রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শুভবুদ্ধির উদয় হোক


প্রকাশ্য রাস্তায় শুয়ে আছেন দুই নারী। না, প্রকাশ্যে তাদের শুয়ে থাকার কথা নয়। তারা তা করেনওনি। দু\'জন নারীর একজন সংসদ সদস্য, হোক না বিরোধী দলের। অপরজন পুলিশি পোশাকে কনস্টেবল। দৈনিক সমকাল ৮ মার্চ যে ছবি প্রথম পাতায় ছেপেছে, তা অনেক কথা বলে। সারা জাতি যখন ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছে, যখন নারী অধিকার নিয়ে একাধিক প্রচ্ছদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ঠিক তখনই পাঁচ কলামব্যাপী সমকালের ছবিটি দেখিয়ে দিল বাংলাদেশে নারী অধিকার কীভাবে লঙ্ঘিত হয়! কীভাবে শাম্মী আক্তার এমপি মাইক্রোবাস থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, কীভাবে অনেকটা অচেতন অবস্থায় শরীফা পড়ে আছেন কালো রাজপথে, আমি সে প্রশ্ন তুলব না। আমি প্রশ্ন তুলব চারজন এমপির, যারা নারী, তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি-না? চারজন এমপিকে পুলিশ জোর করে মাইক্রোতে তুলেছে_ এ সংবাদ ছাপা হয়েছে প্রতিটি সংবাদপত্রে। টিভি চ্যানেলের কভারেজেও দেখা গেছে সে ছবি। ধরে নিচ্ছি, তারা আইন ভঙ্গ করে হরতালের কর্মসূচি পালন করছিলেন! কিন্তু তাই বলে চারজন সাংসদকে এভাবে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে হবে? সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের যে সম্মান ও অধিকার তা কি তারা পেয়েছেন? একজন সাংসদ যদি এভাবে অপমানিত হন, তাহলে গোটা সংসদই অপমানিত হয়। পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। এর আগেও সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে প্রকাশ্যে পিটিয়েছিল পুলিশ। রাষ্ট্র সেই সদস্যকে পুরস্কৃত করেছিল। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, \'ওই পেটানোর জন্যই তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।\' এভাবে পত্রিকায় সংবাদটি ছাপা হয়েছিল। সেদিন আমি মর্মাহত হয়েছিলাম। একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এভাবে কথা বলতে পারেন না। আমাদের আস্থার জায়গাটা তাহলে নষ্ট হয়ে যায়। জয়নুল আবদিন ফারুক এমপি যদি সেদিন পুলিশকে প্ররোচিত করে থাকেন, তাহলে প্রচলিত আইনে তাকে গ্রেফতার বা বিচার করা যেত। কিন্তু এভাবে পেটানো! গায়ের জামা খুলে নেওয়া! আজ এমপি শাম্মী আক্তারের ক্ষেত্রে যা ঘটল, তা নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমি দুঃখিত এ কারণে যে, \'ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সিতে একজন সংসদ সদস্যের অবস্থান অনেক ওপরে। এই প্রবণতা ভালো নয়। সংসদীয় রাজনীতিতে এটা একটা \'কালো অধ্যায়\'।
দেশ একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটের কারণে ইতিমধ্যে অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যে ৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, কী ছিল তাদের দোষ? তারা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। এই হত্যার দায়ভার কে নেবে? আমরা কি পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সাধারণ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলছি না? এই প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়বে। এটা ভালো নয়। জাতির জন্য মঙ্গলও নয়। বলেছিলাম, সমকালের ৮ মার্চের ছবি অনেক কথা বলে। একজন নারী এমপি রাস্তায় পড়ে থাকবেন অচেতন অবস্থায়, তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ভালো খবর নয়। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে। পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যেহেতু এ ঘটনায় একজন এমপি জড়িত, এ কাজটি করতে পারেন সংসদের স্পিকারও। যদিও এলাকাটি জাতীয় সংসদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তারপরও সংসদের অভিভাবক হিসেবে তিনি এ কাজটি করতে পারেন। সৈয়দ আশরাফের একটি বক্তব্যকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। তিনি বলেছেন, বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে প্রস্তুত সরকার। আমি বিশ্বাস রাখতে চাই, এটা কথার কথা নয়। সৈয়দ আশরাফ আন্তরিক হবেন এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সঙ্গে একটা \'সংলাপ\' শুরু করবেন। বোধকরি শুধু বিদেশি দাতাদেরই কথা এটা নয়। এটা সব দেশবাসীর কথা। সংলাপ হোক। সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপ হতে হবে। আমি জানি, সংলাপে কোন কোন বিষয় আলোচিত হবে। তারপরও প্রক্রিয়া শুরু হোক। দেশবাসী স্বস্তিতে থাকুক। ব্যবসায়ী নেতারা ঘন ঘন হরতাল বন্ধের ডাক দিয়েছেন। আমি এর সঙ্গে একমত। এই হরতাল বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। আরএমজি সেক্টরের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বদলে বিকল্প খুঁজছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরএমজি ক্রেতাদের কাছে মিয়ানমার এখন বড় সম্ভাবনা তৈরি করছে। হরতাল চাই না বটে, কিন্তু হরতাল কেন হয়, এটাও বিবেচনায় নিতে হবে। কেন বিরোধী দলকে হরতাল ডাকতে হয়, এটা যদি সরকারের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে এ ধরনের হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল নিষিদ্ধের আইন করেও কিচ্ছু হবে না। হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল সাধারণ মানুষ তো বটেই, সরকার ও বিরোধী দল, কারও জন্যই কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। গত কয়েকদিনের হরতালে গাড়ি পুড়েছে, ট্রেনের বগি পুড়েছে, মানুষ মারা গেছে_ এই ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই! পুলিশের আরও মানবিক ও সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি \'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস\' (সিবিএম) ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সিবিএম বা আস্থার সম্পর্ক গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। সিবিএম না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। বিঘি্নত হবে সুশাসন। আর রাষ্ট্র ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে। এ দেশে অনেক সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। রাজনীতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব সকলের। এখানে বিরোধী দল \'শত্রু\' নয়, বিরোধী দল গণতন্ত্রের ভাষায় \'সরকারের একটি অংশ\'। একজন সাংসদকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে (অথবা ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়ে!) \'বিরোধী দল যে সরকারের একটি অংশ\', তা প্রমাণ করা যাবে না। বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়াটা জরুরি। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা করতে হবে বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়েই।
\'মহাসংকটে দেশ\'_ সমকালের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে (২০১৩) মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ব্যাপক হারে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। পয়েন্ট টু পয়েন্টে ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ)। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ০২ শতাংশ)। ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকরা চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যখন সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, থানা আক্রমণ করা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়_ এসব আলামত আমাদের জন্য ভালো কোনো খবর নয়। তাই বিদেশি কূটনীতিকরা যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তখন সরকারের উচিত এই উদ্বেগকে বিবেচনায় নেওয়া। ডা. দীপু মনি কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সম্ভবত তিনি পুরো ঘটনার জন্য বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তা এই ধারণাকেই সমর্থন করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলুক। তবে শাহবাগ চত্বরের তরুণ প্রজন্মকে ঘরে ফিরে যেতে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবে দীর্ঘদিন এই আন্দোলন চললে, তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
গায়ক হায়দার হোসেন তার একটি গানে বলেছিলেন, \'৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাকে খুঁজছি! তার এই \'স্বাধীনতা\' হচ্ছে একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ, একটি সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ। একটি বাংলাদেশ যেখানে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি থাকবে না। হায়দার হোসেনের সঙ্গে দ্বিমত করা যাবে না। আজকের যে বাংলাদেশ, সমকালের ভাষায় \'মহাসংকটে যে দেশ\' সেখানে স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক ঐক্য, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখার যে রাজনীতি, সেই \'রাজনীতি\'ই পারে সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই কামনা করি।
Daily Samakal
12.3.13

0 comments:

Post a Comment