রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আন্তর্জাতিক নদী আইন ও নদীসংযোগ প্রকল্প

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিমকোর্ট আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি দ্রুত শুরু করার জন্য একটি নির্দেশ দিয়েছেন, যা বাংলাদেশে বড় ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৩০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক নদীকে পরস্পর সংযুক্ত করা হবে এবং খরাপীড়িত অঞ্চলে সেই পানি নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এই রায়টি দেওয়ার সময় এটা বিবেচনায় নেননি যে এতে বাংলাদেশ বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এমনকি খোদ ভারতের বিশিষ্ট নাগরিকরা এই সিদ্ধান্তকে একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে সুপ্রিমকোর্টের এই রায় ভারত সরকার কবে কার্যকর করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই সিদ্ধান্তটি এল এমন একটি সময় যখন পানির হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ধূম্রজাল, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না-হওয়া, উপরন্তু গঙ্গার পানিচুক্তি অনুযায়ী পানি না-পাওয়া ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। যেসব নদীকে সংযোগ করে পানি প্রত্যাহারের কথা বলা হচ্ছে তার প্রতিটি আন্তর্জাতিক নদী। আন্তর্জাতিক নদী আইন আনুসারে ভারত এই কাজটি করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদী আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি নদী যদি দুই থেকে তিনটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা হলে ওই নদীর পানি কীভাবে বণ্টন হবে। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন, ১৯২১ সালের দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫নং অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতি, প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাটির দেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিতে হবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না-করেই হতে হবে। অথচ প্রকল্পটি নির্মিত হলে বৃহত্তর সিলেট বিভাগ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহে পানি তার নিজের ভৌগোলিক এলাকায় যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ব্যবহার করবে। এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’ আন্তঃনদী প্রকল্পের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে। জলপ্রবাহ কনভেনশনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে যেখানে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ক্ষতি যাতে না-হয় সে-জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ৭-১), পারস্পরিক সুবিধা লাভ (অনুচ্ছেদ-৮), তথ্য-উপাত্ত বিনিময় (অনুচ্ছেদ ৯-১) এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকে সময়মতো জানানোর যে কথা বলা হয়েছে, ভারত তার একটিও অনুসরণ করেনি। জলাভূমি বিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫নং অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের’ যেকথা বলা হয়েছে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু হলে এই অঞ্চলের ট্র্যাডিশনাল উদ্ভিদ, মত্স্যসম্পদ সব ধ্বংস হয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্যে কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে কোনো নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রতিটি প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করতে হবে। কিন্তু ভারত এই কাজটি করেনি। এমনকি বাংলাদেশ সরকারকেও কখনও বলেনি পরিবেশগত প্রভাবটি খতিয়ে দেখার জন্য। আন্তর্জাতিক আইনবিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেওয়া হবে না যার ফলে তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থার কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল পানিশূন্য হবে। উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে কয়েক হাজার মানুষ। এ তো গেল একদিক, অন্যদিকে ভারত সীমান্তের এ পারে, অর্থাত্ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হাওরে পানি থাকবে না। মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাবে এই অঞ্চল। আন্তর্জাতিক আইন এটা অনুমোদন করে না। এমনকি ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে তা শুধু অবৈধই নয়, বরং এর ফলে পানির অভাবে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে (গ্লোবাল হেরিটেজ সাইট)। আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশনের এটা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ওই কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহযোগিতা করতে বাধ্য। আমি আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব (ওয়ার্ল্ড কনভেনশন অব ডেমস, ১৯৯৮), যা ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের যৌক্তিকতাকেও সমর্থন করে না। ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে ফুলেরতল ব্যারাজ নির্মাণের কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। টিপাইমুখের একশ’ মাইল ভাটিতে ভারত এই ব্যারাজটি নির্মাণ করছে। বাঁধ নির্মিত হয় বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য। সে জন্য বিশাল জলাধার নির্মাণ করতে হয়। আর ব্যারাজ নির্মাণ করা হয় সেচকাজের জন্য। ভারত সেচকাজের জন্যই ব্যারাজটি নির্মাণ করছে। বাংলাদেশ যদি তার ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’ কিংবা ভারতকে ‘তোষামোদী’ করার নীতি পরিত্যাগ না করে, তা হলে বাংলাদেশ আগামীতে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যার মুখোমুখি হবে। এটা সত্য যে, আন্তঃনদী সংযোগের সিদ্ধান্তটি এসেছে উচ্চ আদালত থেকে, সরকারের পক্ষ থেকে নয়। বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। আগামী ৫ মে ভারতের মন্ত্রিসভার ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি’ প্রণব মুখার্জী ঢাকায় আসছেন। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশকে অবশ্যই এই আন্তঃনদী সংযোগের প্রশ্নটি তুলতে হবে এবং বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানাতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা। টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারেও বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিল ভারত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গত ২২ অক্টোবর (২০১১) নয়াদিল্লিতে ভারতের জলবিদ্যুত্ নিগম এনএইচপিসি রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুত্ সংস্থা এসজেভি ও মণিপুর সরকারের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারেও তেমনটি ঘটেছিল। আর গঙ্গা পানিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পদ্মায় পানি নেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন ফেনী নদী থেকে দুই কিউসেক পানি নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ ভারতের এই প্রস্তাবে সম্মতিও দিয়েছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই ভারত ২৪টি লো-লিফট পাম্পের সাহায্যে ফেনী নদী থেকে অবিরাম পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে কোনো চুক্তি ছাড়াই (কালের কণ্ঠ, ৬ মার্চ ২০১২)।
ভারতের এই ‘পানি রাজনীতি’ বাংলাদেশকে ‘পানিশূন্য’ করেছে। যেখানে একসময় বাংলাদেশে ছোটবড় মিলিয়ে ৭০০ নদী ছিল, সেখানে এখন এই সংখ্যা মাত্র ২৩০টি। প্রতিবছর পানির অভাবে ১০টি নদী (ছোট) বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালুর ব্যাপারে ভারতের উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে বড় ধরনের একটি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখেই ঠেলে দেবে না, বরং দু’দেশের সম্পর্কের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন তার পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd(a)yahoo.com
SAKALER KHOBOR, 10.4.2012

3 comments:

  1. ভাল লাগছে।

    ReplyDelete
  2. স্যার এ ধরনের লেখা পড়ে, অনেক কিছুই জানতে পারছি

    ReplyDelete
  3. Thank you sir, So many effective....MA in History and civilization Discipline, KU ❤️❤️

    ReplyDelete