রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিরিয়ায় যুদ্ধ কি আসন্ন?

৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এক গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে মিলিত হচ্ছে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালাবে কি চালাবে না, এ ব্যাপারে কংগ্রেস একটি সিদ্ধান্ত দেবে। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা এটা নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি কংগ্রেসের অনুমোদন নিয়েই সিরিয়ায় \\'সীমিত\\' ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে চান। এক্ষেত্রে যুদ্ধবিমানের চাইতে তিনি ভূমধ্যসাগরের অবস্থিত ডেস্ট্রয়ার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবেন। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, তা হচ্ছে তিনি কংগ্রেসের সমর্থন পাবেন। টিভি টকশোগুলোতে কংগ্রেসের সদস্যরা অনেকেই সিরিয়ায় বিমান হামলা চালানোর পক্ষে। কিন্তু এই হামলা কি সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনবে? অনেক প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে, যা শুধু সংকটের মাত্রাকে বাড়াবেই না, বরং বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দেবে। প্রথমত, সিরিয়ায় যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। এই \\'যুদ্ধ\\' আর শুধু সিরিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তা ইরান, লেবানন, তুরস্ক ও ইসরায়েলকে জড়িত করতে পারে। ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারে। হামাসের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে হামলা চালানোও বিচিত্র কিছু নয়। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে রক্ষার তাগিদে যুক্তরাষ্ট্র একটি \\'পূর্ণ যুদ্ধ\\' শুরু করতে বাধ্য হতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই \\'যুদ্ধ\\' নতুন করে বিশ্বে এক স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। কেননা রাশিয়া ও চীন বারবার এই যুদ্ধের পরিণতির কথা বলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জনমত যুদ্ধের পক্ষে নয়। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের পক্ষে বললেও জনমত যুদ্ধের পক্ষে নয়। জার্মানিও যুদ্ধের পক্ষে নয়। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আসরে \\'বিচ্ছিন্ন\\' করে ফেলতে পারে। ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এসে দাঁড়ায়নি। তৃতীয়ত, \\'ওয়ার পাওয়ার রেজ্যুলেশন\\'-এর ধারা ২প অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হয়, শুধু তখনই ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। এক্ষেত্রে তথাকথিত সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয়নি কোনোভাবেই। ফলে ওবামার সেই \\'যুদ্ধে যাওয়ার\\' সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের সমর্থন পেলেও নৈতিকভাবে তিনি দুর্বল থাকবেন এবং তার সিদ্ধান্ত নানা বিতর্কের জন্ম দেবে। চতুর্থত, প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি যুদ্ধ ঘোষণা করেনও, তা হলেও তিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবেন। কেননা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। পঞ্চমত, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের একটি \\'চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ\\' আরও বেশি মাত্রায় সহিংসতার জন্ম দেয়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। অধ্যাপক স্টেফান জুনেস তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। ষষ্ঠত, যদি \\'যুদ্ধ\\' শুরু হয়ে যায়, তা হলে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সেখানে একত্রিত করবে। তারা বাশার আল আসাদকে সমর্থন করবেন এবং প্রচণ্ড এক মার্কিনবিরোধিতার জন্ম হবে, যা ছড়িয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশে। সপ্তমত, গবেষকরা যুক্তি তুলে ধরে দেখিয়েছেন এ ধরনের যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিই হয়েছে বেশি। যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘায়িত হয় (আফগানিস্তান, ইরাক) এবং সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু অধিকার) ব্যয় বরাদ্দ কমে যায়। অষ্টমত, গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাশারের বিকল্প কোনো একক নেতৃত্ব সিরিয়ার বিদ্রোহীরা তৈরি করতে পারেনি। বর্তমানে প্রায় ৮০০ থেকে ১২০০ সশস্ত্র গ্রুপ বিচ্ছিন্নভাবে \\'যুদ্ধ\\' করছে সরকারি সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এদের এক কাতারে দাঁড় করানো হবে কঠিন কাজ। ফলে দ্বিতীয় আরেকটি সোমালিয়ার জন্ম হতে পারে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায়। নবমত, যুদ্ধ শুরু হলে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো আরও শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যে \\'জাবহাত আলনুসরা\\' নামে একটি সিরীয় সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সংগঠনকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে এই সংগঠনটিও আর্থিক ও অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য হিসেবে পেয়েছে। আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, তালেবান যোদ্ধাদের আর্থিক ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এক সময় এই তালেবানই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। দশম, ওবামা ও তার নীতিনির্ধারকরা যুদ্ধের কথা বললেও কীভাবে এখান থেকে বেরিয়ে আসবেন তার কোনো পরিকল্পনার কথা বলেননি। এগার, এই যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব নতুন করে এক ধরনের \\'প্রক্সি যুদ্ধ\\' (যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া, আর ইসরায়েল বনাম ইরান) প্রত্যক্ষ করতে পারে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের এ অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে। অতীতে ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি বাহিনীর কুয়েত দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। এবারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা \\'মানবতা রক্ষায়\\' হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারের ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে যাচ্ছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল Humanitaion InterventionÕ\\'-এর তত্ত্বটি। আর এবারে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে \\'ÔResponsibility to Protect \\' তত্ত্ব। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে(?) সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এই সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলি সে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। জাতিসংঘের চার্টারে উল্লেখ করা আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এসব কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তা হলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রেও (২০১১) ও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটাও সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ÔResponsibility to ProtectÕÕ\\'-এর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে, সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইনে অনুমোদন করে না। তবে ওবামাকে শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় আক্রমণ চালাতেই হবে। ৩ সেপ্টেম্বর ওবামা হোয়াইট হাউসে হাউস স্পিকার বেহনার ও সংখ্যালঘু নেতা পেলোসির সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বিকেলে সিনেটের এক কমিটিতে ওবামার নীতিনির্ধারকরা সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সিরিয়া আক্রমণের ছক কাটা হয়েছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার (২০০৯) বিজয়ী বারাক ওবামা শান্তি পুরস্কারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন ২০১১ সালে লিবিয়া আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে। আর এই সেপ্টেম্বরেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটি যুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছেন। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, লিবিয়া আর ইরাকের সঙ্গে সিরিয়াকে মেলানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের \\'যুদ্ধ অর্থনীতি\\' বারাক ওবামাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেও শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তা হবে বড় একটি আঘাত।
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র

0 comments:

Post a Comment