানসে। হরতাল হচ্ছে। সহিংসতা বাড়ছে। অনেক ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমি হয়েছি। কিন্তু এর কোনও স্পষ্ট জবাব আমার জানা নেই। আমি জানি না। তবে এটি ঠিক বিএনপি প্রধান বিরোধী দল। বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারকে সর্বদলীয় সরকার বলা যাবে না। এটি স্বীকার করতেই হবে, সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল সরকারের বাইরে থাকলে, সর্বদলীয় সরকার পূর্ণতা পাবে না। এমনকী সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধানের কথা বলা হয়। এর মধ্যে কোনও অসত্য নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সর্বদলীয় সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ? সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কিছুটা ছাড় দিয়ে যখন সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন, তখন এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে কোন নীতিমালার ভিত্তিতে সরকারপ্রধান এই সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন? যাদের নাম মন্ত্রিসভায় থাকবে বলে পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, তারা তো সবাই মহাজোটের শরিক। শরিক হিসেবে আগেও কেউ-কেউ মন্ত্রিসভায় ছিলেন। সর্বদলীয় সরকারে ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা জাসদের বাইরে অন্য কোনও দল যদি যোগ দেয়, তার ভিত্তিই বা কী? এই তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারকে কী মহাজোটের খুদে সংস্করণ হয়ে যাবে না? ঘুরেফিরে তো মহাজোটের শরিকরাই থাকছেন। পরিবর্তনটা এল কোথায়? বলার অপেক্ষা রাখে না— এরশাদের জাতীয় পার্টি হবে ‘তুরুপের তাস’। জাতীয় পার্টি কী করবে? সরকারে যোগ দেবে? বিরোধী দলে থাকবে? আমরা যদি এরশাদের কথাকে সঠিকভাবে ধরে নিই, তাহলে তো তার নির্বাচনে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু এরশাদ বলে কথা! তার জেলে যাওয়ার ভয় এখনও আছে। দলের ভেতরে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার ভাগিদারের সংখ্যা একেবারে কম নেই। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। তার একটি সিদ্ধান্তই তাকে ইতিহাসে স্থান করে দেবে— আর সেই স্থানটা কলঙ্কজনকও হতে পারে, আবার গৌরবোজ্জ্বলও হতে পারে। নির্বাচন ও সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের প্রশ্নে তার দল যদি আবারও ভেঙে যায়, আমি অবাক হব না। ইতিহাসের এক কঠিন সময় আমরা পার করছি। রাজনৈতিক বৈরিতা, আস্থাহীনতা আজ চরমপর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এর জন্য আমরা কাদের দায়ী করব? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে জন্ম আমরা দিয়েছিলাম, যা বিশ্বে প্রশংসিতও হয়েছিল, তা আজ ভেস্তে যেতে বসেছে। অন্যপক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা আজ চরমে। দুই নেত্রী কথা বললেন। তাদের সেই ফোনালাপ সমঝোতার চেয়ে তিক্ততারই জন্ম দিয়েছে বেশি। সেই ফোনালাপ মিডিয়ায় প্রচার করতে দিয়ে কে সুবিধা নিল, এটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা যা, তা হচ্ছে— বিদেশিদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে।
আমরা কেউই হরতাল চাই না। কিন্তু সমঝোতা না হলে কি হরতাল বন্ধ হবে? হরতালে বিএনপির শীর্ষনেতারা মাঠে থাকবেন না। হরতালের সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে বোমাবাজরা। এই বোমাবাজদের নিষ্ক্রিয় করবে কে? এই বোমাবাজরা অদৃশ্য এক শক্তি হয়ে উঠেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এরা কোনও দল করে না। কোনও দলীয় মতাদর্শেও এরা বিশ্বাসী নয়। এরা সুযোগসন্ধানী। সুযোগকে এরা কাজে লাগায়। সর্বদলীয় সরকার কোনও সমাধান নয়। বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়াটা জরুরি। এর মধ্যেই প্রমাণিত হবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এটি যে একেবারেই সম্ভব নয়, তা আমি মনে করি না। সম্ভব। অতীত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসার ব্যাপারে (দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী) বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সেদিন এক হয়েছিল। বিএনপি সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় আস্থাশীল ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের আনা প্রস্তাবে নির্বাচিত হয়েও বিএনপি সেদিন সায় দিয়েছিল। যদিও তার পরের ইতিহাস কারও জন্যই কোনও মঙ্গল ডেকে আনেনি। সংসদ বর্জনের রাজনীতি শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই। তাই আরেকটি সমঝোতা যে সম্ভব নয়, তা আমি মনে করি না। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করার মানসিকতা।
সর্বদলীয় সরকার হোক বা না হোক, একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। আর তা যে শুধু দশম জাতীয় সংসদের জন্য প্রযোজ্য হবে, তেমনটি নয়। বরং আমাদের রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এর একটি স্থায়ী ভিত্তি দেওয়াও জরুরি।
রাজনীতিতে বৈরিতা থাকবেই। এই বৈরিতাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলকে বলা হয় সরকারেরই একটি অংশ। ব্রিটেনে বিরোধী দলকে ‘এড্রেস’ই করা হয় ‘হার মেজেসট্রিস অপজিশন’ হিসেবে। এটি ধরাই হয়, বিরোধী দল সংসদে না থাকলে সেই সংসদ পূর্ণতা পায় না। রাষ্ট্রীয় কাজে সঠিক নীতিটি প্রণীত হয় না। সরকার হয়ে পড়ে স্বৈরতান্ত্রিক। এ ধরনের মূল্যায়নকে অস্বীকার করা যাবে না। এটিই বাস্তব। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার নিজেই চাচ্ছে একটি একদলীয় নির্বাচন। সরকার এটি করতে পারবে বটে, কিন্তু বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে বাংলাদেশকে। মামলা আর গ্রেফতার করে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে বলেও মনে হয় না। গ্রেফতারের ভয়ে তারা হরতাল ডেকেও মাঠে থাকেন না, এটি সত্য। কিন্তু তাতে করে হরতাল ভণ্ডুল হয়ে যায়নি। হরতাল পালিত হয়েছে। দীর্ঘ ৮৪ ঘণ্টা হরতাল— সঙ্গত কারণেই প্রশ্নটি উঠবে এর শেষ কোথায়? সংবিধান একটি নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তাকে বাধ্যতামূলক করেছে বটে, কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। প্রয়োজন দূরদর্শিতার— প্রয়োজন বাস্তবমুখী একটি পদক্ষেপের। লাগাতার হরতাল যেমনটি কোনও সমাধান বয়ে আনবে না, ঠিক তেমনি একটি ‘একদলীয়’ নির্বাচনও বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কোনও ফল বয়ে আনবে না। শীর্ষ বিএনপিনেতাদের ছেড়ে দিয়ে সরকার তার আন্তরিকতার প্রমাণ দেখাতে পারে। এখনও একটি সুযোগ আছে সমঝোতায় যাওয়ার। উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। আমরা চাই না ১৯৮৬, ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটুক। ইতিহাসের চাকা আমরা পেছনে ঠেলতে চাই না। সামনে ঠেলতে চাই। সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, প্রত্যাশা এটিই।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে যে ‘নির্বাচন’, সেই ‘নির্বাচনের’ কোনও গ্রহণযোগ্যতা থাকে না এবং ওই সংসদও স্থায়ী হয় না। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ তার ক্ষমতা দখলকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (তৃতীয়) আয়োজন করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু নেয়নি বিএনপি। ১৯৮৮ সালে আরেকটি নির্বাচন (চতুর্থ) হয়েছিল। তাতে অংশ নেয়নি প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এরশাদ একটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। তাকে চলে যেতে হয়েছিল। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালে (ষষ্ঠ) সংসদ নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু ওই সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। এখন একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বটে, কিন্তু এই সংসদের পরিণতিও হবে ঠিক আগের ৩টির মতো! ইতিহাস এভাবেই লিখিত হয়।
এটি এক রকম নিশ্চিত যে, বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি সর্বদলীয় সরকার হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এই নভেম্বরেই সেই সরকার গঠিত হবে। কিন্তু এই সর্বদলীয় সরকার কি রাজনৈতিক সমস্যার কোনও সমাধান দিতে পারবে? কিংবা বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে সরকার কিংবা নির্বাচন, তার কি কোনও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে? অনেক প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা এখন জনমানসে। হরতাল হচ্ছে। সহিংসতা বাড়ছে। অনেক ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমি হয়েছি। কিন্তু এর কোনও স্পষ্ট জবাব আমার জানা নেই। আমি জানি না। তবে এটি ঠিক বিএনপি প্রধান বিরোধী দল। বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারকে সর্বদলীয় সরকার বলা যাবে না। এটি স্বীকার করতেই হবে, সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল সরকারের বাইরে থাকলে, সর্বদলীয় সরকার পূর্ণতা পাবে না। এমনকী সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধানের কথা বলা হয়। এর মধ্যে কোনও অসত্য নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সর্বদলীয় সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ? সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কিছুটা ছাড় দিয়ে যখন সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন, তখন এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে কোন নীতিমালার ভিত্তিতে সরকারপ্রধান এই সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন? যাদের নাম মন্ত্রিসভায় থাকবে বলে পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, তারা তো সবাই মহাজোটের শরিক। শরিক হিসেবে আগেও কেউ-কেউ মন্ত্রিসভায় ছিলেন। সর্বদলীয় সরকারে ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা জাসদের বাইরে অন্য কোনও দল যদি যোগ দেয়, তার ভিত্তিই বা কী? এই তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারকে কী মহাজোটের খুদে সংস্করণ হয়ে যাবে না? ঘুরেফিরে তো মহাজোটের শরিকরাই থাকছেন। পরিবর্তনটা এল কোথায়? বলার অপেক্ষা রাখে না— এরশাদের জাতীয় পার্টি হবে ‘তুরুপের তাস’। জাতীয় পার্টি কী করবে? সরকারে যোগ দেবে? বিরোধী দলে থাকবে? আমরা যদি এরশাদের কথাকে সঠিকভাবে ধরে নিই, তাহলে তো তার নির্বাচনে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু এরশাদ বলে কথা! তার জেলে যাওয়ার ভয় এখনও আছে। দলের ভেতরে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার ভাগিদারের সংখ্যা একেবারে কম নেই। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। তার একটি সিদ্ধান্তই তাকে ইতিহাসে স্থান করে দেবে— আর সেই স্থানটা কলঙ্কজনকও হতে পারে, আবার গৌরবোজ্জ্বলও হতে পারে। নির্বাচন ও সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের প্রশ্নে তার দল যদি আবারও ভেঙে যায়, আমি অবাক হব না। ইতিহাসের এক কঠিন সময় আমরা পার করছি। রাজনৈতিক বৈরিতা, আস্থাহীনতা আজ চরমপর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এর জন্য আমরা কাদের দায়ী করব? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে জন্ম আমরা দিয়েছিলাম, যা বিশ্বে প্রশংসিতও হয়েছিল, তা আজ ভেস্তে যেতে বসেছে। অন্যপক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা আজ চরমে। দুই নেত্রী কথা বললেন। তাদের সেই ফোনালাপ সমঝোতার চেয়ে তিক্ততারই জন্ম দিয়েছে বেশি। সেই ফোনালাপ মিডিয়ায় প্রচার করতে দিয়ে কে সুবিধা নিল, এটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা যা, তা হচ্ছে— বিদেশিদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে।
আমরা কেউই হরতাল চাই না। কিন্তু সমঝোতা না হলে কি হরতাল বন্ধ হবে? হরতালে বিএনপির শীর্ষনেতারা মাঠে থাকবেন না। হরতালের সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে বোমাবাজরা। এই বোমাবাজদের নিষ্ক্রিয় করবে কে? এই বোমাবাজরা অদৃশ্য এক শক্তি হয়ে উঠেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এরা কোনও দল করে না। কোনও দলীয় মতাদর্শেও এরা বিশ্বাসী নয়। এরা সুযোগসন্ধানী। সুযোগকে এরা কাজে লাগায়। সর্বদলীয় সরকার কোনও সমাধান নয়। বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়াটা জরুরি। এর মধ্যেই প্রমাণিত হবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এটি যে একেবারেই সম্ভব নয়, তা আমি মনে করি না। সম্ভব। অতীত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসার ব্যাপারে (দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী) বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সেদিন এক হয়েছিল। বিএনপি সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় আস্থাশীল ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের আনা প্রস্তাবে নির্বাচিত হয়েও বিএনপি সেদিন সায় দিয়েছিল। যদিও তার পরের ইতিহাস কারও জন্যই কোনও মঙ্গল ডেকে আনেনি। সংসদ বর্জনের রাজনীতি শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই। তাই আরেকটি সমঝোতা যে সম্ভব নয়, তা আমি মনে করি না। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করার মানসিকতা।
সর্বদলীয় সরকার হোক বা না হোক, একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। আর তা যে শুধু দশম জাতীয় সংসদের জন্য প্রযোজ্য হবে, তেমনটি নয়। বরং আমাদের রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এর একটি স্থায়ী ভিত্তি দেওয়াও জরুরি।
রাজনীতিতে বৈরিতা থাকবেই। এই বৈরিতাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলকে বলা হয় সরকারেরই একটি অংশ। ব্রিটেনে বিরোধী দলকে ‘এড্রেস’ই করা হয় ‘হার মেজেসট্রিস অপজিশন’ হিসেবে। এটি ধরাই হয়, বিরোধী দল সংসদে না থাকলে সেই সংসদ পূর্ণতা পায় না। রাষ্ট্রীয় কাজে সঠিক নীতিটি প্রণীত হয় না। সরকার হয়ে পড়ে স্বৈরতান্ত্রিক। এ ধরনের মূল্যায়নকে অস্বীকার করা যাবে না। এটিই বাস্তব। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার নিজেই চাচ্ছে একটি একদলীয় নির্বাচন। সরকার এটি করতে পারবে বটে, কিন্তু বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে বাংলাদেশকে। মামলা আর গ্রেফতার করে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে বলেও মনে হয় না। গ্রেফতারের ভয়ে তারা হরতাল ডেকেও মাঠে থাকেন না, এটি সত্য। কিন্তু তাতে করে হরতাল ভণ্ডুল হয়ে যায়নি। হরতাল পালিত হয়েছে। দীর্ঘ ৮৪ ঘণ্টা হরতাল— সঙ্গত কারণেই প্রশ্নটি উঠবে এর শেষ কোথায়? সংবিধান একটি নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তাকে বাধ্যতামূলক করেছে বটে, কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। প্রয়োজন দূরদর্শিতার— প্রয়োজন বাস্তবমুখী একটি পদক্ষেপের। লাগাতার হরতাল যেমনটি কোনও সমাধান বয়ে আনবে না, ঠিক তেমনি একটি ‘একদলীয়’ নির্বাচনও বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কোনও ফল বয়ে আনবে না। শীর্ষ বিএনপিনেতাদের ছেড়ে দিয়ে সরকার তার আন্তরিকতার প্রমাণ দেখাতে পারে। এখনও একটি সুযোগ আছে সমঝোতায় যাওয়ার। উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। আমরা চাই না ১৯৮৬, ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটুক। ইতিহাসের চাকা আমরা পেছনে ঠেলতে চাই না। সামনে ঠেলতে চাই। সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, প্রত্যাশা এটিই।
দৈনিক আমাদের সময়, ১২ নভেম্বর ২০১৩।
0 comments:
Post a Comment