রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অবশেষে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন


তারেক শামসুর রেহমান
অবশেষে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ করলেন দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে। এর একটি ভালো দিক অবশ্য আছে। দুদকসহ বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি যখন রেলমন্ত্রীর এপিএসের কাছে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে, ঠিক তখনই তদন্তের স্বচ্ছতার স্বার্থে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন। এটা যেমনি একটি ভালো দিক, ঠিক এর একটি মন্দ দিকও আছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ অনেক প্রশ্নের জবাব আমাদের দেবে না। প্রথমত, সংবাদ সম্মেলনে ওই ৭০ লাখ টাকার ব্যাপারে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই জানালেও, সাসপেন্ড হওয়া রেলওয়ের জিএম আবু ইউসুফ মৃধা জানিয়েছিলেন, তারা গাড়িতে করে মন্ত্রী সাহেবের বাসাতেই যাচ্ছিলেন। এত টাকা নিয়ে কোন ব্যক্তি এত গভীর রাতে সাধারণত চলাচল করেন না। সুতরাং ওই টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তা জানা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ঘুষ কেলেংকারিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ এ দেশের রাজনীতিবিদদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছেন এবং আগামীতে ক্ষমতায় যেতে চান, তাদের ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হলেন। অথচ বারবার এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের কাছেই ফিরে গেছে। তৃতীয়ত, ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে খুব সৎ ছিলেন না, তা প্রমাণিত হল। তার ছেলে সৌমেন গুপ্তের ৫ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ লাইসেন্স প্রাপ্তি, দিরাইয়ে আলিশান সেন মার্কেট, নামে-বেনামে শত কোটি টাকার 'শত্রু সম্পত্তি' দখল ইত্যাদি প্রমাণ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ছিল না। কেননা তার আয়ের যে হিসাব তিনি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন, তাতে তার স্বীকারোক্তি ছিল, তার বার্ষিক আয় মাত্র ৭ লাখ টাকা। ৭ লাখ টাকার আয় দিয়ে কোটি টাকার মার্কেট করেন কিভাবে? আর তার সন্তান নিশ্চয়ই কোন আলাদিনের চেরাগ পাননি যে, ৫ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স তিনি পেতে পারেন? এটা তো শুধু ৫ কোটি টাকার 'মামলা' না। এটা প্রায় ৩০ কোটি টাকার একটা বিনিয়োগ। 'সেনগুপ্ত কমিউনিকেশন' এই টাকা পেল কোত্থেকে? দুর্মুখরা বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কলকাতাতেও বাড়ি আছে। সুরঞ্জিত বাবুর কী টিআইএন নাম্বার আছে? সেখানে তিনি কত টাকা ট্যাক্স দিয়েছিলেন? অভিযোগ আছে, জিগাতলায় যে বাড়িতে তিনি থাকেন, ওই বাড়িটির মূল মালিক তিনি নন। বেশ কিছুদিন আগে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। দুদক কী এখন এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করবে? চতুর্থ, যে ৭০ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে এবং যা ওমর ফারুক পরদিন নিজ অ্যাকাউন্টে জমা দেন, এর মূল মালিক কে? ওমর ফারুক কী এই অবৈধ টাকার মালিক? এপিএস হিসেবে তিনি যে বেতন পান, ওই বেতন দিয়ে কী এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করা সম্ভব? তার এবং তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে কী 'অবৈধ লেনদেনের' বিষয়টির সমাধান হবে? 'অবৈধ লেনদেন' এর টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়াই শ্রেয়। শুধু অ্যাকউন্ট জব্দই নয়, প্রকৃত 'সত্য' জানতে অবিলম্বে তিন অভিযুক্ত ব্যক্তি ওমর ফারুক, এনামুল হক ও ইউসুফ আলী মৃধাকে গ্রেফতার করা উচিত। না হলে 'সত্য' চাপা পড়ে যাবে। পঞ্চমত, দুদকের জন্য একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে 'ইমেজ' বৃদ্ধির। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদক কার্যত একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে পারছে না। সর্বশেষ ঘটনায় দুদক যখন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের দুর্নীতির ব্যাপারে একটি 'সার্টিফিকেট' দেয়, তখন দুদক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। এখন দুদকের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি হল, মন্ত্রীসহ অভিযুক্ত ওই তিন ব্যক্তির আর্থিক লেনদেন, ব্যাংক ব্যালেন্সের তদন্ত করা। এটি যদি দুদক করতে না পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে থাকবেই। দুদক যদি নিরপেক্ষভাবে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের স্বার্থেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করে, আমার বিশ্বাস দুদক তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে। সরকারেরও উচিত দুদককে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়া। ষষ্ঠ. দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে টাকা পাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কিন কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি। এর আগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা সরকারের জন্য কোন ভালো খবর নয়। এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে সরকারপ্রধান ভালো কাজটিই করলেন। সরকারপ্রধান যদি এখন সব সেক্টরে দুর্নীতি নির্মূলের নির্দেশ দেন, তাহলে তাতে তার নিজের ও সরকারের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে। সপ্তম. তথাকথিত 'ঘুষ কেলেংকারির' দায় নিয়ে একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। তখন সরকারপ্রধানের উচিত সব মন্ত্রীর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া। মন্ত্রীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব জমা দেয়ার ওয়াদা তিনি করেছিলেন। এই সুযোগে তিনি তা সংগ্রহ করতে পারেন। প্রয়োজনে তা জাতীয় সংসদেও উপস্থাপন করা যায়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটা দৃষ্টান্ত প্রধানমন্ত্রী সৃষ্টি করতে পারেন। অষ্টম. রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে অন্য মন্ত্রীরাও সতর্ক হতে পারেন। এ ধরনের 'একজন ওমর ফারুক' কিংবা 'একজন ইউসুফ আলী মৃধা' প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়েই আছে। অনেক সময়ই তারা মন্ত্রীদের 'ব্ল্যাকমেইলিং' করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। প্রায় ক্ষেত্রেই ওইসব ওমর ফারুকরা ধরা পড়েন না। মন্ত্রী বাহাদুররা যত বেশি সতর্ক হবেন, ততই মঙ্গল। নয়. মন্ত্রীদের এপিএস থাকাটা জরুরি। এসব এপিএস সাধারণত মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হন (ওমর ফারুকের সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পর্ক প্রায় ২০ বছরের)। তারা ছাত্র তথা দলের যুব সংগঠনের সদস্য। তারা সরকারি কর্মচারী নন। এক্ষেত্রে সরকারি ক্যাডারদের এ পদে আনা যায় কিনা, তা বিবেচনা করা যেতে পারে। নতুবা এপিএসদের জন্য নতুন একটি ক্যাডার পদও সৃষ্টি করা যেতে পারে। দশ. ঘুষ কেলেংকারির ঘটনায় বিজিবি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। বিজিবি প্রধানের বক্তব্যও প্রশ্নবিদ্ধ। অবৈধ টাকা পাওয়ায় অভিযুক্তদের পুলিশের কাছে টাকাসহ হস্তান্তর করাই ছিল আইনি কাজ। এ কাজটি বিজিবি করেনি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনকে কলংকিত করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এটা বাংলাদেশে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্য তা কোন ভালো খবর নয়। তিনি যদি রাজনীতিতে থাকেন, আজীবন তাকে এই ঘুষ কেলেংকারির ঘটনা তাড়া করবে। প্রতিপক্ষরা এটাই ইস্যু করবে। আর তিনি যদি 'অবসর' নেন এবং আগামীতে একজন 'জাতীয় অভিভাবক' হিসেবে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন, তিনি ভালো করবেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল অহেতুক কোন বিতর্কে জড়িয়ে পড়-ক, আমরা তা চাই না। এটা নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হোক, এটাও কাম্য নয়।
Daily JUGANTOR, 17.4.12

0 comments:

Post a Comment