গত সোমবার ১৮ দলীয় জোটের বিক্ষোভ কর্মসূচি ও ঢাকায় বিএনপি অফিসের সামনে জনসভার পর বিএনপি অফিসে পুলিশের তল্লাশি এবং শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারের পর একটা প্রশ্ন এখন অনেকের মাঝেই উঠেছে। আর তা হচ্ছেÑ দেশ এখন কোন পথে? ১৮ দলের বিক্ষোভ কর্মসূচি ও জনসভা ছিল পূর্বঘোষিত। কিন্তু ওই জনসভায় শেষ পর্যায়ে যা ঘটল, তা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিবিসির (বাংলা) ভাষ্য থেকে জানা গেছে, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল সেই জনসভা। পুলিশের ভূমিকা ছিল অনেকটা পর্যবেক্ষকের। এক পর্যায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যখন বক্তৃতা শেষ করছিলেন, তখন বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তারপর যা ঘটল, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাসহ গ্রেফতার হলেন শতাধিক নেতাকর্মী। টিভি চ্যানেলে দেখলাম মহাসচিবের কক্ষ ভেঙে পুলিশ গ্রেফতার করছে কর্মীদের। পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবারের হরতালের অজুহাত খুঁজতেই বিএনপি এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। তারা পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে, এ কথাও বলেছে পুলিশ। শুধু তাই নয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপির অফিস থেকে বেশ কয়েকটি ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে। সংঘর্ষের পর খালেদা জিয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির মিটিং করেন এবং বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয় যদি বৃহস্পতিবারের মধ্যে নেতাদের ছেড়ে দেয়া না হয়, তাহলে আগামী ১৮ ও ১৯ তারিখ আবার হরতাল পালন করা হবে। গতকাল মঙ্গলবারও ১৮ দল হরতাল পালন করেছে। এদিন দুপুরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী মুক্তি পাওয়ার পর ১৮ ও ১৯ তারিখের হরতালের ব্যাপারে দলীয় সিদ্ধান্ত কী হবে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
সোমবারের অনাহূত ঘটনায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রমাণ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি জোটের (মহাজোট ও ১৮ দলীয় জোট) মাঝে আস্থার সংকট রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, বিএনপি তথা ১৮ দল হরতালের অজুহাত খুঁজছিল। আর এজন্যই তারা সোমবার সহিংস হয়ে উঠেছিল। এ বিতর্কে না গিয়ে যা বলা যায় তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যখন একটি সংলাপের কথা বলেছেন, তখন পুলিশি অভিযান, গ্রেফতার কাম্য নয়। হরতাল হল। আবারও হরতাল হবে। কেন বিরোধী দলকে হরতাল ডাকতে হয়, এটা যদি নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে এ ধরনের হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল নিষিদ্ধের আইন করেও কিছু হবে না। হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল সাধারণ মানুষ তো বটেই, সরকার ও বিরোধী দল, কারও জন্যই কোন মঙ্গল ডেকে আনে না। বিগত কয়েকদিনের হরতালে গাড়ি পুড়েছে, ট্রেনের বগি পুড়েছে, মানুষ মারা গেছেÑ এ ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই। পুলিশের আরও মানবিক ও সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম) ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সিবিএম বা আস্থার সম্পর্ক গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। সিবিএম না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। বিঘিœত হবে সুশাসন। আর রাষ্ট্র ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে। এদেশে অনেক সম্ভাবনা আছে। এ সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। রাজনীতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব সবার। বিরোধী দল ‘শত্র“’ নয়, বিরোধী দল গণতন্ত্রের ভাষায় ‘সরকারের একটি অংশ’। একজন সংসদ সদস্যকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে (অথবা ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়ে!) বিরোধী দল যে সরকারের একটি অংশ, তা প্রমাণ করা যাবে না। বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়াটা জরুরি। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা করতে হবে বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়েই। আর অফিসে হামলা ও নেতাদের গ্রেফতার সংকটকে আরও গভীরতর করবে মাত্র।
এদেশ ‘মহাসংকটে দেশ’Ñ এ অভিমত অনেকের। এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ফেব্র“য়ারিতে (২০১৩) মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ব্যাপক হারে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ফেব্র“য়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ)। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ)। ঢাকায় অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকরা চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যখন সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, থানা আক্রমণ করা হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়Ñ এসব আমাদের জন্য ভালো কোন খবর নয়। তাই বিদেশী কূটনীতিকরা যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তখন সরকারের উচিত এ উদ্বেগকে বিবেচনায় নেয়া। ডা. দীপু মনি কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি পুরো ঘটনার জন্য বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে চেয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ ধারণাকেই সমর্থন করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলুক। তবে শাহবাগ চত্বরের তরুণ প্রজš§কে ঘরে ফিরে যেতে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবে দীর্ঘদিন এ আন্দোলন চললে তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এরই মধ্যে সে ধরনের একটি আলামতই পাওয়া গেছে। গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামে একটি জনসভা আহ্বান করেছিল ১৩ মার্চ। কিন্তু তা প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে ইসলামপন্থীদের একটি জোট হেফাজতে ইসলাম। তারা ওইদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতালও আহ্বান করেছে। হেফাজতে ইসলামীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহামদ শফি। হেফাজতে ইসলামীর সঙ্গে জামায়াত জড়িত নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে রোববার হাটহাজারী মাদ্রাসায় একটি দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই মাহফিলে ইসলামবিরোধী অপপ্রচার ও হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিয়ে অবমাননাকর ও কুরুচিপূর্ণ লেখার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রয়োজনে ‘শহীদী মৃত্যু’ বরণ করে নেয়ার শপথ নেয়া হয় (সমকাল, ১১ মার্চ)। যে কোন বিবেচনায় এ সংবাদটি উদ্বেগের। অতীতে কখনও আল্লামা শাহ আহামদ শফির নাম তেমন একটা শোনা যায়নি। বয়োবৃদ্ধ এ আলেম মানুষটি সক্রিয় হলেন শুধু একটি কারণেÑ আর তা হচ্ছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিয়ে অবমাননাকর লেখা, যা বিভিন্ন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আস্থায় নেয়া যায়নি। উপরন্তু গণজাগরণ মঞ্চ সরকারের সমর্থন নিয়ে একের পর এক জনসভা করে যাচ্ছে। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, এটা প্রচার করলেও তাতে সাড়া দেয়নি ইসলামপন্থীরা। গণজাগরণ মঞ্চ তাদের চট্টগ্রামের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে চাইছে। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। ওই সিদ্ধান্ত সংঘাত বাড়াবে মাত্র। আজ শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে সবাইকে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা হল, সরকার ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে পারেনি। জামায়াতকে টার্গেট করতে গিয়ে সব ইসলামপন্থীকে টার্গেট করা হয়েছে। শেষের দিকে সরকার ভুল ভাঙানোর উদ্যোগ নিলেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। গণজাগরণ মঞ্চ যদি তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, তাহলে ইসলামপন্থীরাও তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। সরকার সব ফ্রন্ট ‘ওপেন’ করবে এটা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন আর বিএনপির আন্দোলন এক নয়। বিএনপি তথা ১৮ দল এখন এক দফায় গেছে। যদি সংলাপ না হয়, তাহলে সংকটের গভীরতা আরও বাড়বে। সংঘাত আরও বাড়বে। মানুষ থাকবে আতংকে।
রাজনীতি এখন ‘নো-রিটার্ন’ পর্যায়ে চলে গেছে। কেউ কারও অবস্থান থেকে এতটুকু পিছপা হতে রাজি নন। সংলাপের কথা মুখেই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু বাড়ছে সহিংসতা। এ সহিংসতা কোন সমাধান নয়। এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে না। আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা। সরকার হচ্ছে অভিভাবক। তাকে সহনশীল হতে হবে। নেতাদের হঠকারী বক্তব্য দেয়া পরিহার করতে হবে। আর বিরোধী দলকেও আগ্রহী হতে হবে সংলাপের ব্যাপারে। এটা ছাড়া এ মুহূর্তে কোন বিকল্প নেই। হরতাল আহ্বান করা ছাড়া বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের হয়তো বিকল্প কিছু ছিল না। কিন্তু মনে রাখতে হবে হরতাল কোন সমাধান বয়ে আনবে না। একমাত্র সংলাপই পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উপহার দিতে এবং সমাধানের একটা পথ বাতলে দিতে। মির্জা ফখরুলসহ কয়েকজন নেতা মুক্তি পাওয়ায় সংলাপের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলা যায়। তাই আমরা চাইব, শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং জাতি এক ‘মহাসংকট’ থেকে মুক্তি পাক।
Daily JUGANTOR
13.3.13
0 comments:
Post a Comment