রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একুশ শতকে একজন সমাজতন্ত্রীর বিদায়


তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নের জাদুকর। হুগো শাভেজ। এখন প্রয়াত। একুশ শতকের বিপ্লবী। একুশ শতকের সমাজতন্ত্রী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বজুড়ে যখন একের পর এক সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছিল, তখন হুগো শাভেজ জন্ম দিয়েছিলেন এক নতুন ধরনের সমাজতন্ত্রের। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে কিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করা যায়। ভেনিজুয়েলা এর বড় প্রমাণ। হুগো শাভেজ মার্কসবাদী ছিলেন না। কিন্তু মার্কসবাদের মূল স্পিরিটকে তিনি ধারণ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে তাঁর এই সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মার্কসবাদী রাষ্ট্রের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। এমনকি চীন 'সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি' প্রবর্তন করলেও, হুগো শাভেজ এই রাজনীতিকেও গ্রহণ করেননি। তবে তাঁর প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতির সঙ্গে কেউ কেউ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা মাও জে দং-এর চীনা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্রের কিছুটা মিল পাবে, এটা সত্য; কিন্তু তিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ছিলেন উজ্জ্বল। যদিও ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদ তাঁকে আজকে এই অবস্থানে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। যদি ভেনিজুয়েলার তেল সম্পদ না থাকত, তাহলে তাঁর পক্ষে একজন 'আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী' হয়ে ওঠা সহজ ছিল কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। হুগো শাভেজের সাফল্য এখানেই যে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদে নিজে সম্পদশালী হননি। দেশকে যেমনি অর্থনৈতিকভাবে সম্পদশালী করেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর সম্পদের ভাগিদার করেছেন লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোকে। তাঁর Petrocaribe Programm-এর মাধ্যমে টিকে আছে কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দেশের অর্থনীতি। এ অঞ্চলের ১৭টি দেশ এই Petrocaribe Programm-এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। কিউবার জ্বালানি তেলের উৎস হচ্ছে ভেনিজুয়েলার তেল। মোট চাহিদার তিন ভাগের দুই ভাগ সরবরাহ করে ভেনিজুয়েলা। প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল কিউবায় সরবরাহ করে ভেনিজুয়েলা। কিউবা এই তেল ক্রয়ের অর্থ পরিশোধ করে অন্যভাবে। কিউবার প্রায় ৩৫ হাজার ডাক্তার, নার্স ও শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলাসহ ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতে কাজ করছে। কিউবা সরকার তাদের বেতন দিচ্ছে ভেনিজুয়েলার দেওয়া তেলের বিনিময় অর্থ হিসেবে। আর এভাবেই হুগো শাভেজ লাতিন আমেরিকা তথা ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছিলেন। তিনি গত ছয় বছরে নিকারাগুয়ার বামপন্থী সান্ডানিস্ট ওর্তেগা সরকারকে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে নিকারাগুয়ার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছেন। ডমিনিক ভেনিজুয়েলার কাছে ঋণী তিন বিলিয়ন ডলার। প্রতিদিন সেখানে সরবরাহ করা হয় ৩০ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো সাধারণত নগদ অর্থে ভেনিজুয়েলার তেলের অর্থ পরিশোধ করে না। আখ, চিনি, চাল, বিন্স ইত্যাদি বার্টার বাণিজ্যের মাধ্যমে এই অর্থ পরিশোধ হয়। আর সুযোগ দেওয়া হয় ১৭ থেকে ২৫ বছর। এ অঞ্চল ঘিরে তিনি মার্কিনবিরোধী একটি জনমত গড়ে তুলেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী সিমন বলিভার (১৮১৩) হচ্ছেন তাঁর আদর্শ। সিমন বলিভার একদিন যেমনি স্পেনীয় শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, একুশ শতকে এসে শাভেজের সংগ্রাম ছিল অনেকটা তেমনি। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, খোদ যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত থেকে তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে (সিনিয়র) 'শয়তান' হিসেবে গালি দিয়েছিলেন। তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি আমেরিকার কাছে তেল বেচবেন না। তাঁর 'যুদ্ধ' ছিল মূলত আমেরিকার করপোরেট হাউসগুলোর বিরুদ্ধে। তাঁর সমস্যা ছিল একটাই- ভেনিজুয়েলার বিপুল তেলসম্পদ। সিআইয়ের মতে, এই তেল রিজার্ভের পরিমাণ ১ দশমিক ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কি না সৌদি তেল রিজার্ভের চেয়েও বেশি। ২০০১ সালে (১৯৯৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হন) তিনি কংগ্রেসে Low of Hydrocarbon পাস করেন। আর এটা করতে গিয়ে তিনি মার্কিনি তেল কম্পানিগুলোর শত্রুতে পরিণত হন। এসকন, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, শেল, সেভরন সবারই আঁতে ঘা লেগেছিল ওই আইনটি পাস করার ফলে। ওই সব তেল কম্পানি সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের 'ম্যানেজ' করে ভেনিজুয়েলার জ্বালানি সম্পদ লুটেপুটে খেত। আগে তেল সম্পদের ৮৪ ভাগ পেত ওই সব তেল কম্পানি। শাভেজ তা কমিয়ে এনে করলেন ৭০ ভাগ। সুতরাং তেল কম্পানিগুলোর বোষানলে পড়ে তিনি অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা হারিয়েছিলেন ২০০২ সালের এপ্রিলে। শাভেজকে বন্দি করে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কোনো একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই সময় মার্কিনি তেল কম্পানিগুলো সংসদের চেয়ারম্যান পেডরো কারমোনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণাও করেছিল। কারমোনা নিজে ওই তেল কম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করতেন। তৎকালীন কারাকাসে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত চার্লস শাবিরোর ভূমিকাও লক্ষ করার মতো ছিল। কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শাভেজকে ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল অভ্যুত্থানকারীরা। কেননা, তত দিনে জনসমর্থন চলে গেছে শাভেজের পক্ষে। বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কারাকাসসহ অন্য শহরগুলোতেও। মার্কিন করপোরেট হাউসগুলো নিজেরাই 'এক একটি রাষ্ট্র'। তাদের বাজেট অনেক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি। ইতিহাসে আছে, মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকা যায় না। মোসাদ্দেক পারেননি ইরানে ১৯৫৩ সালে, যখন তিনি তেল কম্পানিগুলো জাতীয়করণ করেছিলেন। পারেননি আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট এলসিকে ১৯৯৩ সালে, যখন তিনি কাসপিয়ান সাগরে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের স্বার্থে আঘাত করেছিলেন। উল্লেখ করা যায়, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট আলফ্রেডো পালাসিওর নামও, যখন তিনি (২০০৫) বহুজাতিক তেল কম্পানি অক্সিডেন্টালের সব সুযোগ-সুবিধা বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পেরেছিলেন শাভেজ। তাঁকে উৎখাত ও হত্যার চেষ্টা করা হলেও তিনি বারবার বেঁচে গেছেন। শুধু বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলোই নয়, বরং মার্কিন বিলিওনিয়ান কচ ব্রাদার্স ও সেই সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হাইনজের (Heinz) সঙ্গেও তিনি বিরোধে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, এই কম্পানির মালিক মিসেস হাইন্জ হচ্ছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির স্ত্রী। হাইন্জ কম্পানির (সারা কেচআপ তৈরি করে) বিশাল বিনিয়োগে ছিল ভেনিজুয়েলায়। শত শত বিঘা সরকারি সম্পত্তি হাইন্জ তাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছিল এবং সেখানে টমেটোর বাগান তৈরি করেছিল। শাভেজ ক্ষমতায় এসে ওই বন্দোবস্ত বাতিল করে দেন। ফলে হাইন্জ কম্পানি তার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে ও শ্রমিকদের বরখাস্ত করে ২০০১ সালে। শাভেজ বন্ধ কারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন এবং সব শ্রমিককে পুনর্বহাল করেছিলেন।
শাভেজের একটা বড় অবদান হচ্ছে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে তিনি ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের বের করে আনতে পেরেছিলেন। শাভেজ ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ভেনিজুয়েলার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ, যারা negroe indio (Black and indian) হিসেবে পরিচিত (জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ), তাঁরা থাকতেন অনেকটা বস্তিঘরে। তাঁদের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল না। আজ প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ, সব ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শিক্ষা শাভেজ নিশ্চিত করেছেন। দারিদ্র্য কমিয়ে এনেছেন। ১৯৯৮ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪৯.৪ ভাগ, সেখানে ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৫ ভাগে। এ পরিসংখ্যান জাতিসংঘের। ১৮টি লাতিন আমেরিকাভুক্ত দেশের মধ্যে ভেনিজুয়েলার আর্থসামাজিক অবস্থা সবচেয়ে ভালো। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের দিক ও আয়-বণ্টনের দিক দিয়ে ভেনিজুয়েলার অবস্থান তৃতীয়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ভেনিজুয়েলায় বর্তমানে ৫০ মিলিয়ন মধ্যবিত্ত রয়েছে, যাঁরা এক নতুন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন সেখানে। তাঁকে বলা হয় এ যুগের 'সিমন বলিভার'। সিমন বলিভার স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলেন। আর শাভেজ যুদ্ধ করে গেছেন বিশ্বব্যাপী মার্কিনি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। এটা করতে গিয়ে কিংবা বলা যেতে পারে, তাঁর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকার কারণে বলিভিয়ার মোরালেস, ইকুয়েডরের রাফায়েল কারিয়া কিংবা নিকারাগুয়ার ওর্তেগার সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সখ্য তৈরি হলেও, সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনীতির অধিকারী ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল চমৎকার। জীবিতকালীন সময়ে তিনি লিবিয়ার প্রয়াত নেতা গাদ্দাফির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একই সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকেও সমর্থন করে গেছেন তিনি। এর পেছনে কাজ করেছিল তাঁর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা। লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন ALBA বা The Bolivarian Alliance for the Peoples of our America নামক সংগঠনটি, যার সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১০। সিমন বলিভার সমগ্র লাতিন আমেরিকার জনগণকে American হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। শাভেজও বলতেন সে কথা। একই সঙ্গে CELAC বা The Community of Latin America and caribbeam state গঠনের উদ্যোক্তাও তিনি। দরিদ্র, বস্তিবাসী সাধারণ মানুষকে নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর দর্শন ছিল সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা। আর এটা করতে গিয়ে তিনি সিমন বলিভারের মতো বিপ্লবীকে বেছে নিয়েছেন আদর্শ হিসেবে। বলতেন, Bolivar is the fight that does not end, he is born every day in aurselves in his people, in the children, in the fight for life and social Justice। কেউ কেউ তাঁর এই আন্দোলনকে চিহ্নিত করেছেন Chavismo হিসেবে। কিন্তু একটি অভিযোগও আছে। Mestizo বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে রাজনীতি, সেই রাজনীতি নতুন এক শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে ভেনিজুয়েলায় boli bourgeoisic. একটা ভয় ভেনিজুয়েলাকে নিয়ে রয়েই গেছে। লাতিন আমেরিকার ইতিহাস বলে, একটি বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর প্রতিবিপ্লবের জন্ম হয় সংঘাত আর বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। গুয়েতেমালা (১৯৫৪), চিলি (১৯৭৩), আর্জেন্টিনা (১৯৭৬), নিকারাগুয়া (১৯৯০) কিংবা কলম্বিয়া (১৯৪৮) এর বড় প্রমাণ। হুগো শাভেজ একটি 'বিপ্লব' সম্পন্ন করেছেন। ভেনিজুয়েলার mestizo শ্রেণী এই 'বিপ্লবকে' এখন সামনে নিয়ে যেতে পারবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। হুগো শাভেজ ইতিহাসে একজন 'বিপ্লবী' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, হুগো শাভেজ- এই নামগুলো এখন উচ্চারিত হবে একসঙ্গে। বারবার।
Daily Kalerkontho11.3.13

0 comments:

Post a Comment