রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস কীভাবে চাভেজকে স্মরণে রাখবে






ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট উগো চাভেজের মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি এখন বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো, ইতিহাস এখন কীভাবে চাভেজকে স্মরণে রাখবে? একজন সমাজ সংস্কারক, যিনি ভেনিজুয়েলার Mestizo বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে একটি নতুন জীবন দিয়েছিলেন? নাকি একজন ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রী’, যিনি সিমন বলিভারের আদর্শ অনুসরণ করে পুরো লাতিন আমেরিকা থেকে মার্কিন স্বার্থ উত্খাত করতে চেয়েছিলেন? সত্যিই একজন বিপ্লবী, যিনি লেনিন, মাও জে ডং, হো চে মিন আর কাস্ত্রোর পাশে নিজের নামটিও লেখাতে চেয়েছিলেন? এক ধরনের ‘পপুলিজমে’র জন্ম দিয়েছিলেন চাভেজ। লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে এ ধরনের ‘পপুলিজম’ বা জনস্বার্থ-সম্পর্কিত আন্দোলন নতুন কোনো ঘটনা নয়। আর্জেন্টিনায় পেরেন, কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা ব্রাজিলের লুলা ডিসিলভা এক ধরনের ‘পপুলিজমে’র জন্ম দিয়েছিলেন, যা তাদেরকে নিজ নিজ দেশে তো বটেই, পুরো লাতিন আমেরিকায় একেকজন প্রবাদ পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ কাতারে যোগ হলো চাভেজের নাম। তবে কিছুটা পার্থক্য তো রয়েছেই। এরা সবাই ছিলেন জাতীয়তাবাদী। নিজ দেশের স্বার্থ তাদের কাছে ছিল বড়। আর চাভেজ নিজ দেশের বাইরে গিয়ে সমগ্র লাতিন আমেরিকার ‘মুক্তির’ স্বপ্ন দেখতেন। ভেনিজুয়েলার বিপুল জ্বালানি সম্পদ ও এর ব্যবহার তাকে এ স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেছিল। তাই আর্জেন্টিনায় পেরেন যা পারেননি, লুলা ব্রাজিলে যা পারেননি কিংবা ফিদেল কাস্ত্রো যেখানে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে উগো চাভেজ ছিলেন সার্থক। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। এমনকি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের অপতত্পরতারও বিরোধী ছিলেন তিনি। একসময় ভেনিজুয়েলা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০০৭ সালে তিনি সব ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে তিনি গঠন করেছিলেন ‘ব্যাংক অব সাউথ’। উদ্দেশ্য ছিল, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ‘দুষ্টচক্র’ থেকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে বের করে আনা। এ ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে অর্থের জোগান যেত গরিব দেশগুলোয়। শুধু তাই নয়, তার দেশ লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোয় কম দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করত। এত দিন মনে করা হতো, সৌদি আরবে রয়েছে বিশ্বের জ্বালানি তেলের বড় ভাণ্ডার। এখন জানা গেল, এ ভাণ্ডার রয়েছে ভেনিজুয়েলায়। এ অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভেনিজুয়েলার জ্বালানি তেল পালন করছে একটি বড় ভূমিকা। গ্রহীতা দেশগুলো পণ্যের বিনিময়ে এ অর্থ পরিশোধ করে। উগো চাভেজ ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। সেখানে কাজ করছেন কিউবার ডাক্তার, নার্স, শিক্ষকসহ ইঞ্জিনিয়াররা। আর এ প্রকল্পের পুরো অর্থ বহন করছে ভেনিজুয়েলা। কিন্তু তাই বলে উগো চাভেজ তার নিজের রাজনীতি চাপিয়ে দেননি ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর ওপর।
১৫ বছর আগেও ভেনিজুয়েলা ছিল একটি বস্তির নগরী। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক। সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ছিল বড় বৈষম্য। চাভেজ ক্ষমতায় এসে বদলে দিলেন সবকিছু। তিনি এমন এক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্ম সেখানে দিয়েছেন; যেখানে গরিব মানুষ, যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় boli bourgeoisie, তারা এখন ক্ষমতার অংশ। ভেনিজুয়েলার ৯০ শতাংশ মানুষ এখন তিনবেলাই খেতে পারে। বিশ্বের পঞ্চম সুখী দেশ হচ্ছে ভেনিজুয়েলা। সরকারি জমি তিনি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তুলেছেন। ২০০৪ সালের পর থেকে মাথাপিছু জিডিপি ২৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সময়সীমায় তিনি দেশটির দারিদ্র্য কমিয়েছেন তিন ভাগের দুই ভাগ। বেকারত্ব যেখানে ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ, তা তিনি ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলেন।
যারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত— Ecomomic Democracy ও participatiory Democracy. চাভেজ এ দুুটিরই সফল প্রয়োগ করেছিলেন ভেনিজুয়েলায়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত; সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিনে পয়সায় কলেজে পড়া, ওষুধ প্রাপ্তিসহ সবার জন্য ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, নারীর অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভেনিজুয়েলার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যার সঙ্গে বোধকরি স্ক্যান্ডেনেভিয়ার সোস্যাল ডেমোক্রেসির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। চাভেজ তার এ পরিবর্তনের আন্দোলনকে বলতেন Bolivarian Revolution। বলিভিয়ার সাধারণ মানুষ তাকে মুক্তিদাতা হিসেবে মনে করত। মেরুন রঙ ছিল তার সিম্বল। তার ডাকে হাজার হাজার মানুষ মেরুন রঙের শার্ট পরে রাস্তায় বের হতো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু ভেনিজুয়েলায় Bolivarian Revolution-এর ব্যাখ্যাটা ভিন্ন। কলকাতায় এসেছিলেন তিনি ২০০৬ সালে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রেভলিউশনে বিশ্বাসী। এটা এক নতুন ধরনের বিপ্লব, যার সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ থাকবে না। আমি মনে করি, রেভলিউশনারি ডেমোক্রেসি— এটাই আজকের নতুন পথ।’ গণতন্ত্রকে লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে নতুন একটি রূপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আর এটা করতে গিয়ে তিনি সিমন বলিভারকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। চাভেজ মনে করতেন, কোনো দেশ কারো মডেল হতে পারে না। তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবলেও চীন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মডেল নয়, এটাও তিনি বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু তার এই মেসেজ পৌঁছে দিয়েছিল পুঁজিবাদী বিশ্বে। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো ছিল তার বিরুদ্ধে। তারা চাভেজের সামাজিক প্রোগ্রামগুলোর ব্যাপারেও অসন্তুষ্ট ছিল। শুধু বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোই নয়, বরং মার্কিন বিলিয়নেয়ার কচ ব্রাদার্স ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হাইনজ (Heinz)-এর সঙ্গেও তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, এ কোম্পানির মালিক মিসেস হাইনজ হচ্ছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির স্ত্রী। হাইনজ কোম্পানির (যারা কেচআপ তৈরি করে) বিশাল বিনিয়োগ ছিল ভেনিজুয়েলায়। শত শত বিঘা সরকারি সম্পত্তি হাইনজ তাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছিল এবং সেখানে টমেটোর বাগান করেছিল। চাভেজ ক্ষমতায় এসে ওই বন্দোবস্ত বাতিল করে দেন। ফলে হাইনজ কোম্পানি তার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে এবং শ্রমিকদের বরখাস্ত করে ২০০১ সালে। চাভেজ বন্ধ কারখানা জাতীয়করণসহ সব শ্রমিককে পুনর্বহাল করেছিলেন।
চাভেজের একটা বড় অবদান হচ্ছে— দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে তিনি ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের বের করে আনতে পেরেছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ভেনিজুয়েলার জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ, যারা negro e indio (Black and Indian) হিসেবে পরিচিত (জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ), তারা থাকত অনেকটা বস্তিঘরে। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল না। আজ প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ, সব ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শিক্ষা নিশ্চিত করেছেন চাভেজ। দারিদ্র্য কমিয়ে এনেছেন। ১৯৯৮ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে। এ পরিসংখ্যান জাতিসংঘের। ১৮টি লাতিন আমেরিকাভুক্ত দেশের মধ্যে ভেনিজুয়েলার আর্থসামাজিক অবস্থা সবচেয়ে ভালো। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও আয় বণ্টনের দিক দিয়ে ভেনিজুয়েলার অবস্থান তৃতীয়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুয়ায়ী, ভেনিজুয়েলায় বর্তমানে ৫০ মিলিয়ন মধ্যবিত্ত রয়েছে, যারা এক নতুন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে সেখানে। তাকে বলা হয় এ যুগের ‘সিমন বলিভার’। সিমন বলিভার স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন। আর চাভেজ যুদ্ধ করে গেছেন বিশ্বব্যাপী মার্কিন আগ্রাসানের বিরুদ্ধে। এটা করতে গিয়ে কিংবা বলা যেতে পারে তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকার কারণে বলিভিয়ার মোরালেস, ইকুয়েডরের রাফায়েল কিংবা নিকারাগুয়ার ওর্তেগার সঙ্গে তার রাজনৈতিক সখ্য তৈরি হলেও বিপরীত রাজনীতির অধিকারী ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল চমত্কার। জীবিতকালে তিনি লিবিয়ার প্রয়াত নেতা গাদ্দাফির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একই সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকেও সমর্থন করে গেছেন তিনি। এর পেছনে কাজ করেছিল তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা। লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন The Bolivarian Alliance For the peoples of our America (ALBA) নামক সংগঠনটি, যার সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১০। সিমন বলিভার সমগ্র লাতিন আমেরিকার জনগণকে American হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছিলেন। চাভেজও বলতেন সে কথা। একই সঙ্গে The commuinity of latin American and caribbean states (CELAC) গঠনের উদ্যোক্তাও তিনি। দরিদ্র, বস্তিবাসী সাধারণ মানুষকে নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তার দর্শন ছিল সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা। এটা করতে গিয়ে তিনি সিমন বলিভারের মতো বিপ্লবীকে বেছে নিয়েছেন আদর্শ হিসেবে। বলতেন,
‘Bolivar is the fight that does not end, he is born everyday in ourselves, in his people, in the children, in the fight for life and social justice.’ কেউ কেউ তার এ আন্দোলনকে চিহ্নিত করেছেন Chavismo হিসেবে। কিন্তু একটি প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠেছে। Bolivarian revolution or Chavismo যে নামেই এ আন্দোলনকে চিহ্নিত করা হোক না কেন, তার এখন কী হবে? এ আন্দোলন কি ভেঙে যাবে? শয়তান হিসেবে আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন চাভেজ। চীন থেকে ইরান, যেখানেই মার্কিন বিরোধিতা আছে সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন সংহতি প্রকাশের জন্য। কিন্তু এখন? নিকোলাস মাদুরো এখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। একটা সংকট থেকেই গেল। বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো এখন সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান কিংবা সংঘাত, হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করে সুযোগ নিতে পারে। কেননা ভেনিজুয়েলায় রয়েছে তাদের বড় স্বার্থ। মাদুরো কিংবা বিরোধী পক্ষকে তারা ব্যবহার করতে চাইবে। মাদুরোকে চাভেজই বেছে নিয়েছিলেন। একজন সামান্য বাস ড্রাইভার থেকে মাদুরো এখন রাষ্ট্রপ্রধান। চাভেজের মতো তার সেই ক্যারিশমা নেই, তবে বাস্তবতা হচ্ছে— লাতিন আমেরিকায় বিশেষ করে বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে এই Bolivarian Revolution। একুশ শতক প্রত্যক্ষ করছে এক নতুন ধরনের ‘পপুলিজম’। Kevin zeese and Margaret Flowers এর ভাষায়, This Revolution Which is not limited to Venezuela, is likely to show to itself and the world that it is deep and strong, the people powered transformation with which Chavez was in solidarity will continue. এটাই হচ্ছে আসল কথা। যে আন্দোলন চাভেজ শুরু করেছেন, তা অব্যাহত থাকবে।
Daily BONIK BARTA
15.03.13

0 comments:

Post a Comment