রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান

সাম্প্রতিক সময়ে রুশ-মার্কিন সমঝোতা সিরিয়ায় একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনলেও সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান একটি বড় ধরনের সংবাদের জন্ম দিয়েছে। সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান এখন আলোচনার একটি বিষয়। কোনো কোনো অনলাইন সংবাদপত্রে [ফ্রন্টপেজ ম্যাগ (২০ সেপ্টেম্বর)] এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বাহ্যতা আল কায়দাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছেন! সম্প্রতি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছে। পত্রিকাট আইএইচএস জেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদৃব্দতি দিয়ে বলছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ) সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে লন্ডনের জেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি কোনো অপরিচিত নাম নয়। জেনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিসটার। লিসটার তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নয়। তারা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে তার একটা বড় অংশ চলে গেছে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর কাছে। এখন এমন ধারণাও পোষণ করা হচ্ছে যে, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে, তাহলে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার চলে যাবে এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের কাছে, যাদের প্রায় সবাই আল কায়দার সঙ্গে জড়িত। সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে খোদ ওবামা প্রশাসনও উৎকণ্ঠিত। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে সিনেটের এক শুনানিতে (হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) টম জোসেলিনও এ ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যারা নিয়মিত সিরিয়ার ঘটনাবলি মনিটরিং করেন তাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, কিছুদিন আগে ইসলামী জঙ্গিরা আলেপ্পো শহরের কাছাকাছি আস সাদ্দাদি (লোকসংখ্যা ৭০ হাজার) শহরটি দখল করে নিয়েছিল।
জেনের গবেষণা প্রতিবেদনে যে উদ্বেগজনক দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা \'যুদ্ধ\' করছে, তাদের মাঝে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ ও লিবারেশনপন্থি। বাকি সবাই বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। যদিও এ ধরনের সংবাদের সত্যতা যাচাই করা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, গবেষণা নিবন্ধ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে (?) তাহলে কোন শক্তি সিরিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে?
সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্রুপগুলো কোনো একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না। তারা বিভিন্ন গ্রুপ, উপগ্রুপে বিভক্ত। এককভাবে কোনো বিরোধী দল বা গ্রুপ নেই, যারা আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় সরকার গঠন করতে পারে। এক সময় সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই কাউন্সিল এখন বিলুপ্ত। এর পরিবর্তে গঠিত হয়েছে \'ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিরিয়ান রেভলিউশনারি অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস\' (এনসিএসআরও)। এটি গঠিত হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে দোহায়। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আহমেদ জারবা এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ সিরিয়া এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যেখানে সংসদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত হবে। তারা আসাদ সরকারের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনার পক্ষপাতী নয়। তাদের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল তাদের সমর্থন করে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মরক্কোর মারাকাসে আসাদবিরোধীদের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রায় একশ\' দেশ সেখানে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল, তাতে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন করে। সিরিয়ার বামপন্থিরা \'ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি\' ব্যানারে কাজ করে। মোট ১৩টি দল এ ব্যানারে রয়েছে। কুর্দিরাও এ ব্যানারের আওতায় কাজ করে। এর বাইরে রয়েছে ইসলামিক ফোর্সগুলো, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে জাবহাল উল নুসরা। মোট ১২টি ইসলামী জঙ্গি সংগঠন সিরিয়ান ইসলামিক ফ্রন্টের ব্যানারে একত্র হয়েছে। নুসরা ফ্রন্টের বাইরে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, আহরার আল শামের মতো সংগঠনের নাম পাওয়া যায়, যারা আলাদাভাবে ৫ থেকে ৬ হাজার জঙ্গি ইসলামিক সেনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, কোনো কোনো গ্রুপের হাতে প্রায় ২৫ হাজার সেনা পর্যন্ত রয়েছে। যদিও তারা কেউই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নয়। তাদের মূল দর্শন হচ্ছে, সিরিয়াকে একটি ইসলামিক এমিরাতে পরিণত করা। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি মূলত সিরিয়ান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে বিদ্রোহী দলে যোগ দেওয়া সেনাসদস্য ও ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। এই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও আগামী দিনের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র চলে গেছে। এই অস্ত্র আগামী দিনের সিরিয়ার রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এর আগে দুটি দেশে যেখানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন হয়েছে (ইরাক ও লিবিয়া), সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। ইরাকে (২০০৩) মার্কিন আগ্রাসন হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পর একটি সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলামী জঙ্গিরা সেখানে শক্তিশালী হয়েছে, যা সাদ্দামের জমানায় ছিল না। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। লিবিয়াও একই পরিস্থিতি বরণ করেছে। সেখানকার ইসলামিক জঙ্গিরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের হাতেই বেনগাজীর মার্কিন দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছিল এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করেছিল। এখন সিরিয়ার পরিস্থিতিও অনেকটা সে রকম।
গত ২৯ মাস ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সিরিয়ায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত তা মিসরের আন্দোলন দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে ইসলামিক জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। ইসলামী জঙ্গিদের এই উত্থান নিঃসন্দেহে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের \'ডায়লামার\' মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আসাদ-বিরোধিতাকে সার্থক করার অর্থ ইসলামী জঙ্গিদের উত্থানকে সমর্থন করা। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি খুব সুখের হয়নি। এক সময় তালেবানদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল মার্কিনিরা। পরে তালেবানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরতে হয় মার্কিনিদের। সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক। উপরন্তু এ অঞ্চলের পাশাপাশি দেশগুলোতে রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সামরিক ঘাঁটি। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আরব আমিরাত ও সাইপ্রাসে। সুতরাং একটি জঙ্গিগোষ্ঠী যদি সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করে (?), তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেখানে বিকশিত হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সুনি্নদের নেতৃত্বাধীন একটি জোট সেখানে আসাদের বিকল্প হতে পারে। কিন্তু ইরাকের অভিজ্ঞতা সে দেশটির জন্য আদৌ সুখের হয়নি। আপাতত বাশার আল আসাদ রয়ে যাচ্ছেন ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ২০১৪ সালেই সেখানে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আসাদের অংশগ্রহণ না করা (বিনিময়ে আসাদকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি না করা), সিরিয়ার সব রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে দেওয়া (যাতে আসাদ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন)_ এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখেই রাজনীতি এখন আবর্তিত হতে পারে। তবে আসাদ আগামীতে থাকবেন না_ বাস্তবতা বোধকরি এটাই।

টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র
tsrahmanbd@yahoo.com
অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment