রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মিসর কি আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হবে?


মিসর কি আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছে? এই সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে মিসরে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন 'আল গামা আল ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রচারিত একটি বিবৃতির পর। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে যে মিসরকে আরেকটি 'আফগানিস্তান' বানানোর লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে একটি ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। জঙ্গিবাদী আল গামা আল ইসলামিয়ার বিবৃতিটি যখন প্রচারিত হয়, ঠিক তখনই আল-কায়েদার নেতা জওয়াহিরির একটি বিবৃতিও ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে। জাওয়াহিরি মুরসির উৎখাতের পেছনে সেনাবাহিনী, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টান তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। স্পষ্টতই মিসর নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শঙ্কা অনেক। কী হতে যাচ্ছে মিসরে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে ৩ জুলাই সেনাবাহিনী মুরসিকে উৎখাত করার পর এখন পর্যন্ত সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এরই মধ্যে কায়রো সফর করেছেন মার্কিন দূত উইলিয়াম বার্নস, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনার এসটন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, লেডি এসটন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে বাস্তবতা ও নয়া প্রেসিডেন্টকে মেনে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুরসি এতে রাজি হননি। মুরসির সমর্থকরা কায়রোর একটি মসজিদ দখল করে সেখানে অবস্থান করছেন। প্রতি শুক্রবার তারা বড় বিক্ষোভের আয়োজন করেন। এদিকে নয়া সরকারের পক্ষে জনসমর্থনও বাড়ছে। তারাও সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিক্ষোভ করছে। সুতরাং মিসর নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। নয়া সরকার ২০১৪ সালে একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, এর আগে সংবিধান সংশোধনসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একটি সাংবিধানিক পরিষদও গঠন করা হয়েছে, যারা সংবিধান সংশোধন করবে। একটি সমঝোতার উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতার উদ্যোক্তা। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান মিসরের সমাজে যে বিভক্তি ডেকে এনেছে, তা অপসারিত হবে কীভাবে? একদিকে ইসলামপন্থী, অন্যদিকে সেক্যুলারপন্থী, যাদের সঙ্গে মিলেছে লিবারেল ও ডেমোক্রেটরা। এই পরস্পরবিরোধী দুই শক্তির মাঝে দ্বন্দ্বের অবসান আদৌ হবে কি?
মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ সপ্তাহ অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পর যে প্রসঙ্গটি এখন উঠেছে তা হচ্ছে মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় 'রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি' তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে মিসরের সেনাবাহিনী গত ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে করে রাষ্ট্রটি সামরিক বাহিনী নির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশের অলিখিতভাবে 'ছায়া রাষ্ট্রপতি' আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ 'কিচেন ক্যাবিনেট' হিসেবে কাজ করে। এটা তখনো ছিল। এখনো আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ও জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি। মুরসির শাসনামলে যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুলাই মাত্র দুই বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এ দুই বছরে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার 'বিচার' এবং ১৫ দিনের 'জেল' হয়েছে। স্পষ্টই বলা যায় জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি হতে পারেন মিসরের পরবর্তী 'নেতা'। ইতিহাস বলে, মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই লালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জেনারেল এল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র‌্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। উভয় ক্ষেত্রেই লিবারেশন র‌্যালি ও ন্যাশনাল ইউনিয়ন একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে সাদাত একে ভেঙে গঠন করেছিলেন 'নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। সুতরাং জেনারেল সিসি যে ক্ষমতা একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না। তাহলে কোন পথে যাচ্ছে মিসর? মিসর থেকে যেসব খবর আসছে তা কোনো আশার কথা বলছে না। মুরসির পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি জনমত রয়েছে। মুরসির সমর্থক 'মুসলিম ব্রাদারহুড' লাখ লাখ লোকের জমায়েত করলে সেনাবাহিনী তাতে গুলি চালায়। এতে মারা যায় ১৫২ জন মানুষ। এতে করে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে_ সেনাবাহিনী কোনোমতেই আর মুরসিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে না। যদিও মুরসির সমর্থকদের দাবি এটাই। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। সেনাবাহিনী কি এককভাবে কোনো একটি দল গঠন কিংবা পুনর্গঠন করে নিজেরা ক্ষমতা পরিচালনা করবে, যেমনটি করেছিলেন আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারক?
ক্ল্যাসিকাল সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী যা করে, তা-ই করেছে মিসরের সেনাবাহিনী। হাজেম এল বেবলাওইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিন্তু তার এই নিযুক্তি কিংবা মন্ত্রিসভায় যোগদানে মুসলিম ব্রাদারহুডের আপত্তি মিসরের এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে। মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। তখন তারা একে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বলতেও রাজি ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন কোনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে না। তাই তারা একে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত না করে পরোক্ষভাবে সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। এটা তাদের রাজনীতির একটা বৈপরিত্য। আসলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন নীতি সমালোচিত হচ্ছে। মিসরের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি।
মূলত এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মিসরে এমন একটি সরকার দরকার, যে সরকার ইসরাইলের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে। মুরসি তাদের জন্য একটা সমস্যা ছিলেন। তাই তাকে চলে যেতে হলো। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের জন্য চারটি এফ-১৬ বিমান সরবরাহ স্থগিত করেছে। এটা লোক দেখানো। এতে করে মিসরের ব্যাপারে তাদের স্ট্রাটেজিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দেয়। এতেও কোনো হেরফের হবে না।
মুরসির ব্যর্থতা আছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে মিসরের সমাজ, সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। মিসরের জনগণ সামরিকতন্ত্রেই অভ্যস্ত। ইসলামী শক্তিগুলো বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আন নুর পার্টির জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা ও দেশ শাসন এক নয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যের তাতে মুরসি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ব্যর্থতাই সামরিক বাহিনীকে সামনে নিয়ে এলো। ভুলে গেলে চলবে না, মিসরের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী জড়িত। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন, বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহ, রিয়েল এস্টেট_ এ ধরনের অনেক ব্যবসার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িত। সুতরাং এই 'শক্তিকে' অস্বীকার করা যাবে না। এটা ঠিক, মুসলিম ব্রাদারহুডের সমাজে একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবই মুরসিকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। তিনি 'রিয়েল পলিটিকস'-এর স্পিরিট অনুসরণ করেননি। এটা সত্য, ইসলামী শক্তিগুলো এখনো সেনা সমর্থনকারী শক্তিকে সমর্থন করেনি। এখনো তারা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এতে করে সরকারের পতন ঘটবে না।
মিসর একটা সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল যে সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হবে। দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনে আক্রান্ত যে দেশ, সে দেশে সত্যিকার অর্থেই একটি সাচ্ছা গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করবে_ এমন সম্ভাবনা দেখেছিলেন পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই। কিন্তু এখন দেখা গেল মিসর সেই পুরনো বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। সামরিক বাহিনী ছিল 'ঘুমন্ত বাঘ', সেই বাঘ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জেনারেল নাগিব, কর্নেল নাসের, আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারকের মতো জেনারেল সিসি নাম লেখাতে যাচ্ছেন। এটা স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে আলোচনা হচ্ছে, তার সুর একটাই_ বর্তমান সরকারকে মেনে নিয়ে নির্বাচনে আসা। ব্রাদারহুড এটা করবে বলে মনে হয় না। মিসরের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র নয়, বরং জয়ী হলো সামরিকতন্ত্র। 'আরব বসন্ত'-এর জন্য এটা একটা বড় ধরনের ধাক্কা। মিসরে সামরিকতন্ত্র যদি বিজয়ী হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে তিউনিসিয়া ও ইয়েমেনেও। ভয়টা এখানেই।
যায়যায়দিন ০৭.০৯.২০১৩

0 comments:

Post a Comment