রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ওবামা এখন কী করবেন

সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র হামলা প্রমাণিত হওয়ার পর ওয়াশিংটনে আইন প্রণেতাদের মধ্যে একটা কথা উঠেছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মাধ্যমে বিচার করা উচিত। আর এর মাধ্যমেই সিরিয়ায় সম্ভাব্য একটি 'যুদ্ধ' এড়ানো সম্ভব। এরই মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সিরিয়ার অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র হামলাকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকেই জানেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য ২০০২ সালে রোম চুক্তি অনুযায়ী এই অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি এরই মধ্যে বসনিয়া, লাইবেরিয়া কিংবা কঙ্গো ও রুয়ান্ডা-বুরুন্ডির গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো বিচার সম্পন্ন হয়েছে ও কোনো কোনো বিচার সমাপ্তির পথে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও এই বিচারপ্রক্রিয়া থেকে বাদ যাচ্ছেন না। গত সপ্তাহে হেগে আইসিসির আদালতে কেনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোকে হাজির করা হয়েছিল। তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন কেনিয়ায় ২০০৮ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে ব্যাপক হত্যা তথা গণহত্যা চালানোর জন্য। একই অভিযোগে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তাও অভিযুক্ত। তাঁর বিচার হবে জানুয়ারিতে। এখন সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে (যাতে প্রায় ১৪০০ ব্যক্তি মারা গিয়েছিল) আসাদের বিচার হতে পারে! তবে বিষয়টি খুব সহজ হবে না। কেননা জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে সিরিয়ায় সারিন গ্যাস ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্ত কমিটি সরাসরি বলেনি, এর জন্য সিরীয় সরকারই দায়ী। একই সঙ্গে জাতিসংঘে রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমাণসহ বিদ্রোহী বাহিনীর গ্যাস ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন। ফলে জাতিসংঘে বিষয়টি নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখানে একটি জিনিস স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজরা এখনো সক্রিয়। তারা চায় একটি 'যুদ্ধ'। প্রেসিডেন্ট ওবামা আপাতত 'যুদ্ধের' আশঙ্কা কিছুটা পিছিয়ে দিলেও কংগ্রেসে এমন অনেক আইন প্রণেতা আছেন, যাঁরা চাচ্ছেন এখনই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা হোক। কংগ্রেস উইম্যান বারবারা লি (ডেমোক্র্যাট) প্রতিনিধি পরিষদে এই আইনের খসড়া উপস্থাপন করেছেন, যেখানে আইসিসির আওতাকে সম্প্রসারণ করে আসাদকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে হেগের আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্য একজন কংগ্রেসম্যান ক্রিস স্মিথও (রিপাবলিকান) আসাদকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। ধারণা করছি, আগামী দিনগুলোতে এই দাবি আরো শক্তিশালী হবে। এখানে বলা ভালো, রোম চুক্তিটি (যাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে) ১২২টি দেশ 'রেটিফাই' করেছে, অর্থাৎ নিজ দেশের সংসদে তা অনুমোদিত হয়েছে। অন্যদিকে ৩১টি দেশ এই চুক্তি সমর্থন করলেও (স্বাক্ষর করেছে) নিজ দেশের সংসদ তা অনুমোদন করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়া রোম চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও সংসদে তা এখনো অনুমোদিত হয়নি। তিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়। প্রথমত, রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য হেগে আইসিসির প্রসিকিউটরের কাছে তদন্তের জন্য আবেদন করবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। অথবা চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইসিসির কাছে আবেদন করতে পারবে। অথবা নিরাপত্তা পরিষদ তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আইসিসিকে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য অনুরোধ করতে পারে।

নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর (টুইন টাওয়ার হামলা) যুক্তরাষ্ট্র তিন-তিনটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগান যুদ্ধ, ২০০৩ সালের মার্চে ইরাক যুদ্ধ, আর ২০১১ সালে লিবীয় যুদ্ধ। এসব যুদ্ধের পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতে যে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছে তা বলা যাবে না। ২০১১ সালে সিএনএনের জরিপে দেখা যায়, ৭৪ শতাংশ মানুষ বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত না হলে তাদের আক্রমণ করা উচিত নয় (অথচ লিবিয়া আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওবামা)। যুক্তরাষ্ট্র Operation Enduring Freedom দিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় গত ১২ বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। একের পর এক যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাতে জনমত প্রতিফলিত হয়নি।

আসলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে জনমত জরিপের ফলাফল প্রতিফলিত হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরই নানা সমস্যা। বেকার সমস্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত আছে হাজার হাজার মানুষ। অতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে অন্য আরেকটি দেশে (ইউরোপে) স্থায়ীভাবে থাকার চিন্তা করছে কেউ কেউ। যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতেই এই অতিরিক্ত কর। স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত করে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে 'যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া' যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলেও সাধারণ মানুষ তা চায় না। ২০১১ সালে সংবাদ সংস্থা এপিও একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করেছিল। ওই জরিপেও প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, 'গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগী হওয়া উচিত কি না?' ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে উচিত নয়, আর ৩২ শতাংশ বলেছে উচিত। একই জনমত পাওয়া গেছে ২০১৩ সালে আরেকটি সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রাক্কালে। 'স্বৈরাচারের বদলে গণতন্ত্র' তাদের কাম্য নয়। ৭২ শতাংশের অভিমত তাই। এসব জনমত সমীক্ষা প্রমাণ করে, মার্কিনি নীতিনির্ধারকরা জনমত সমীক্ষাকে গুরুত্ব দেন না। যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে তাঁদের স্বার্থ অনেক। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যদি তারা আসাদকে আইসিসির আদালতে বিচারের জন্য 'চাপ' দেয়, আমি অবাক হব না। সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়; বরং আসাদকে উৎখাত করাই হবে তাদের এখন মূল টার্গেট।

দৈনিক কালেরকন্ঠ, 22 সেপ্টেম্বর ২০১৩, রবিবার।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment