লন্ডনের
বিখ্যাত ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার ১৩ জুলাইয়ের সংখ্যার মূল প্রতিবেদন ছিল
‘আরব বসন্ত’ নিয়ে। ইকোনমিস্ট প্রশ্ন রেখেছিল ‘আরব বসন্ত’ কি ব্যর্থ হয়েছে?
দীর্ঘ ১৫ পাতার বিস্তারিত বিবরণ ছিল আরব বসন্ত নিয়ে। এরপর এক মাসের বেশি
সময় পার হয়েছে। আরো পরিবর্তন এসেছে আরব বিশ্বে। বিশেষ করে মিসর, তিউনিসিয়া ও
সিরিয়ায়। মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কায়রোর
মধ্যস্থল থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থকদের উত্খাত করতে গিয়ে
সেনাবাহিনী সেখানে গণহত্যা চালায়। তাতে মারা যায় প্রায় হাজারের ওপর মানুষ,
আর আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে মুরসির
সমর্থকরা উত্খাত হয়েছে সত্য, কিন্তু মিসরে একটি গৃহযুদ্ধের শঙ্কা দেখা
দিয়েছে। শুক্রবারকে মুরসি সমর্থকরা শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা
একেবারে ঘরে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। আরব বিশ্বের অন্য দেশ তিউনিসিয়ার
পরিস্থিতিও ভালো নয়। মিসরে সেনাবাহিনী কর্তৃক ইসলামপন্থীদের উত্খাতের পর এর
ঢেউ এসে লেগেছে তিউনিসিয়ায়, সেখানেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। মানুষ
রাস্তায় নেমে আসছে। গত ফেব্রুয়ারিতে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন বামপন্থী
নেতা চোকরি বেলাইদ। আর ২৫ জুলাই নিহত হলেন আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা ব্রাহিমি,
যাকে কিনা নাসেরপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিহত ব্রাহিমির বোন অভিযোগ
করেছেন যে, তার ভাইকে ইসলামপন্থী ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন এন্নাহদার সমর্থকরা
খুন করেছে। মিসরে যেমন ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও
সেনা-সমর্থকরা এক হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি তিউনিসিয়ার সাবেক সেনাশাসক বেন আলির
সমর্থকরা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের (তিন দলের কোয়ালিশন) বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ
হয়েছে। সেখানে সাবেক শাসক বরগুয়েবার সমর্থকরা ‘নিদা তিউনিস’ (Niddaa
Tunis)-এর ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বেন
আলিপন্থীরা। ফলে উত্তপ্ত হচ্ছে তিউনিসিয়ার রাজপথ। তিউনিসিয়া শেষ পর্যন্ত
মিসরের পথ অবলম্বন করে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
এদিকে সিরিয়ার
অবস্থাও ভালো নয়। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার
সরকারের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে সিনেটের অনুমোদন লাভ
করেছেন বারাক ওবামা। তবে রাশিয়া, চীন এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে,
আসাদ সরকার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে কি না তার উপযুক্ত প্রমাণ না
পাওয়া পর্যন্ত আক্রমণ পরিচালনা সঠিক হবে না। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র
ভূমধ্যসাগরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে, উভয় দেশই যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে
সেখানে। দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমতি ব্যতিরেকে সিরিয়া আক্রমণ
পরিচালনা করে কিনা। সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত চলছে
কয়েক বছর যাবত্। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্রোহ গ্রুপকে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র
সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ।
আরব বসন্ত এখন তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করছে।
তিউনিসিয়ার এক সাধারণ ফল বিক্রেতা বওয়াকুজিজি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে
যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, ২০১১ সালে তা সমগ্র আরব বিশ্বে একটি বড়
পরিবর্তন ডেকে আনলেও ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিসরে মুরসির উত্খাতের মধ্য দিয়ে
সে বিপ্লবের নতুন একটি ধারা তৈরি হলো। মিসরের এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন
তিউনিসিয়া, সিরিয়া কিংবা ইয়েমেনের চলমান রাজনীতিকে কতটুকু প্রভাবিত করবে,
বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, মিসরের এ পরিবর্তনে তিউনিসিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনে
বিরোধী শক্তি আরো উত্সাহিত হবে। আরব বসন্ত গোটা আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন
ডেকে এনেছিল, আর তা হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারের উত্খাত। বেন আলি, আলি সালেহ,
হোসনি মোবারক— যারা দীর্ঘদিন যাবত্ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন, তাদের
পতন ঘটেছিল। এর মধ্যে শুধু হোসনি মোবারকেরই বিচার শুরু হয়েছিল। বাকিদের
কারো বিচার হয়নি, বলা যেতে পারে বিচার আদৌ শুরু হয়নি। এদের পাশাপাশি বাকি
ছিলেন আসাদ। সিরিয়ায় আসাদের পতন একসময় আসন্ন মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে এ পতন
অনিশ্চিত। যদিও যুক্তরাষ্ট্র রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ তুলে আসাদের
বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার জোর তত্পরতা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে
আসাদ কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে, সেটিই দেখার বিষয়। আন্তর্জাতিক
‘অ্যাক্টরগুলো’ এখন সিরিয়ার ব্যাপারে সক্রিয়। তাই আসাদের পতন প্রলম্বিত
হচ্ছে। ‘আরব বসন্ত’ সেখানে ইসলামিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের পথ প্রশস্ত
করেছিল। মিসরে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদ
নির্বাচনে ইসলামপন্থী দল, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল বুর পার্টির
বিজয় আরব বসন্তের দ্বিতীয় ধারার সূচনা করেছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল তিউনিসিয়ায়।
কিন্তু এ ধারা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মুরসির পতনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় ধারার
সূচনা হলো। এ ধারার মূল শক্তি এখন ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা, যাদের পেছনে সমর্থন
রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর। এখন দেখার পালা এ তৃতীয় ধারায় তিউনিসিয়া শরিক হয়
কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক সার্কেলে প্রশ্ন উঠেছে আরব
বিশ্বের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মিসরে মুরসিকে উত্খাত করার পর থেকে
তার সমর্থকরা কায়রোয় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন আশঙ্কা
প্রকাশ করেছে যে, মিসর ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকান
ইউনিয়নের এ বক্তব্যকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কেননা মিসরের সামরিক
বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর এখন পর্যন্ত রাজনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণে এটা বলা
যাবে না। বরং দিনে দিনে দুই শক্তির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। মিসরের
সমাজ বলতে গেলে এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে রয়েছে ইসলামপন্থী
দলগুলো, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, লিবারেল তথা ডেমোক্র্যাটরা। এটা স্পষ্ট যে,
ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেলরা মুরসির উত্খাতকে সমর্থন জানিয়েছে। সমস্যাটা
তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই। কেননা সেখানে প্রয়োজন ছিল একটি জাতীয় ঐকমত্যের
সরকার গঠন করা। সেখানে ইসলামপন্থীরা হাজেম এল বেবলাওয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারে
যোগ দেয়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ইসলামপন্থীদের যোগ দিতে
আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখন ইসলামপন্থী তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক
শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি যোগ না দেয়ায় সরকার গ্রহণযোগ্যতা
হারায়। তাই প্রশ্নটা থাকবে যে, কোন পথে এখন মিসর? মিসর আলজেরিয়ার মতো
পরিস্থতি বরণ করে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা,
১৯৯১ সালে আলজেরিয়ায় কী ঘটেছিল। এর আগে সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা
বিজয়ী হলে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয়নি। ফলে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে যে
গৃহযুদ্ধ হয়, তাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে
ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনীই আলজেরিয়ার
রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। যার সঙ্গে মিসরের রাজনীতির একটা মিল খুঁজে
পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর সেখানে ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট (এনএলএফ)
আলজেরিয়ার ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। আর এনএলএফের ক্ষমতা পরিচালনার পেছনে
রয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে সেনাবাহিনীকে বলা হয় ‘le paivoir’। ফরাসি ভাষায়
এর অর্থ ‘শক্তি’। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ‘ডিপার্টমেন্ট অব
ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি’ মূলত আলজেরিয়ার মূল ‘রাজনৈতিক শক্তি’।
প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা (১৯৯৯ সাল থেকে) গোয়েন্দা সংস্থার
দ্বারাই চালিত হন। ইসলামপন্থীদের মূলধারায় না নিয়ে আসায় এরা এখনো সেখানে
একটি শক্তি। আলজেরিয়ায় এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের, যারা আত্মঘাতী বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত। এসব জঙ্গি
সংগঠনের তত্পরতা শুধু আলজেরিয়ায়ই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এদের তত্পরতা লিবিয়া ও
সিরিয়ায়ও লক্ষ করা গেছে।
আরব বসন্ত আরব বিশ্বে একটি সম্ভাবনা তৈরি
করেছিল, আর তা হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর উত্খাতের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয়
ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। এক্ষেত্রে তিউনিসিয়া একটি মডেল হতে পারত। মুসলিম
ব্রাদারহুডের মতো এন্নাহদাও তিউনিসিয়ার অন্যতম ইসলামিক শক্তি। এন্নাহদার
নেতা দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। ২০১১ সালে বেন আলির
পতনের পর ২০১১ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়েছিল, তাতে এন্নাহদা সংসদের নিম্নকক্ষে অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত
হয়েছিল। ৩৭ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছিল। ইচ্ছে করলে এন্নাহদা এককভাবে সরকার গঠন
করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। সেখানে তিন শক্তির একটি কোয়ালিশন সরকার
গঠিত হয়েছে। এন্নাহদা নেতা হামাদি জেবালি সাবেক প্রধানমন্ত্রী সর্বজন
গ্রহণযোগ্য মনসেফ মারজুকিকে তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
মারজুকি বামমনা কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক পার্টির নেতা। অন্যদিকে সোস্যাল
ডেমোক্রেটিক ধারার দল (ডেমোক্রেটিক ফোরাম ফর লেবার অ্যান্ড লিবারটিজ বা
এত্ত্বাকাতল) সরকারে যোগ দিয়েছিল। এত্ত্বাকাতল নেতা আবদের রাহমান লাদঘাম
ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লাদঘামের সঙ্গে আরো দুজন ডেপুটি
প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, যাদের একজন এন্নাহদার ও অন্যজন নিরপেক্ষ।
মন্ত্রিসভায় দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ কারণে দেখা যায়
তিউনিসিয়ায় বিপ্লব-পরবর্তী তেমন কোনো অসন্তোষ সংঘটিত হয়নি। সেখানে যে
ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মিসর এ মডেল অনুসরণ করতে পারত। কিন্তু মুসলিম
ব্রাদারহুডের নেতাদের হিসাবে ভুল ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির।
১৯২৫ সালে যে সংগঠনটির জন্ম, তাদের বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু ব্রাদারহুডের নেতারা যেটা বুঝতে পারেননি তা হচ্ছে, মিসরে একটি
ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি রয়েছে, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে যাদের যথেষ্ট প্রভাব
রয়েছে। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি মুরসি। তার পতন হয়েছে। তার
ক্ষমতাচ্যুতি নিয়ে নানা ‘তত্ত্ব’ থাকলেও একটা বিষয় স্পষ্ট তা হলো, তিনি
মিসরের অর্থনীতিকে বাগে আনতে পারেননি। যে কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা
বাড়ছিল। তিউনিসিয়ায় যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা নিয়ে আপত্তি উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী আলী লারায়েদ সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। আগামী ১৭
ডিসেম্বর সেখানে সাধারণ নির্বাচনের তারিখও ঘোষিত হয়েছে। এতে পরিস্থিতি আদৌ
শান্ত হবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
আরব বসন্ত-পরবর্তী আরব
বিশ্বে দুটো শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এক. একটি বৃহত্তর ঐকমত্য গঠনের ব্যর্থতা
সেখানে আবারো স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিতে পারে। মিসর ধীরে ধীরে সেদিকেই অগ্রসর
হচ্ছে। দুই. আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনের উদ্ভব ও সংগঠনগুলো
শক্তিশালী হতে পারে। লিবিয়া, সিরিয়া ও মিসর এর বড় প্রমাণ। আরব বসন্ত একটি
সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্র সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আগামী
দিনে তা হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ‘দি ইকোনমিস্ট’ তাই মন্তব্য করেছে— ‘No
wonder some have come to think the Arab spring is doomed. The Middle
East, they argue, is not ready to change. One reason is that it does not
have democratic institutions, so people power will decay into anarchy
or provoke the re-imposition of dictatorship. The other is that the
region's one cohesive force is Islam, which-it is argued-cannot
accommodate democracy. The Middle East, they conclude, would be better
off if the Arab spring had never happened at all.’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে
ইকোনমিস্টের এ মন্তব্যকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে সিরিয়ার অবস্থাও ভালো নয়। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সরকারের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে সিনেটের অনুমোদন লাভ করেছেন বারাক ওবামা। তবে রাশিয়া, চীন এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, আসাদ সরকার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে কি না তার উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আক্রমণ পরিচালনা সঠিক হবে না। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ভূমধ্যসাগরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে, উভয় দেশই যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে সেখানে। দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমতি ব্যতিরেকে সিরিয়া আক্রমণ পরিচালনা করে কিনা। সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত চলছে কয়েক বছর যাবত্। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্রোহ গ্রুপকে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ।
আরব বসন্ত এখন তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করছে। তিউনিসিয়ার এক সাধারণ ফল বিক্রেতা বওয়াকুজিজি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, ২০১১ সালে তা সমগ্র আরব বিশ্বে একটি বড় পরিবর্তন ডেকে আনলেও ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিসরে মুরসির উত্খাতের মধ্য দিয়ে সে বিপ্লবের নতুন একটি ধারা তৈরি হলো। মিসরের এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তিউনিসিয়া, সিরিয়া কিংবা ইয়েমেনের চলমান রাজনীতিকে কতটুকু প্রভাবিত করবে, বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, মিসরের এ পরিবর্তনে তিউনিসিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনে বিরোধী শক্তি আরো উত্সাহিত হবে। আরব বসন্ত গোটা আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন ডেকে এনেছিল, আর তা হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারের উত্খাত। বেন আলি, আলি সালেহ, হোসনি মোবারক— যারা দীর্ঘদিন যাবত্ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন, তাদের পতন ঘটেছিল। এর মধ্যে শুধু হোসনি মোবারকেরই বিচার শুরু হয়েছিল। বাকিদের কারো বিচার হয়নি, বলা যেতে পারে বিচার আদৌ শুরু হয়নি। এদের পাশাপাশি বাকি ছিলেন আসাদ। সিরিয়ায় আসাদের পতন একসময় আসন্ন মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে এ পতন অনিশ্চিত। যদিও যুক্তরাষ্ট্র রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ তুলে আসাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার জোর তত্পরতা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আসাদ কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে, সেটিই দেখার বিষয়। আন্তর্জাতিক ‘অ্যাক্টরগুলো’ এখন সিরিয়ার ব্যাপারে সক্রিয়। তাই আসাদের পতন প্রলম্বিত হচ্ছে। ‘আরব বসন্ত’ সেখানে ইসলামিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছিল। মিসরে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দল, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল বুর পার্টির বিজয় আরব বসন্তের দ্বিতীয় ধারার সূচনা করেছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল তিউনিসিয়ায়। কিন্তু এ ধারা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মুরসির পতনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় ধারার সূচনা হলো। এ ধারার মূল শক্তি এখন ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা, যাদের পেছনে সমর্থন রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর। এখন দেখার পালা এ তৃতীয় ধারায় তিউনিসিয়া শরিক হয় কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক সার্কেলে প্রশ্ন উঠেছে আরব বিশ্বের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মিসরে মুরসিকে উত্খাত করার পর থেকে তার সমর্থকরা কায়রোয় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, মিসর ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের এ বক্তব্যকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কেননা মিসরের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর এখন পর্যন্ত রাজনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণে এটা বলা যাবে না। বরং দিনে দিনে দুই শক্তির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। মিসরের সমাজ বলতে গেলে এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে রয়েছে ইসলামপন্থী দলগুলো, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, লিবারেল তথা ডেমোক্র্যাটরা। এটা স্পষ্ট যে, ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেলরা মুরসির উত্খাতকে সমর্থন জানিয়েছে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই। কেননা সেখানে প্রয়োজন ছিল একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। সেখানে ইসলামপন্থীরা হাজেম এল বেবলাওয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ইসলামপন্থীদের যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখন ইসলামপন্থী তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি যোগ না দেয়ায় সরকার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। তাই প্রশ্নটা থাকবে যে, কোন পথে এখন মিসর? মিসর আলজেরিয়ার মতো পরিস্থতি বরণ করে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ১৯৯১ সালে আলজেরিয়ায় কী ঘটেছিল। এর আগে সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয়নি। ফলে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে যে গৃহযুদ্ধ হয়, তাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনীই আলজেরিয়ার রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। যার সঙ্গে মিসরের রাজনীতির একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর সেখানে ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট (এনএলএফ) আলজেরিয়ার ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। আর এনএলএফের ক্ষমতা পরিচালনার পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে সেনাবাহিনীকে বলা হয় ‘le paivoir’। ফরাসি ভাষায় এর অর্থ ‘শক্তি’। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি’ মূলত আলজেরিয়ার মূল ‘রাজনৈতিক শক্তি’। প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা (১৯৯৯ সাল থেকে) গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারাই চালিত হন। ইসলামপন্থীদের মূলধারায় না নিয়ে আসায় এরা এখনো সেখানে একটি শক্তি। আলজেরিয়ায় এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের, যারা আত্মঘাতী বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত। এসব জঙ্গি সংগঠনের তত্পরতা শুধু আলজেরিয়ায়ই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এদের তত্পরতা লিবিয়া ও সিরিয়ায়ও লক্ষ করা গেছে।
আরব বসন্ত আরব বিশ্বে একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছিল, আর তা হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর উত্খাতের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। এক্ষেত্রে তিউনিসিয়া একটি মডেল হতে পারত। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো এন্নাহদাও তিউনিসিয়ার অন্যতম ইসলামিক শক্তি। এন্নাহদার নেতা দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। ২০১১ সালে বেন আলির পতনের পর ২০১১ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এন্নাহদা সংসদের নিম্নকক্ষে অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ৩৭ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছিল। ইচ্ছে করলে এন্নাহদা এককভাবে সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। সেখানে তিন শক্তির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে। এন্নাহদা নেতা হামাদি জেবালি সাবেক প্রধানমন্ত্রী সর্বজন গ্রহণযোগ্য মনসেফ মারজুকিকে তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মারজুকি বামমনা কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক পার্টির নেতা। অন্যদিকে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক ধারার দল (ডেমোক্রেটিক ফোরাম ফর লেবার অ্যান্ড লিবারটিজ বা এত্ত্বাকাতল) সরকারে যোগ দিয়েছিল। এত্ত্বাকাতল নেতা আবদের রাহমান লাদঘাম ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লাদঘামের সঙ্গে আরো দুজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, যাদের একজন এন্নাহদার ও অন্যজন নিরপেক্ষ। মন্ত্রিসভায় দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ কারণে দেখা যায় তিউনিসিয়ায় বিপ্লব-পরবর্তী তেমন কোনো অসন্তোষ সংঘটিত হয়নি। সেখানে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মিসর এ মডেল অনুসরণ করতে পারত। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের হিসাবে ভুল ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির। ১৯২৫ সালে যে সংগঠনটির জন্ম, তাদের বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্রাদারহুডের নেতারা যেটা বুঝতে পারেননি তা হচ্ছে, মিসরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি রয়েছে, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে যাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি মুরসি। তার পতন হয়েছে। তার ক্ষমতাচ্যুতি নিয়ে নানা ‘তত্ত্ব’ থাকলেও একটা বিষয় স্পষ্ট তা হলো, তিনি মিসরের অর্থনীতিকে বাগে আনতে পারেননি। যে কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা বাড়ছিল। তিউনিসিয়ায় যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা নিয়ে আপত্তি উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী আলী লারায়েদ সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর সেখানে সাধারণ নির্বাচনের তারিখও ঘোষিত হয়েছে। এতে পরিস্থিতি আদৌ শান্ত হবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
আরব বসন্ত-পরবর্তী আরব বিশ্বে দুটো শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এক. একটি বৃহত্তর ঐকমত্য গঠনের ব্যর্থতা সেখানে আবারো স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিতে পারে। মিসর ধীরে ধীরে সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে। দুই. আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনের উদ্ভব ও সংগঠনগুলো শক্তিশালী হতে পারে। লিবিয়া, সিরিয়া ও মিসর এর বড় প্রমাণ। আরব বসন্ত একটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্র সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আগামী দিনে তা হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ‘দি ইকোনমিস্ট’ তাই মন্তব্য করেছে— ‘No wonder some have come to think the Arab spring is doomed. The Middle East, they argue, is not ready to change. One reason is that it does not have democratic institutions, so people power will decay into anarchy or provoke the re-imposition of dictatorship. The other is that the region's one cohesive force is Islam, which-it is argued-cannot accommodate democracy. The Middle East, they conclude, would be better off if the Arab spring had never happened at all.’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইকোনমিস্টের এ মন্তব্যকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
0 comments:
Post a Comment