শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৮ সালে। কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে তার নাম ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। লিবিয়া যুদ্ধের পর এখন দ্বিতীয় আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি তিনি। সিরিয়া আক্রমণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও তিনি শেষ মুহূর্তে কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে সিরিয়া সঙ্কটের একটা সমাধান খুঁজে বের করতে। সেই সমাধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এতে করে একটি যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত এড়ানো যাবে? মার্কিন প্রশাসনে কংগ্রেসি যুদ্ধবাজরা এখনো সক্রিয়। ইসরাইলও চাচ্ছে একটি যুদ্ধ। উপরন্তু সর্বশেষ জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এ বিষয়টিই একটি ইস্যু হতে পারে এবং যুদ্ধবাজদের সিরিয়া আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজরা ২০০১ সালের পর থেকেই সক্রিয়। সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হয়। এর এক সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল আফগানিস্তানে। আর ঠিক দুই বছর পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল ইরাকে। অভিযোগ, ইরাকের কাছে মানবজাতি ধ্বংসকারী মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে! জাতিসংঘের তদন্তকারীরা সেসব অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার আগেই বাগদাদ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রে আক্রান্ত হলো, আর ৯ এপ্রিল পতন ঘটল সাদ্দাম হোসেনের। একসময় আফগানিস্তানের মতো ইরাকও 'দখল' হয়ে গেল। কিন্তু কোনো দিনই আর পাওয়া গেল না সেসব মারণাস্ত্র। এরপর প্রায় ১০ বছর অপেক্ষা। ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় জ্বলে উঠল ত্রিপোলি। শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ। এখানে হুট করে ইরাকের মতো সেনাবাহিনী পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাদ্দাম হোসেনকে যেমনি জীবিত রাখা 'হুমকি' মনে করত যুক্তরাষ্ট্র, ঠিক তেমনি গাদ্দাফিও ছিল হুমকিস্বরূপ। তাই তাদের পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছিল। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লংঘনের। নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত হলো_ ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ, অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ যেমনি অনুমোদন দেয়নি ইরাক আক্রমণের। তবে নিরাপত্তা পরিষদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল_ তাতে বলা হয়েছিল_ 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' গ্রহণ করার। আর আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যায় এই 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' কোনো পর্যায়েই যুদ্ধকে সমর্থন করে না। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন লিবিয়া আক্রমণ করল, তখনো কোনো সমর্থন ছিল না নিরাপত্তা পরিষদের। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নাম্বার ধারায় স্পষ্ট বলা আছে_ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে 'দ্বিতীয় যুদ্ধ', আর ত্রিপোলিতে 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল। আর এর ধারাবাহিকতায় আরেকটি যুদ্ধ দরকার। যুক্তরাষ্ট্র আরব বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে চায় যাকে কিনা বলা যায়, 'চতুর্থ যুদ্ধ'। ত্রিপোলিতে যেমনি ব্যবহৃত হয়েছিল একটি তত্ত্ব ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ, সিরিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে সে রকম একটি তত্ত্ব জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় চৎড়ঃবপঃ । অর্থাৎ বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে_ মানবতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। এ 'দায়িত্বের' অংশ হিসেবেই সিরিয়ায় মিসাইল হামলা হতে পারে। তবে বাগদাদের যেমনি ডগউ বা কোনো মরণাস্ত্র জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা খুঁজে পাননি, ঠিক তেমনি সিরিয়ায় কারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তাও খুঁজে পায়নি জাতিসংঘের টিম। তাদের রিপোর্টটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেননা সিরিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন কত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে আরেকটি যুদ্ধের জন্য?
চূড়ান্ত বিচারে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। এক. যুক্তরাষ্ট্রের জনমত যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে নয়। সর্বশেষ সিএনএনের জনমত জরিপে দেখলাম শতকরা ৫০ ভাগের ওপর মানুষ যুদ্ধের বিপক্ষে। তবে এটা সত্য, প্রেসিডেন্ট ওবামা কংগ্রেসের উভয় পক্ষের সমর্থন পাবেন। ৯ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের এ অধিবেশন বসার কথা ছিল, যা পিছিয়ে গেছে ওবামার অনুরোধে। তবে সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটি সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে অভিমত দিয়েছিল। এর ফলে ওবামার হাত শক্তিশালী হয়েছিল। দুই. সিরিয়াকে 'শাস্তি' ও 'সীমিত' মিসাইল আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওবামা। ধারণা করা হচ্ছে, এ হামলায় সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে না এবং মিসাইল হামলা দীর্ঘায়িত হবে মাত্র ৬০ দিন। কিন্তু এখানে অনেক অমীমাংসিত প্রসঙ্গ রয়েছে। এই হামলা কি চূড়ান্ত বিচারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট? এতে করে কি বাশার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস হবে? বিষয়টি যত সহজ মনে করা হচ্ছে অতটা সহজ নয়। তিন. এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধরনের আঘাত করতে পারে। একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল ডেমপাসের মতে, প্রতি মাসে ১ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু হলে। অর্থের পরিমাণটা একেবারে কম নয়। এমনিতেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারছেন না ওবামা। ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র গপঈষধঃপযু-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজন নাগরিকের মধ্যে একজন 'ফুড স্টাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্যসাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতি বছর ৭৮ মিলিয়ন ডলার এই 'ফুড স্টাম্প'-এর পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্যসহায়তা পায়। এখন যদি 'যুদ্ধ' শুরু হয় তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্যসহায়তা নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির শতকরা ৭ ভাগ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে এ হার ১৩ ভাগ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ গুণ বেশি। একমাত্র ইরাকে ৪ থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এষড়নধষ ডধৎ ড়হ ঞবৎৎড়ৎ শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল এতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়নে ১ হাজার মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। চার. যুক্তরাষ্ট্র তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে। আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশত্যাগ করতে হবে। আর টাইমসের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমাবাজের জন্ম হয়েছে। ইরাক এখন শিয়া, সুনি্ন ও কুর্দি_ এ তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়ায় কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। পাঁচ. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়ায় এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-বুশরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধে আল-কায়েদার উৎখাত নয়, বরং আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করেছে। ছয়. এই 'যুদ্ধ' একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পাশের দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
ইতিহাস তখন ওবামাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে জানি না। তবে শেষ মুহূর্তে যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছেন। তার এ সিদ্ধান্ত বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করতে যেমনি সাহায্য করেছে, ঠিক তেমনি পেন্টাগনের যুদ্ধবাজদেরও তিনি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণভাবে তার সমস্যা অনেক। অর্থনীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তার স্বাস্থ্যসেবা (ওবামাকেয়ার) বড় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং তিনি যদি সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করতেন, তা তাকে বিতর্কিতই করত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত হবেন, এটা অনেকেই চান না। তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত তাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করে কি না, তাই দেখার বিষয়। আগামীতে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করতে কীভাবে জাতিসংঘ টিমকে সহযোগিতা করে, সেটাই এখন উল্লেখযোগ্য দিক।
দৈনিক যায় যায় দিন, ২২ সেপ্টেম্বর রবিবার ২০১৩।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
চূড়ান্ত বিচারে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। এক. যুক্তরাষ্ট্রের জনমত যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে নয়। সর্বশেষ সিএনএনের জনমত জরিপে দেখলাম শতকরা ৫০ ভাগের ওপর মানুষ যুদ্ধের বিপক্ষে। তবে এটা সত্য, প্রেসিডেন্ট ওবামা কংগ্রেসের উভয় পক্ষের সমর্থন পাবেন। ৯ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের এ অধিবেশন বসার কথা ছিল, যা পিছিয়ে গেছে ওবামার অনুরোধে। তবে সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটি সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে অভিমত দিয়েছিল। এর ফলে ওবামার হাত শক্তিশালী হয়েছিল। দুই. সিরিয়াকে 'শাস্তি' ও 'সীমিত' মিসাইল আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওবামা। ধারণা করা হচ্ছে, এ হামলায় সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে না এবং মিসাইল হামলা দীর্ঘায়িত হবে মাত্র ৬০ দিন। কিন্তু এখানে অনেক অমীমাংসিত প্রসঙ্গ রয়েছে। এই হামলা কি চূড়ান্ত বিচারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট? এতে করে কি বাশার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস হবে? বিষয়টি যত সহজ মনে করা হচ্ছে অতটা সহজ নয়। তিন. এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধরনের আঘাত করতে পারে। একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল ডেমপাসের মতে, প্রতি মাসে ১ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু হলে। অর্থের পরিমাণটা একেবারে কম নয়। এমনিতেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারছেন না ওবামা। ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র গপঈষধঃপযু-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজন নাগরিকের মধ্যে একজন 'ফুড স্টাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্যসাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতি বছর ৭৮ মিলিয়ন ডলার এই 'ফুড স্টাম্প'-এর পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্যসহায়তা পায়। এখন যদি 'যুদ্ধ' শুরু হয় তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্যসহায়তা নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির শতকরা ৭ ভাগ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে এ হার ১৩ ভাগ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ গুণ বেশি। একমাত্র ইরাকে ৪ থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এষড়নধষ ডধৎ ড়হ ঞবৎৎড়ৎ শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল এতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়নে ১ হাজার মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। চার. যুক্তরাষ্ট্র তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে। আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশত্যাগ করতে হবে। আর টাইমসের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমাবাজের জন্ম হয়েছে। ইরাক এখন শিয়া, সুনি্ন ও কুর্দি_ এ তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়ায় কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। পাঁচ. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়ায় এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-বুশরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধে আল-কায়েদার উৎখাত নয়, বরং আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করেছে। ছয়. এই 'যুদ্ধ' একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পাশের দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
ইতিহাস তখন ওবামাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে জানি না। তবে শেষ মুহূর্তে যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছেন। তার এ সিদ্ধান্ত বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করতে যেমনি সাহায্য করেছে, ঠিক তেমনি পেন্টাগনের যুদ্ধবাজদেরও তিনি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণভাবে তার সমস্যা অনেক। অর্থনীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তার স্বাস্থ্যসেবা (ওবামাকেয়ার) বড় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং তিনি যদি সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করতেন, তা তাকে বিতর্কিতই করত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত হবেন, এটা অনেকেই চান না। তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত তাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করে কি না, তাই দেখার বিষয়। আগামীতে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করতে কীভাবে জাতিসংঘ টিমকে সহযোগিতা করে, সেটাই এখন উল্লেখযোগ্য দিক।
দৈনিক যায় যায় দিন, ২২ সেপ্টেম্বর রবিবার ২০১৩।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment