রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিরিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন


যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে 'চতুর্থ যুদ্ধ' শুরু করতে যাচ্ছে? ১৯৯১ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নিয়েছিল, তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে প্রথম যুদ্ধ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেদিন অবশ্য একটি বহুজাতিক বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে পেয়েছিল। কুয়েত দখলমুক্ত হয়েছিল। এরপর কেটে যায় ১০ বছর। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঘটে গেছে ইতিহাসের ভয়ংকর ঘটনা। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধসে পড়ল সন্ত্রাসী বিমান হামলায়। এর এক সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল আফগানিস্তান। আর ঠিক দুই বছর পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল ইরাক- অভিযোগ ইরাকের কাছে মানবজাতি ধ্বংসকারী মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে! জাতিসংঘের তদন্তকারীরা সেই সব অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার আগেই বাগদাদ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রে আক্রান্ত হলো, আর ৯ এপ্রিল পতন ঘটল সাদ্দাম হোসেনের। একসময় আফগানিস্তানের মতো ইরাকও 'দখল' হয়ে গেল। কিন্তু কোনোদিনই আর পাওয়া গেল না সেই সব মারণাস্ত্র। তারপর আবারও প্রায় ১০ বছর অপেক্ষা। ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় জ্বলে উঠল লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি। শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ। এখানে অবশ্য ইরাকের মতো সেনাবাহিনী পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাদ্দাম হোসেনকে যেমন জীবিত রাখা 'হুমকি' মনে করত যুক্তরাষ্ট্র, ঠিক তেমনি গাদ্দাফিও ছিলেন হুমকিস্বরূপ। তাই তাঁদের পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছিল। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের। নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত হলো- Humanitarian Intervention. অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ যেমন অনুমোদন দেয়নি ইরাক আক্রমণের, তবে নিরাপত্তা পরিষদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল- তাতে বলা হয়েছিল, 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' গ্রহণ করার। আর আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যায় এই 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' কোনো পর্যায়েই যুদ্ধকে সমর্থন করে না। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন লিবিয়া আক্রমণ করল, তখনো কোনো সমর্থন ছিল না নিরাপত্তা পরিষদের। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে 'দ্বিতীয় যুদ্ধ' আর ত্রিপলিতে 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল। আর এই সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্র আরব বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যাকে কিনা বলা যায় 'চতুর্থ যুদ্ধ'। ত্রিপলিতে যেমনি ব্যবহৃত হয়েছিল একটি তত্ত্ব- Humanitarian Intervention. সিরিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে সে রকম একটি তত্ত্ব- Responsibility to Protect. অর্থাৎ বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে মানবতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব! এই 'দায়িত্বের' অংশ হিসেবেই সিরিয়ায় মিসাইল হামলা হতে যাচ্ছে। তবে বাগদাদে যেমনি WMD বা কোনো মারণাস্ত্র জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা খুঁজে পাননি, ঠিক তেমনি এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় কারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তাও খুঁজে পায়নি জাতিসংঘের টিম। তাদের রিপোর্টটি জমা দিতেও তিন সপ্তাহ লেগে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?
যে যুদ্ধ সিরিয়ায় শুরু হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। এক. যুক্তরাষ্ট্রের জনমত যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে নয়। সর্বশেষ সিএনএনের জনমত জরিপে দেখলাম শতকরা ৫০ শতাংশের ওপর মানুষ যুদ্ধের বিপক্ষে। এরই মধ্যে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটি সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে অভিমত দিয়েছে। এর ফলে ওবামার হাত শক্তিশালী হয়েছে। দুই. সিরিয়াকে 'শাস্তি' ও 'সীমিত' মিসাইল আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওবামা। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলায় সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে না, মিসাইল হামলা দীর্ঘায়িত হবে মাত্র ৬০ দিন। কিন্তু এখানে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকে গেছে। এই হামলা কি চূড়ান্ত বিচারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট? এতে করে কি বাশার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস হবে? বিষয়টি যত সহজ মনে করা হচ্ছে, অতটা সহজ নয়। তিন. এই 'যুদ্ধ' যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধরনের আঘাত করতে পারে। একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল ডেমপসের মতে, প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলার খরচ হবে সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু হলে। অর্থের পরিমাণটা একেবারে কম নয়। এমনিতেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারছেন না ওবামা। গত ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র Meclatchy-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজন নাগরিকের মধ্যে একজন 'ফুড স্ট্যাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতিবছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই 'ফুড স্ট্যাম্প'-এর পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি 'যুদ্ধ' শুরু হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, বরং শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির ৭ শতাংশ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মাঝে এই হার ১৩ শতাংশ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় আট হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ জনেরও বেশি। একমাত্র ইরাকে চার থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র Global war on terror শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে। যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তাতে ব্যয় হয়েছিল তিন থেকে চার দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন = এক হাজার মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। চার. যুক্তরাষ্ট্র তিন-তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে! আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশ ত্যাগ করতে হবে। আর টাইমসের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমাবাজির জন্ম হয়েছে। ইরাক এখন শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি- এই তিন সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়ায়ও কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। পাঁচ. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়ায় এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। এই যুদ্ধ আল-কায়েদার উৎখাত নয়, বরং আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে শক্তিশালীই করবে। ছয়. এই 'যুদ্ধ' একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরায়েল এই যুদ্ধ হলে তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি লবির কারণে এই যুদ্ধ শুরু করে, তাতে করে তাদের লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনেও ওবামা বিশ্ব নেতাদের পূর্ণ সমর্থন পাননি। এমনকি রাশিয়া ১০০ পাতার যে ডকুমেন্ট শীর্ষ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় সিরিয়ার বিদ্রোহী সৈন্যরাই এই রাসায়নিক হামলা চালিয়েছিল। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান Global Research তাদের এক প্রতিবেদনে (১ সেপ্টেম্বর ২০১৩) উল্লেখ করেছে, সিরীয় সরকার নয়; বরং বিদ্রোহীদের হাত রয়েছে এই রসায়নিক অস্ত্রের হামলার পেছনে। যুদ্ধবিরোধী বিশ্বজনমত শক্তিশালী ক্রমশ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসনের সুর এখন কিছুটা নরম হয়েছে। তা সত্ত্বেও সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
 

0 comments:

Post a Comment