রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনদিনের তুরস্ক সফর শেষ হয়েছে গত ১৪ এপ্রিল। প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সমসাময়িককালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের গুরুত্ব বেড়েছে। তুরস্ক ও বাংলাদেশ_ দুটো দেশেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দুটো দেশই ডি-৮-এর সদস্য। কিছুদিন আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গুল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এখন ফিরতি সফরে প্রধানমন্ত্রী তুরস্ক গেলেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হল। বস্তুতপক্ষে তুরস্কের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজ মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল। 'আরব বসন্ত'-এর পর অনেক দেশ এখন 'তুরস্ক মডেল'কে গ্রহণ করেছে। গেল ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমার সুযোগ হয়েছিল তুরস্কে যাওয়ার। সেখানে আমি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়া তুরস্কের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের সঙ্গে আমার মতবিনিময়কালে আমার মনে হয়েছে তুরস্ক একুশ শতকে মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাদের জন্য তুরস্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারি তুরস্কের কাছ থেকে। শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশও যে বিশ্বে একটি মডেল হতে পারে, আজকের তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। মুসলিম বিশ্ব মানেই মনে করা হতো একনায়কতান্ত্রিক সামরিক শাসন (মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন), কিংবা ক্ষমতালোভী রাজতন্ত্র (গালফভুক্ত দেশগুলো) অথবা ইসলামিক চরমপন্থীদের উর্বরভূমি (আফগানিস্তান, সোমালিয়া)। কিন্তু এর বাইরেও একটি ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থা যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে পারে, গত প্রায় ১৬ বছরের তুরস্কের রাজনীতি এটাই প্রমাণ করেছে। সারা আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বিনির্মাণের যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে (আরব বসন্ত), তার মধ্যে ব্যতিক্রম তুরস্ক। এমনকি ইসলামী জঙ্গিদের কোনো তৎপরতাও নেই তুরস্কে। কুর্দিদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে সত্য; কিন্তু তা এখন নিয়ন্ত্রিত। একসময় তুরস্কের সেনাবাহিনী ছিল গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এখন সেনাবাহিনীকে হুমকি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
তুরস্ক এখন একটি মধ্য আয়ের দেশ। ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় (পিপিপি) বছরে ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে তুরস্কের অবস্থান ১৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও'নেইল (ঔরস ড় ঘবরষষ) ২০১১ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ভাগ করেছেন। তাতে তিনি তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন গওকঞ গ্রুপে, অর্থাৎ মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক বিশ্বে নতুন একটি অর্থনৈতিক বস্নক সৃষ্টি করেছে। জিম ও'নেইল এ চারটি দেশকে শুধু দ্রুত বর্ধনশীল উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে নারাজ। ২০০১ সালে তিনিই ইজওঈ এর ধারণা দিয়েছিলেন (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন)। বাংলাদেশ গওকঞ মডেল অনুসরণ করতে পারে এবং গওকঞ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারে। ২০০২ সাল থেকেই জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি সরকার সেখানে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়ে আসছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল (২০০৭ সাল থেকে) ও প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। পরপর তিনবার এরদোগান প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বিজয়ী হয়েছে (২০০২ সালে ৩৪ ভাগ ভোট, ২০০৭ সালে ৪৭ ভাগ ভোট, আর ২০১১ সালে ৪৯ ভাগ ভোট)। প্রেসিডেন্ট গুল ও প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ব্যক্তিজীবনে ইসলামিক জীবনধারা (তাদের স্ত্রীরা মাথায় হেজাব ব্যবহার করেন) অনুসরণ করলেও, তারা কট্টর নন। তারা বাধ্য করছেন না সবাইকে ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের জন্য 'হেজাব না পরার' যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। তুরস্ক ভ্রমণে আমি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি মেয়েরা আদৌ হেজাব পরে না। জিন্স প্যান্ট পরা আধুনিক মেয়েদের ক্যাম্পাসে চলাফেরা আমাকে ইউরোপের দেশগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বে অভিযোগ রয়েছে, দলটি ইসলামপন্থী এবং কট্টর; কিন্তু তুরস্কে আমি এ অভিযোগ শুনিনি। সেখানে আদৌ কোনো জঙ্গিবাদী তৎপরতা নেই। একাধিক ফোরামে আমি আল-কায়েদার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি। জবাব পেয়েছি একটাই_ সেখানে আল-কায়েদার কোনো তৎপরতা নেই। একটি মুসলিম জনসংখ্যা অধিষ্ঠিত দেশ যে ইসলামকে ধারণ করেও আধুনিকমনস্ক হতে পারে, তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। কামাল পাশা (যিনি জাতির পিতাও বটে) তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তা আজো আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে তাতে মূল নীতিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আমি তুরস্কে কোথাও শুনিনি যে, বিরোধী পক্ষ সরকারের ইসলামপন্থী কিছু কর্মকা-কে 'জঙ্গিবাদী' তৎপরতা বলে দাবি করছে (অথচ আমরা জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গটি বারবার টেনে আনছি)। অত্যন্ত 'ক্লিন' চরিত্রের অধিকারী এরদোগান ছিলেন ইস্তাম্বুলের মেয়র। দুর্নীতির কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই। বাংলাদেশ তুরস্কের এ 'রাজনীতি' থেকে কিছুটা শিখতে পারে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। পুরনো 'সিল্করোড'কে নতুন করে আবার 'আবিষ্কার' করছে তুরস্ক। চেষ্টা করছে ওই দেশগুলোকে একটি প্লাটফার্মে দাঁড় করাতে। তুরস্ক হতে যাচ্ছে 'সিল্করোড'ভুক্ত দেশগুলোর নেতা। বাকু-তিবিলিসি-সাইহান পাইপলাইন (গ্যাস ও তেল) এ লক্ষ্যেই রচিত। ৪ বছর পরপর সেখানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর সংসদ নির্বাচনে যারা নূ্যনতম ১০ ভাগ ভোট পেয়েছে, সংসদে তারাই দলীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যদিও 'আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের' আলোকে সেখানে নির্বাচন হয়।
তুরস্কের সাম্প্রতিক রাজনীতি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের ভূমিকা এখন বহির্বিশ্বে বেশ আলোচিত। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তুরস্ক যে গণতন্ত্রের একটি 'মডেল' হতে পারে, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি কট্টর নন, আধুনিকমনস্ক এক মানুষ। তুরস্কে ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে বিরোধ রয়েছে, তা থেকে তিনি ও তার দল (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে মনে হয়। মুসলিম বিশ্বে, সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ক্ষমতা পরিচালনা করেছে এবং সেসব দেশে (মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন) সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। তুরস্কও এ থেকে পার্থক্য ছিল না। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করেছিল। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল কেনান এভরেন ১৯৮০ সালে। ১৯৮২ সালে তিনি ৭ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেনারেল এভরেন 'রাজনীতি' থেকে অবসর নিলে সেনাবাহিনী রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। পরে প্রেসিডেন্ট হন তুরগুত ওজাল ও সোলেমান ডেমিরেল। মূলত নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই গণতন্ত্রমনা ইসলামিক শক্তিগুলো নতুন শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় এবং সমাজে তাদের অবস্থান এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। এই ইসলামিক শক্তির নেতৃত্ব (১৯৯৬) দিয়েছিল ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি ও তার নেতা নেকমাতিন এরবাকান। তারা একসময় ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সঙ্গে একটি কোয়ালিশন সরকারও গঠন করেছিল। সেনাবাহিনীর চাপে এরবাকান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৯৭ সালের ১৮ জুন। একসময় ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছিল। এরবাকানের মৃত্যু ইস্তাম্বুলের সাবেক মেয়র এরদোগানকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। ২০০২ সাল থেকেই নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করা ইসলামিক জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতা এককভাবে পরিচালনা করে আসছে। বর্তমান সরকারের একটা বড় উদ্যোগ হচ্ছে প্রাচীন 'সিল্করোড'কে পুনরুজ্জীবিত করা। এই 'সিল্করোড' এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র ঘটিয়েছে। প্রায় চার হাজার মাইল বিস্তৃত এই 'সিল্করোড' চীন থেকে শুরু। চীনা ব্যবসায়ীরা চীন থেকে সঙ্গে করে আনতেন সিল্ক কাপড়, সার্টিন, চা ও পোরসেলানের দ্রব্যাদি। সাগর রুটে তারা ভারতে আসতেন। এখান থেকে নিয়ে যেতেন মসলা, হাতির দাঁত এবং অলঙ্কারাদি। যেহেতু চীনারা সিল্ক কাপড়ের ব্যবসা করতেন, সে কারণেই তাদের ব্যবহৃত পথটি 'সিল্করোড' হিসেবে পরিচিত।
তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু মধ্য এশিয়ার দেশগুলো কেন, আমাদের জন্যও একটা আশার সঞ্চার করেছে। মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগও বাড়ছে। চলতি ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ২২২ বিলিয়ন ডলার। তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ইউরোপের কোনো দেশের চেয়ে কম নয়। সুতরাং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে আমরা উপকৃত হতে পারি। বাংলাদেশে তুরস্কের বিনিয়োগ বাড়তে পারে। দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ রয়েছে তুরস্কে। আমরা এই উদ্যোগটি নিতে পারি। এখন প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফরের মধ্য দিয়ে এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হল।
তথ্যসূত্র:  দৈনিক ডেসটিনি
১৮ এপ্রিল ২০১২.
অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান

0 comments:

Post a Comment