রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সম্পর্ক নিয়ে যাবে আরো উচ্চতায়



ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর শেষ করলেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নীতি নির্ধারণীতে অংশ নেন না। কিন্তু ব্যক্তিটি যেহেতু প্রণব মুখার্জি, সেহেতু তার এ সফরকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। কেননা অতীতে মন্ত্রী থাকার সময় বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো তিনিই দেখাশোনা করতেন। সে কারণেই আমাদের সংবাদপত্র ও বিশ্লেষকরা যেমনি এ সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, ঠিক তেমনি ভারতীয় বাংলা পত্রপত্রিকাও এ সফরকে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি এসেছিলেন মূলত মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ তাকে যে সম্মাননা দিয়েছে, তা বহন করতে। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী তথা একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ প্রমাণ করে দুদেশের মাঝে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোর ব্যাপারেও তিনি সিরিয়াস। তার সফরে কিছু ‘ব্যক্তিগত কর্মসূচি’ থাকলেও ওই সফর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরো উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, ১৯৭৪ সালের পর এই দ্বিতীয়বারের মতো একজন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে এলেন। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা যে বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দেন, এটা তার বড় প্রমাণ। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ‘ঘনিষ্ঠ ও গভীরতর সম্পর্ক রচনার বিষয়টি সবসময় আমার হূদয় স্পর্শ করে।’ তিনি বাংলাদেশের তারুণ্যের উত্থানকে সম্মান জানিয়েছেন। তিনি প্রত্যাশা করেছেন, বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ, শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা, আইনের শাসন ও মানবাধিকার অক্ষুণ্ন রাখার সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। এ ধরনের মন্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি। বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের নীতির মূল কথা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও বহুদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের চলমান যোগাযোগ।’ আর এ নীতির আলোকেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে গেল বছর আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নয়াদিল্লি। এমনকি এরশাদও নয়াদিল্লি সফর করেছিলেন। যদিও নিরাপত্তার প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়া এবার প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে পারলেন না। কিন্তু এতে করে ভারতীয় নীতিতে পরিবর্তন আসবে— এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক ভারতীয় মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা একাধিকবার ভারত সফর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ভারত আমাদের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা কারণে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনীতি, তাতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘ঐক্য’ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ সেই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। উপরন্তু ভারত একটি অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলীর মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত শিল্পের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তখন মাথাপিছু আয় ৯৪০ থেকে ২২ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত যেখানে অবদান রাখত মাত্র দুই ভাগ, তখন অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। সুতরাং এ অর্থনীতির প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর পড়বেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, একটি বড় দেশের পাশে যদি একটি ছোট দেশ থাকে, তাহলে ওই বড় দেশ ছোট দেশের ওপর প্রভাব খাটায়। মেদভেদেভের (সাবেক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) ধারণা, ‘Zone of privileged interest’ অনেকটা এ ধারণাকেই সমর্থন করে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অতিমাত্রায় ‘ভারতমুখিতা’ সম্প্রতি বিতর্কের মাত্রা বাড়ালেও বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা ভারতের ‘প্রভাব’ থেকে বের হয়ে আসতে পারব না। তবে এক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা এক জায়গায়— দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। আমাদের ‘প্রাপ্তি’ এখানে কম, ভারতের ‘প্রাপ্তি’ অনেক বেশি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালেই প্রধানমন্ত্রী ভারত গেছেন। ফিরতি সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। এ ধরনের সফর ও পাল্টা সফরের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি ‘ফ্যাক্টর’। বেগম খালেদা জিয়া এটাকে বিবেচনায় নিয়েই ভারতে গিয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়া ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। চীন সফরের সময় চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জি জিন পিং, যিনি মার্চে (২০১৩) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, বেগম জিয়াকে সাক্ষাত্কার দেন। এর পর পরই বেগম খালেদা জিয়া যান নয়াদিল্লি। তবে চীনের চেয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা না থাকলেও ভারতের সঙ্গে আমাদের একাধিক সমস্যা রয়েছে, যার জট খোলেনি। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর কিংবা প্রণব মুখার্জির সর্বশেষ ঢাকা সফরের পরও সমস্যার কতটুকু সমাধান হবে, সে প্রশ্ন রয়েই গেল। কেননা রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি প্রত্যাশা করেছেন সব সমস্যার সমাধান হবে। অতীতেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় (২০১১) এ আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা যা ছিল, তা রয়ে গেছে। বিশেষ করে বলা যায়, বাংলাদেশ বড় ধরনের ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। গঙ্গার পানিবণ্টনে একটি চুক্তি হয়েছে বটে। কিন্তু পানি আমরা পাচ্ছি না। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগেই উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। তিস্তার পানিবণ্টনে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। পশ্চিম বাংলার আপত্তিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। সমস্যাটা ভারতের, সমাধান তাদেরই করতে হবে। বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দেয়া যে, আন্তর্জাতিক নদী আইন আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করছে। আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারি না। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। খোদ ভারতের অভ্যন্তরে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে এই দুটো প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা পানি শূন্য হয়ে যাবে। মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের মানুষ এটা সহ্য করে নেবে না। বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বোঝাতে হবে। দেশ হিসেবে আমরা ‘ছোট’ হতে পারি। কিন্তু আমরা সমমর্যাদার অধিকারী। ভারতের আচরণে সেই সমমর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে না। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আদৌ হবে, তা আমি মনে করতে পারছি না। এখানে ‘মমতা ফ্যাক্টর’ অন্যতম একটি বাধা, যদিও প্রণব মুখার্জি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিস্তা চুক্তি হবে। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। মমতাকে বোঝাতে ও রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশ তা অনুমোদন করেছিল। কিন্তু অনুমোদন করেনি ভারত। কারণ এ চুক্তি অনুমোদন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ভারত সরকার সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ নিয়েছে বটে, কিন্তু আপত্তি তুলেছে বিজেপি। সুতরাং বিষয়টি আবার ঝুলে গেল। সীমান্ত হত্যা প্রতিনিয়ত হচ্ছে। ভারত কথা দিয়েও কথা রাখেনি। ভারত ট্রানজিটের নামে করিডর পেলেও আমরা ট্রানজিট পাইনি। অশুল্ক বাধা দূর হয়নি। বাণিজ্যে যে ভারসাম্যতা, তা দূর করার কোনো উদ্যাগ নেই। তাই সম্ভাবনার একটা ক্ষেত্র তৈরি হলেও তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শুধুমাত্র ভারতের কারণে।
প্রণব বাবুর ঢাকা সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় পরিবর্তন আসবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে যে সম্মান দিয়েছে, তা এক কথায় বিরল। বাংলাদেশ বন্ধুত্বকে সম্মান জানাতে জানে। এখন পালা ভারতের। সামনে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই সাধারণ নির্বাচন। বাংলাদেশের নির্বাচনে ‘ভারত ফ্যাক্টর’ একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আমরা প্রত্যাশা করব প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের পর দুদেশের মাঝে বিভিন্ন ইস্যুতে যে বিরোধ রয়েছে, তা সমাধানে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এগিয়ে আসবেন। তবে অনেক প্রশ্ন উঠেছে তার সফরের পর, প্রণব মুখার্জি এ সফরে তরুণ প্রজন্মকে সমর্থন ও গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালীকরণের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা কোনো কোনো ভারতীয় গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি এক ধরনের সমর্থন বলেই গণ্য করা হচ্ছে। এমনো কথা বলা হচ্ছে, ‘মৌলবাদ বিরোধিতার বার্তা দিলেন রাষ্ট্রপতি’ (সংবাদ প্রতিদিন, ৫ মার্চ)। ‘হাসিনার পাশে আছে ভারত, এ বার্তা প্রণবের’ এমন মন্তব্যও করেছে কোনো কোনো গণমাধ্যম (বর্তমান, ৪ মার্চ)। কোনো কোনো গণমাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতকে মুসলিম ব্রাদারহুডের (মিসর) সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, ‘জামায়াত ক্ষমতায় এলে ভারত সমস্যায় পড়বে’ (সংবাদ প্রতিদিন)। বেগম খালেদা জিয়া নিরাপত্তার অভিযোগ তুলে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তার নির্ধারিত সাক্ষাত্কার বাতিল করেছেন। এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজারের মন্তব্য ছিল এরকম, ‘তার এই পদক্ষেপ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তো বটেই, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী বার্তা দিল।’ এ ধরনের মন্তব্যের পরও যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে প্রণব বাবুর এ সফরের মধ্য দিয়ে ‘বড় কিছু’ হয়তো অর্জিত হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ যে তার বন্ধুদের সম্মান দিতে জানে, তা প্রমাণিত হলো। ভারতের নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের সম্মান আরো বাড়ল। ‘বাংলাদেশ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায় ভারত’— সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এ ধরনের একটি খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মন্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকবে এবং সব দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারে বর্তমান মহাজোট সরকারকে উত্সাহিত করবে— এটা বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। তার সফরের সময় টানা তিন দিন হরতাল হলো। একটি ককটেলও বিস্ফোরিত হলো তার হোটেলের সম্মুখে। এটা দুঃখজনক। এ ধরনের ঘটনা ভুল সিগন্যাল পৌঁছে দিতে পারে নয়াদিল্লিতে। তার পরও প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
Daily Bonik Barta
09.03.13

0 comments:

Post a Comment